বান্দরবান: বন্ধ হোক যত সহিংসতা, মৈত্রীময় স্নিগ্ধ ছোঁয়ায় আসুক শুভ্রতা – এ প্রতিপাদ্য নিয়ে বর্ণাঢ্য শোভাযাত্রার মধ্য দিয়ে বান্দরবানে সূচনা হয়েছে বর্ষবরণ উৎসব বৈসাবি।
এ উপলক্ষে মঙ্গলবার (১২ এপ্রিল) সকালে ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠির সাংস্কৃতিক ইনস্টিটিউটের আয়োজনে শহরের রাজার মাঠ থেকে বর্ণাঢ্য শোভাযাত্রা বান্দরবান শহর প্রদিক্ষণ শেষে একই স্থানে গিয়ে শেষ হয়।
পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রী বীর বাহাদুর উশৈসিংসহ শোভাযাত্রায় অংশ নেন, ৬৯ পদাতিক ব্রিগেডের কমান্ডার ব্রিগেডিয়ার জেনারেল ফখরুল আহসান, জেলা প্রশাসক দিলীপ কুমার বণিক, পুলিশ সুপার মিজানুর রহমান, বান্দরবান পৌরসভার মেয়র মোহাম্মদ ইসলাম বেবী, পার্বত্য জেলা পরিষদের সদস্য লক্ষ্মীপদ দাস, সাংগ্রাই উদযাপন কমিটির সভাপতি মংচিনু মার্মা, ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠির সাংস্কৃতিক ইনস্টিটিউটের পরিচালক মংনুচিং, মারমা শিল্পিগোষ্ঠীর সভাপতি চথুই প্রু প্রমুখ।
এছাড়াও মারমা, চাকমা, বম, লুসাই, চাক, খুমীসহ ১২টি খুদ্র নৃ-গোষ্ঠির তরুণ-তরুণীরা এ শোভাযাত্রায় অংশ নেন।
শোভাযাত্রা শেষে রাজার মাঠে বৌদ্ধ ধর্মীয় রীতি অনুযায়ী বয়স্ক পূজা অনুষ্ঠিত হয়।
সাংগ্রাইমা, ঞি ঞি ঞা ঞা, রিক্জে গে পা মে’-এসো মিলি সাংগ্রাই এর মৈত্রী পানি বর্ষণের উৎসবে-ঐতিহ্যবাহী এ মারমা গানের সুর মূর্ছনায় এখন উদ্বেলিত পাহাড়ি জনপদ বান্দরবান।
বর্ষবরণকে ঘিরে আদিবাসী পল্লীগুলোতে শুরু হয়েছে উৎসবের ধুম। নতুন জামা-কাপড় কেনা, পিঠা তৈরি, ঘর সাজানো, বৌদ্ধ বিহারে ধর্মীয় গুরুদের জন্যে খাবার নিয়ে যাওয়া সর্বোপরি মৈত্রী পানিবর্ষণের বাঁধভাঙা উচ্ছ্বাস-সব মিলিয়ে পুরো জেলার সবক’টি সম্প্রদায়ের মানুষ এখন একাট্টা হয়েছে নতুন বছরকে বরণ করে নিতে।
পুরনো দিনের সমস্ত গ্লানি ধুয়ে মুছে নতুনের আয়োজনে এখন ব্যস্ত সবাই। আদিবাসী সম্প্রদায়গুলোর এসব আয়োজনের সঙ্গে বাঙালিদের পহেলা বৈশাখ উদযাপনের প্রস্তুতি মিলে মিশে একাকার হয়ে গেছে পাহাড়ি জেলা বান্দরবানে।
সাংগ্রাই উৎসব উদযাপন পরিষদ সূত্রে জানা যায়, মঙ্গলবার (১২ এপ্রিল) থেকে পুরাতন রাজবাড়ি মাঠে আনুষ্ঠানিকভাবে সাংগ্রাই পোয়ে উৎসবের সূচনা হবে। বান্দরবান জেলা প্রশাসন, ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর সাংস্কৃতিক ইনস্টিটিউট, সাংগ্রাই উৎসব উৎযাপন পরিষদ, বাংলাদেশ তঞ্চঙ্গ্যা কল্যাণ সংস্থা, ম্রোচেটের সহায়তায় সাংগ্রাই উৎসব পালনে পাঁচ দিনব্যাপী নানা কর্মসূচি গ্রহণ করেছে। উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে শোভাযাত্রা, শিশু চিত্রাঙ্কণ প্রতিযোগিতা, ক্রীড়া প্রতিযোগিতা অনুষ্ঠিত হবে।
বুধবার (১৩ এপ্রিল) বিকেলে স্থানীয় খ্যংওয়া ক্যং (বিহার) ও খ্যংফিয়া ক্যং থেকে বুদ্ধমূর্তি স্নান করাতে নিয়ে যাওয়া হবে উজানী পাড়ার সাঙ্গু নদীর ঘাটে। এরপর রাতে পাম্প হাউজ, উজানী পাড়া ও এলাকার বিভিন্ন স্থানে রয়েছে পিঠা তৈরির আয়োজন।
বৃহস্পতিবার (১৪ এপ্রিল) বান্দরবান পার্বত্য জেলা পরিষদ ও জেলা প্রশাসনের আয়োজনে ঐতিহ্যবাহী রাজার মাঠ থেকে বর্ণাঢ্য আনন্দ শোভাযাত্রা, যেমন খুশি তেমন সাজ, পান্তা ইলিশ উৎসব ও লোকজ সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান। বিকেলে জেলা প্রশাসনের উদ্যোগে সম্প্রীতির মঞ্চে বৈশাখী পিঠা উৎসব, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান ও আলোচনা সভার আয়োজন করেছে।
শুক্রবার (১৫ এপ্রিল) থাকছে বান্দরবানে সাংগ্রাই উৎসবের সবচেয়ে বর্ণাঢ্য আয়োজন। এদিন অনুষ্ঠিত হবে উৎসবের মূল আকর্ষণ মৈত্রী পানিবর্ষণ। একই দিন সন্ধ্যায় উপজাতীয় সাংস্কৃতিক ইনস্টিটিউটের উদ্যোগে রাজবাড়ি মাঠে অনুষ্ঠিত হবে আদিবাসী সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান।
শনিবার (১৬ এপ্রিল) রয়েছে একই ধরনের অনুষ্ঠানমালা। ধর্মীয় আনুষ্ঠানিকতার মধ্যে থাকবে বৌদ্ধ মন্দিরে যাত্রা, ধর্ম দেশনা শ্রবণ, শীল গ্রহণ ও উৎসর্গের মাধ্যমে ৫ দিনব্যাপী সাংগ্রাই উৎসব শেষ হবে রোববার (১৭ এপ্রিল)।
এছাড়াও জেলা সদরের রেইছা, সুয়ালক, রাজবিলা, কুহালং এবং রোয়াংছড়ি, থানচি ও রুমা উপজেলায় আদিবাসী মারমা, চাকমা, ত্রিপুরা ও তঞ্চঙ্গ্যারা বৈসাবি উপলক্ষে বিভিন্ন অনুষ্ঠানমালার আয়োজন করেছে।
অন্যদিকে বর্ষবরণকে কেন্দ্র করে পাহাড়ি জেলা বান্দরবান সেজেছে বর্ণিল সাজে। বর্ষবরণ ও বিদায় অনুষ্ঠানের মাধ্যমে সব পাপাচার ও গ্লানি ধুয়ে-মুছে নিতে এ জেলায় বসবাসরত পাহাড়ি-বাঙালি উভয় সম্প্রদায় বৈচিত্র্যময় অনুষ্ঠানে মেতে উঠেছে।
এছাড়াও দেশ-বিদেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে আগত পর্যটকদের আগমনে মুখরিত হয়ে উঠেছে বান্দরবান।