ঢাকা:গুলিস্তান থেকে গোড়ান পর্যন্ত চলাচলকারী লেগুনায় প্রতি মাসে প্রায় পঁচিশ লাখ টাকা চাঁদা তোলা হচ্ছে। আর এ টাকার অর্ধেক চলে যাচ্ছে স্থানীয় থানা পুলিশ ও রাজনৈতিক দলের অঙ্গ সংগঠনের পাতি নেতাদের পকেটে। চাঁদাবাজ এ চক্রের কাছে অসহায় হয়ে পড়েছে লেগুনার চালক ও মালিকরা। ফলে চাঁদার টাকা পুষিয়ে নিতে নানা ছুতোয় বাড়ছে লেগুনার ভাড়া। হয়রানির শিকার হচ্ছেন যাত্রীরা।
লেগুনার চালক, হেলপার ও মালিকদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, এই রুটে প্রতিদিন ১২০টি লেগুনা চলাচল করে। এসব লেগুনায় দীর্ঘদিন ধরেই চলছে নীরব চাঁদাবাজি। তবে এ চাঁদা তোলা হচ্ছে কয়েকটি ভাগে। প্রথমে গুলিস্তান থেকে শুরু হয় এ চাঁদা, পরে তা শেষ হয় গোড়ান এলাকায় গিয়ে। গুলিস্তান থেকে লেগুনা ছাড়ার জন্য দিতে হয় একশ’ টাকা, তারপর খিলগাও এলাকার আমতলায় দিতে হয় সাড়ে তিনশ’ টাকা, সিপাহীবাগে পঞ্চাশ এবং গুলিস্তান ও খিলগাও রেলগেটে লেগুনাকে লাইন করিয়ে দেয়া বাবদ একজনকে দিতে হয় একশ’ টাকা। সব মিলে সারাদিনে তাদের প্রতি লেগুনায় দিতে হয় ছয়শ’ টাকা। আর হিসেবে করলে মোট একশ’ বিশটি লেগুনায় প্রতিদিন চাঁদা ওঠানো হয় বায়াত্তুর হাজার টাকা।
আরো জানা গেছে, প্রতিদিন যে ছয়শ‘ টাকা চাঁদা তোলা হয় তার পুরোটাই যায় রাজনৈতিক পরিচয়দানকারী খিলগাও এলাকার কয়েকজন পাতি নেতার হাতে। তারাই মূলত এ খিলগাও ও গোড়ান এলাকার লেগুনা চলাচলের বিষয়টি নিয়ন্ত্রণ করে থাকে।
লেগুনার চাঁদা শুধু রাজনৈতিক দলের পাতি নেতারাই খান না, তাদের সঙ্গে সখ্য গড়ে এ চাঁদার ভাগ নেন আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্য থেকে শুরু করে থানা পুলিশও।
তাদের অভিযোগ,প্রতি দশ দিন অন্তর অন্তর প্রতি লেগুনা বাবদ পুলিশকে দিতে হয় আটশ’ করে টাকা। হিসেব করলে প্রতি সপ্তাহে তা দাঁড়ায় আশি হাজারের অধিক, আর মাসে আড়াই লাখের উপরে।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন লেগুনার চালক জানান, রাজনৈতিক দলের পরিচয় দিয়েই তোলা হয় এ চাঁদা। কখনও যুবলীগ,কখনও শ্রমিক লীগ, ছাত্রলীগ এবং আওয়ামী লীগের নাম করে তোলা হচ্ছে এসব চাঁদা। তবে মূলে রয়েছেন ওই এলাকার একটি ঋণদানকারী সমবায় সমিতির সভাপতি আকতার হোসেন, সাধারণ সম্পাদক গাফফার ও শ্রমিক নেতা জাকির।
তিনি আরও জানান, তাদের নিয়োগকৃত লোক আজাদ ও জিহ্ববা বাবু প্রতিদিন চাঁদা তোলার কাজটি করেন। তারাই চাঁদা তুলে সভাপতি আকতার ও গাফফারকে দেন। তারা পরে ভাগবাটোয়ারা করেন।
কয়েকজন হেলপারের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, মাস দুয়েক আগেও এ চাঁদার পরিমাণ ছিল মাত্র চারশ’ টাকা। কিন্তু হঠাৎ করে এ চাঁদা বাড়ানো হয়েছে। বিভিন্ন ব্যয় বেড়ে যাওয়ার কারণে এ চাঁদার পরিমাণও বাড়ানো হয়েছে বলে তাদের জানানো হয়েছে।
শুক্রবার বিকেলে সরেজমিনে দেখা গেল, চাঁদা উত্তোলনকারী জিহ্ববা বাবু ও তার সঙ্গে থাকা কয়েকজন দাঁড়িয়ে আছেন। বিকেল পর্যন্ত কয়টি লেগুনা যাতায়াত করেছে তার হিসেব করছেন বাবু। তবে এসময় আজাদকে পাওয়া যায়নি। কারণ হিসেবে জানা গেল- তারা দুজন সকাল ও বিকেল শিফটে চাঁদা তোলার কাজ করেন।
একজন চালক বলেন, চাঁদা না দিয়া কই যামু? চাঁদা দিতে হইবো এটা সবাই জানে। প্রতিদিন চাঁদা দেয়া তো এ রুটে নিয়ম হইয়া গ্যাছে।
প্রতিবাদ করলেই লেগুনায় হামলা ও চলাচল বন্ধ দেয়া হয় বলে জানান তিনি।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন লেগুনার মালিক জানান, চাঁদাবাজদের সঙ্গে মালিকরা কোনভাবেই পেরে উঠতে পারছেন না। তাদের কাছে তারা অসহায় হয়ে পড়েছেন। চাঁদা দিতে অস্বীকৃতি জানালেই বিভিন্নভাবে হয়রানি করা হয়। ফলে আয় রোজগার ঠিক রাখতে মালিকরাও আর কোন প্রতিবাদ করেন না।
লেগুনার একজন চালক বলেন,পেটের কথা চিন্তা কইরা আমরা লেগুনার চালকরা কিছু কইতে পারি না।
তার কথা শেষ না হতেই আরেক চালক কথা টেনে বলেন,এ রুটে চাঁদাবাজি এখন নিয়মিত ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে। গাড়ি নামালেই চাঁদা দিতে হবে এটা মেনেই নিয়েছেন মালিকরা।
এ ব্যাপারে মাঝে মধ্যে কেউ প্রতিবাদ করলেই তাকে বিভিন্নভাবে হয়রানি ও লেগুনায় আগুন ধরিয়ে দিয়ে পুড়িয়ে দেয়ার হুমকি দেয়া হয় বলে জানান এক হেলপার।
হেলপার ও চালকদের সঙ্গে কথা বলে আরও জানা গেলো, সভাপতি আকতার ও সম্পাদক গাফফার প্রচেষ্টা সঞ্চয় ও ঋণদান সমবায় সমিতির কার্যালয়ের মধ্যেই সারাক্ষণ বসে থাকেন। এটি রেলগেট থেকে পার হয়ে খিলগাও থানা যাওয়ার রাস্তার বামপাশে কিছু দুরে। সেখান থেকেই তারা এসব চাঁদাবাজির নেটওয়ার্ক নিয়ন্ত্রণ করেন।
পরে সেই সমিতির কার্যালয়ে যাওয়া হলে সমিতি বন্ধ পাওয়া যায়। এসময় কাউকে খুঁজেও পাওয়া যায়নি। তবে সভাপতি আকতার ও সাধারণ সম্পাদক গাফফারের কোন মুঠোফোন নাম্বার চালকরা জানাতে পারেননি। ফলে তাদের সংশ্লিষ্ট কারও কোন বক্তব্যও পাওয়া যায়নি।
এ ব্যাপারে খিলগাও থানার ওসি (ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা) কাজী মইনুল হক বলেন, পুলিশের নাম ভাঙ্গিয়ে তো অনেকেই চাঁদাবাজি করে। কারা এমন অভিযোগ করেছে তাকে নিয়ে আসেন। যদি প্রমাণসহ সামনে এসে বলতে পারে আমার কোন পুলিশ সদস্য চাঁদা তোলে তবে তাকেসহ জেলে ঢুকাবো। কারা এসব কাজ করছে তালিকা দেন, তাদের গ্রেফতার করা হবে।