রানা প্লাজা ট্রাজেডির তিন বছর হয়ে গেল। প্রায় ১১০০ কারখানা শ্রমিকের মারা যায় এ দুর্ঘটনায়। এখন শ্রমিকদের অধিকার ও নিরাপত্তার বিষয়টি বেশ নজরদারিতে রয়েছে। কিন্তু বিশেষজ্ঞ ও অ্যাক্টিভিস্টরা বলছেন, সমস্যা সমাধান প্রক্রিয়ায় উন্নতির গতি শ্লথ।
বৈশ্বিক ফ্যাশন রিটেইলার্সরা বলছেন, এ ট্রাজেডির ফলে উন্নয়নশীল দেশগুলোর শ্রমিকদের সুরক্ষা ও ভবনের নিরাপত্তা নিশ্চিতে আরও ঘনিষ্ঠভাবে কাজ করছেন। সাপ্লাই চেইনে স্বচ্ছতা আনতে আইনও পাশ হয়েছে।
নিউ ইয়র্ক বিশ্ববিদ্যালয়ের স্কুল অব বিজনেসের ‘সেন্টার ফর বিজনেস অ্যান্ড হিউম্যান রাইটস’-এর সহ-পরিচালক সারাহ লাবোউইটয। তিনি বলেন, ‘প্রায় ২০০টি ব্রান্ড একসঙ্গে কাজ করছে। অবশ্যই স্বচ্ছতা আরও বেড়েছে। বৈশ্বিক বিপনী ব্যবস্থাপনায় মানবাধিকার ইস্যুর দিকে নজর বেড়েছে।’
কিন্তু লাবোউইটয বলেন, ‘আগ্নি-নিরাপত্তা, ভবন নিরাপত্তা, শ্রমিক সুরক্ষা Ñ ইত্যাদি ইস্যুতে যথেষ্ট বাস্তবিক আলোচনা হয়নি, অর্থায়নও হয়নি। তাই যথেষ্ট পরিবর্তনও আসেনি।’ তিনি রানা প্লাজা ট্রাজেডির পরে এ নিয়ে একটি প্রতিবেদন লিখেছিলেন।
শিল্পখাতের ইতিহাসে রানা প্লাজা বিপর্যয় ছিল সবচেয়ে মারাত্মক দুর্ঘটনার একটি। ৮ তলা ভবন ধ্বসে পড়ে মারা যায় ১১৩৫ জন মানুষ। এ ভবনে ছিল ৫টি গার্মেন্ট কারখানা। কারখানাগুলোয় নির্মিত পোশাক যেত বৈশ্বিক ব্রান্ডগুলোর শো-রুমে। এ দুর্ঘটনার ফলে বিশ্বের তৈরি পোশাকের দ্বিতীয় বৃহত্তম রপ্তানিকারক বাংলাদেশের ওপর চাপ বাড়ে। দাবি উঠে নিরাপত্তা ব্যবস্থা জোরদারের। বাংলাদেশ থেকে যারা পোশাক কিনছে, সেসব কো¤পানির ওপরও চাপ বাড়ে।
পশ্চিমা বিশ্বে বাংলাদেশের পোশাক প্রবেশের ওপর কর নেই। এছাড়া শ্রমিকদেরও বেতন খুব কম। ফলে এটি অচিরেই দাঁড়িয়ে যায় এমন এক শিল্পে, যেখান থেকে বার্ষিক আয় হয় ২৫০০ কোটি ডলার। বাংলাদেশের ষাট শতাংশ পোশাকই রপ্তানি হয় ইউরোপে। আমেরিকায় যায় ২৩ শতাংশ। কানাডায় ৫ শতাংশ। বাংলাদেশে গার্মেন্ট শ্রমিকদের ন্যুনতম মজুরি ৬৮ ডলার। অথচ, চীনে এ মজুরি ২৮০ ডলার। তবে এরপরও চীনই বিশ্বের বৃহত্তম পোশাক রপ্তানিকারক দেশ।
বৃটেনের স্বল্পমূল্যের খুচরা পোশাক বিক্রেতা কো¤পানি প্রাইমার্ক। রানা প্লাজায় তাদেরও কিছু পোশাক তৈরি হচ্ছিল। প্রতিষ্ঠানটি জানায়, শ্রমিকদের নায্য মজুরি ও তাদের ভালো কর্মপরিবেশ নিশ্চিত করার গুরুত্ব কো¤পানিগুলো স্বীকৃতি দিয়েছিল আগেই। কিন্তু ভবন নিরাপত্তা নিয়ে রানা প্লাজা ট্রাজেডির আগে কেউ ভাবেনি। এক সাক্ষাৎকারে প্রাইমার্কের এথিকাল ট্রেডিং টিমের প্রধান পল লিস্টার বলেন, ‘এটা নায্য হবে যদি বলি যে, ভবনের গাঠনিক শক্তিমত্তাকে আগে ঝুঁকি হিসেবে কো¤পানিগুলো বিবেচনা করেনি। আপনি ভবনের ভেতরে তাকাবেন। কিন্তু মেঝের ওপরে বা নিচে তাকাবেন না। আপনি যথাযথ সার্টিফিকেটও দেখতে পাবেন। তবে রানা প্লাজার সার্টিফিকেটগুলো পরে ভুয়া প্রমাণিত হয়েছে। আমি মনে করি না যে, এ শিল্পসংশ্লিষ্টরা ভেবেছিল একদিন এ ভবনগুলো ধ্বসে পড়বে।’
২০১৩ সালের ২৪ এপ্রিল রানা প্লাজা ধ্বসের পর, রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠান রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (রাজউক) সাবেক এক প্রধান প্রকৌসুলি বলেন, ভবনের মালিক ভবনটি নির্মানের ক্ষেত্রে যথাযথ অনুমতি নেননি। এছাড়া অবৈধভাবে উপরে তিন তলা বানানো হয়েছিল। এ বিপর্যয়ের ঘটনায় ৪০ জনের বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন করা হয়েছে। ২৪ জন অভিযুক্ত পলাতক।
বিপর্যয়ের পর বৈশ্বিক পোশাক বিক্রেতা প্রতিষ্ঠানগুলোর দুইটি আন্তর্জাতিক জোট সৃষ্টি হয়। উদ্দেশ্য, বাংলাদেশের হাজার হাজার গার্মেন্ট কারখানায় ভবন ও অগ্নি নিরাপত্তা উন্নয়ন যাচাই ও অর্থায়নে সাহায্য করা। বেশিরভাগ ইউরোপিয়ান খুচরা পোশাক বিক্রেতা কো¤পানি রয়েছে ‘অ্যাকর্ড অন ফায়ার অ্যান্ড বিল্ডিং সেফটি ইন বাংলাদেশ’-এ। এ জোট প্রায় ১৬০০টি কারখানা পর্যবেক্ষন করে। এসব কারখানার কয়েকটি ব্যবহার করে এইচঅ্যান্ডএম, মার্ক্স অ্যান্ড ¯েপন্সার ও প্রাইমার্কের মতো প্রতিষ্ঠান। বেশিরভাগ কারখানার জন্য গাঠনিক, বৈদ্যুতিক ও অগ্নি-নিরাপত্তা উন্নয়ন পরিকল্পনা প্রণয়ন করে এ জোটের পরিদর্শকরা।
কিন্তু প্রায় তিন বছর হতে চলল। প্রায় ৭০ শতাংশ পরিকল্পনাই ধার্য করা সময়ের চেয়ে পিছিয়ে গেছে। জোটের ওয়েবসাইটেই এ তথ্য দেয়া আছে।
উত্তর আমেরিকা (যুক্তরাষ্ট্র ও কানাডা) আবার তৈরি করেছে আরেকটি জোট। নাম হলো ‘দ্য অ্যালায়েন্স ফর বাংলাদেশ ওয়ার্কার সেফটি’।
লাবোউইটয বলেন, মানদ- তৈরি ও রক্ষা করা কঠিন কাজ। তার মতে, ‘বিপণী ব্যবস্থাপনায় অর্থনৈতিক, ভৌগোলিক ও রাজনৈতিক প্রভাবক কাজ করে। একটি বৈশ্বিক পরিদর্শন কাঠামো কঠিন কাজ।’
পরিদর্শনের শ্লথ গতির ফলে প্রাইমার্ক নিজেরাই নিজেদের গাঠনিক সার্ভেয়ার নিয়োগ দিয়েছে। এ সার্ভেয়াররা বাংলাদেশের ১০০টি কারখানা ও পাকিস্তানে ৬০টির মতো কারখানা নজরদারিতে রাখবে। এসব কারখানা থেকেই প্রাইমার্কের পোশাক তৈরি হয়। এ তথ্য দিলেন পল লিস্টার। তার ভাষায়, ‘এসব দেশে এ ধরণের উঁচু কারখানা আছে। কিছু কারখানা নির্মানই করা উচিৎ ছিল না। কিন্তু দুর্নীতির মাধ্যমে সেগুলো নির্মিত হয়েছে। তাই ঝুঁকিটা আরও বড়।’