খাদিজার ওপর হামলার প্রতিবাদে উত্তাল হয়ে উঠেছে সিলেট। খাদিজার ওপর হামলার ঘটনায় সিলেটের সর্বস্তরের মানুষ ক্ষোভ প্রকাশ করছে। সবাই ছাত্রলীগ নেতা বদরুলের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দাবি করেন। সকাল থেকে উত্তাল হয়ে উঠে সিলেটের চৌহাট্রা এলাকা। চলমান তিন দিনের কর্মসূচির অংশ হিসেবে সকালে সিলেট সরকারি মহিলা কলেজের শিক্ষার্থীরা ক্যাম্পাসে অবস্থান নেন। এ সময় সেখানে আসেন প্রফেসর ড. নুরুল ইসলাম, সহযোগী অধ্যাপক মো. মুছব্বির চৌধুরী ও মানিক কুমার সাহাসহ আরও অনেকে। সবাই কালোব্যাজ ধারণ করে প্রতিবাদ জানায়। বেলা পৌনে ১১টার দিকে সহস্রাধিক শিক্ষার্থী বিক্ষোভ শুরু করে। তারা বিক্ষোভ মিছিল নিয়ে কলেজ ক্যাম্পাস থেকে শুরু করে চৌহাট্রা, রিকাবীবাজার, লামাবাজার, মির্জাজাঙ্গাল, জিন্দাবাজার প্রদক্ষিণ করে ফের কলেজের প্রধান ফটকে আসেন। এ সময় তারা বন্দরবাজার-আম্বরখানা সড়কে অবস্থান নিয়ে বিক্ষোভ প্রকাশ করেন। প্রায় আধঘণ্টা বিক্ষোভ চলাকালে ওই সড়কে তীব্র যানজট দেখা দেয়। শিক্ষার্থীদের বিক্ষোভের সঙ্গে এসে একাত্মতা প্রকাশ করেন অভিভাবক ও প্রাক্তন শিক্ষার্থীরা। এ সময় কলেজের অধ্যক্ষ প্রফেসর ড. নুরুল ইসলাম বলেন, ‘বর্বরোচিত এ হামলার প্রতিবাদের ভাষা আমরা হারিয়ে ফেলেছি। সবাই এ ঘটনায় মর্মাহত। আমরা প্রার্থনা করছি, আমাদের প্রিয় শিক্ষার্থী খাদিজা সুস্থ হয়ে আমাদের মাঝে ফিরে আসুক।’ তিনি হামলাকারী বদরুলের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দাবি করেন। এ সময় প্রফেসর সামিয়া বলেন, ‘আমরা এ ঘটনার সুষ্ঠু তদন্ত ও বিচার চাই। আমাদের দাবি একটাই- খাদিজার ওপর হামলাকারীকে দ্রুত বিচার আইনে বিচার করা হোক। আর এমন বিচার হোক- যাতে আর কোনো নরপশু এমন আচরণ করতে সাহস না পায়।’ সিলেটের কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারের সামনে অবস্থান নিয়ে কলেজের শিক্ষার্থীরা প্রায় আধা ঘণ্টা বিক্ষোভ করে। এ সময় শিক্ষার্থীরা জানায়, পূর্ব ঘোষণা অনুযায়ী তারা বুধবার সকাল থেকে ক্লাস ও পরীক্ষা বর্জন করেছে। এরপর কালোব্যাজ ধারণ করে তারা বিক্ষোভ করেছে। বিকাল পর্যন্ত তারা ক্যাম্পাসে অবস্থান কর্মসূচি পালন করবে বলে জানায়। দুপুরে খাদিজার ওপর হামলার ঘটনাস্থল সিলেট এমসি কলেজের শিক্ষার্থীরা মানববন্ধন করেছেন। দুপুরে এমসি কলেজের ফটকের কাছে সিলেট-তামাবিল সড়কে তারা মানববন্ধন করে। এ সময় তারা রাস্তায় অবস্থান নিয়েও ক্ষোভ দেখান। এমসি’র সকল বিভাগের শিক্ষার্থীদের মানববন্ধন থেকে জানানো হয়, খাদিজার ওপর হামলার দ্রুত বিচার না হলে সিলেটের সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীরা এক হয়ে আন্দোলনে নামবেন। এ ব্যাপারে পুলিশ প্রশাসনকে আরো কার্যকর ভূমিকা রাখার আহ্বান জানানো হয়। খাদিজার ওপর হামলার ঘটনায় সিলেটে গতকাল দিনভর কর্মসূচি পালন করা হয়েছে। বিকালে সিলেটের টুকেরবাজারে বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের পক্ষ থেকেও মানববন্ধন করা হয়। আর সিলেট নগরীর কোর্ট পয়েন্ট সহ কয়েকটি এলাকায় সামাজিক সংগঠনের পক্ষ থেকে কর্মসূচি পালন করা হয়।
কাঁদছে খাদিজার পরিবার: খাদিজার পিতা মাসুক মিয়া সৌদি আরবে। ঘটনার পর থেকে খাদিজার অসুস্থ মা মনোয়ারা বেগম কেঁদেই চলেছেন। তিনি বিছানায় শুয়ে হাউমাউ করে কাঁদছেন। কোনো সান্ত্বনাই তাকে শান্ত করছে পারছে না। কাঁদছে গোটা আউশা গ্রামও। গতকাল বিকালে খাদিজার বাড়িতে গেলে কান্নার আওয়াজ ভেসে উঠে। বিলাপ করে মনোয়ারা বেগম বলেন ‘আমি দুধ-কলা খাইয়ে কালসাপ পুষেছিলাম। যাকে নিজের ছেলের মতো আশ্রয় দিয়েছি, সে এ কাজ করলো। সন্তানদের খাওয়ার আগে তাকে খাইয়েছি।’ মনোয়ারা বেগমের পাশে বসা খাদিজার চাচাত বোন নাদিয়া ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছিলেন। নাদিয়া জানান, সারাদিন তারা দুজন মিলে দুষ্টুমি করতেন। দু’বোন মিলে পুরো বাড়ি মাতিয়ে রাখতেন। গত সোমবার থেকে তাদের বাড়িতে বইছে পিনপতন নীরবতা। প্রায় ৭ বছর আগে তাকে এবং তার ছোট ভাইবোনদের বাড়িতে লজিং থেকে পড়াতেন বদরুল। বছর তিনেক আগে জাঙ্গাইল কলেজে তার বোনের সঙ্গে অশোভন আচরণ করায় এলাকার লোকজন বদরুলকে মারধর করে। এর পরও তার বোনের পিছু ছাড়েনি বদরুল। প্রবাসে থাকা মাসুক মিয়া অনেক কষ্ট করে জীবনের সব সঞ্চয় দিয়ে সন্তানদের পড়ালেখা চালিয়ে নিচ্ছেন। তার তিন ছেলে ও এক মেয়ে। বড় ছেলে শাহিন আহমদ চীনে লেখাপড়া করছেন। নার্গিস কলেজে পড়েন। এমন পরিবারের মেয়ের ওপর হামলার ঘটনায় ক্ষুব্ধ এলাকার লোকজন। এলাকার লোকজন এ ঘটনায় হতবাক। তাদের একটাই দাবি ফাঁসি দিতে হবে ওই জঘন্য অপরাধীকে।
টুকেরবাজারে মানববন্ধন: বুধবার দুপুরে ‘সদর উপজেলার সচেতন নাগরিকবৃন্দ’র ব্যানারে আয়োজিত এই মানববন্ধনে একই কাতারে দাঁড়িয়ে বদরুলের শাস্তির দাবি জানান সর্বদলীয় নেতৃবৃন্দ। মানববন্ধনে আওয়ামী লীগ-বিএনপি, আনজুমানে আল ইসলাম, জমিয়তে উলামায়ে ইসলাম, খেলাফত মজলিসের নেতারা উপস্থিত ছিলেন। মানববন্ধনে বক্তারা বলেন, ছাত্রনামধারী বখাটে নরপশু বদরুল আলমকে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দিতে হবে। তাকে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দিলে ভবিষ্যতে এ ধরনের ঘটনা ঘটাতে অন্য কেউ দ্বিতীয়বার ভাববে। কিন্তু তার শাস্তি যদি নিশ্চিত না হয়, তবে এ ধরনের ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটবে। মানববন্ধনে সিলেট মহানগর আওয়ামী লীগের সভাপতি বদরউদ্দিন আহমদ কামরান, সিলেট জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক শফিকুর রহমান চৌধুরী, সিলেট জেলা বিএনপির সাধারণ সম্পাদক আলী আহমদ, সদর উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান আলহাজ আশফাক আহমদ, সাবেক ভাইস চেয়ারম্যান ও উপজেলা বিএনপির সেক্রেটারি আবুল কাসেম, টুকেরবাজার ইউপি চেয়ারম্যান আলহাজ শহিদ আহমদ, বিএনপি নেতা শাহ জামাল নুরুল হুদা, সিলেট প্রেস ক্লাব ফাউন্ডেশনের সভাপতি আল আজাদ, সাংবাদিক ইকরামুল কবির, ৭১ টিভির সাংবাদিক ইকবাল মাহমুদ, দৈনিক সিলেটের ডাক-এর স্টাফ রিপোর্টার নুর আহমদ, দৈনিক উত্তর পর্ব’র স্টাফ রিপোর্টার ওলিউর রহমান, অনলাইন জার্নালিস্ট এসোসিয়েশন সিলেট-এর সহ-সভাপতি ও সিলেট রিপোর্ট ডটকম সম্পাদক মুহাম্মদ রুহুল আমীন নাগরী, আল ইসলাহ নেতা মাওলানা আজির উদ্দীন পাশা, কাজী জুনায়েদ আহমদ, তালামিয নেতা শরীফ উদ্দীন প্রমুখ।