বৈচিত্র্য ও সৃষ্টির নানা চমক নিয়ে কলকাতাসহ গোটা পশ্চিমবঙ্গের নানা প্রান্তে শুরু হয়েছে দুর্গা পুজো। নতুন নতুন ভাবনা নিয়ে গড়া হয়েছে পুজামন্ডপ আর দেবীর প্রতিমা। সব ধর্মের মানুষের মিলিত ঐতিহ্যে এবারও কলকাতা শহরেই পুজোর সংখ্যা কয়েক হাজার ছাড়িয়ে গিয়েছে। এবার অবশ্য পুজো উপলক্ষ্যে কঠোর নিরাপত্তার ব্যবস্থা করেছে কলকাতা পুলিশ। এমনকি সেনাবাহিনী ও জাতীয় গোয়েন্দা সংস্থা এনআইএ-র নজরদারি চালাচ্ছে। দীর্ঘদিন ধরে চলে আসা সাবেকিয়ানা বনাম আধুনিক থিম পুজোর লড়াই এবার আরও তীব্র হয়েছে। সাবেকি বাড়ির পুজোতে যেমন এখনো নীলকণ্ঠ পাখি উড়িয়ে মা পার্বতীকে আবাহন করে আনার রেওয়াজ টিকিয়ে রাখা হয়েছে তেমনি থিম পুজোতে এখন চালু হয়েছে থিম সংয়ের প্রতিযোগিতা। কোনও কোনও পুজো কমিটির থিম সং লিখেছেন খোদ মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। বিষয় বৈচিত্র্যে থিম পুজো এখন আর শুধু কলকাতাতেই আটকে নেই। জেলা শহরেও চলছে প্রবল প্রতিযোগিতা। গত বছর কলকাতায় ৮০ ফুট উচ্চতার দুর্গা প্রতিমা তৈরি যে চমক দিয়েছিল কলকাতার দেশপ্রিয় পার্ক পুজো কমিটি তারাই এবার দশভুজার পরিবর্তে সহস্রভুজাকে আবাহন জানিয়ে সাড়া ফেলে দিয়েছে। গত বার অবশ্য ভিড়ে পিষ্ট হয়ে যাবার সম্ভাবনায় সেই পুজো দর্শন বন্ধ করে দিয়েছিল পুলিশ। এবারও প্রবল আগ্রহ আর কৌতুহল এই পুজোকে কেন্দ্র করে। আবার ওপার বাংলার সংস্কৃতির প্রতিফলন ঘটেছে উত্তর কলকাতার তেলেঙ্গাবাগানের পুজোতে। ওপার বাংলার বর্ষবরণের সঙ্গে যুক্ত সংস্কৃতিকেই আপন মগ্নতায় তুলে ধরা হয়েছে এই মন্ডপে। ভাবনার বৈচিত্র্যে সারা পৃথিবীর মধ্যে একমাত্র দুর্গা পুজোতেই সবচেয়ে বেশি। নানা ভাবনা আর নানা সৃষ্টিধর্মী মন্ডপ এবং প্রতিমা তৈরি হয়েছে কলকাতা ছাড়িয়ে গ্রাম বাংলাতেও। উইলিয়াম শেক্সপিয়াররের নাটক এবং সৃষ্টিকে এবার থিম করেছে কলকাতার দুটি পুজো মন্ডপ। শ্রীভূমি পুজো কমিটি থিম করেছে পুরীর জগন্নাথ মন্দিরকে। উত্তর কলকাতার সিঁিথতে উঠিয়ে আনা হয়েছে মহীশূর প্রাসাদকে। আরও অনেক প্রাসাদ ও মন্দিরের অনুকরণে তৈরি হয়েছে মন্ডপ। মাদাম তুসোর মোমের মিউজিয়ামকে থিম করেছে দক্ষিণ কলকাতার একটি পুজো কমিটি। মেক্সিকো সংস্কৃতির ভাবধারায়ও মন্ডপ তৈরি হয়েছে। মাদার তেরেসার সন্ত হওয়াকে থিম করে মন্ডপ তৈরি করেছে নাকতলা উদয়ন সংঘ। কলকাতার ঐতিহ্যবাহী কলেজ স্কোয়ারের এবারের পুজোর থিম রিও অলিম্পিক্সের জিমনাস্টিক্সে চতুর্থ হওয়া বাঙালি জিমন্যাস্ট দীপা কর্মকারের প্রোদুনোভা ভল্টকে। পুজামন্ডপে হাজির একটি গোটা ট্রেন। লোকাল ট্রেনের ধাঁচে তৈরি করা হয়েছে মন্ডপটি। কলকাতার পদ্মপুকুরের মন্ডপ তৈরি হয়েছে সিকিমের প্যাগোডার ধাঁচে। অকাল বোধনকে থিম করেছে খিদিরপুর ভেনাস ক্লাব। তামিলনাড়–র মীনাক্ষী মন্দির বানিয়েছে এবার কলকাতার একডালিয়া ক্লাব। হাতিবাগান নবীন পল্লীর এবারের পুজোর থিম রাজস্থানের কাবার্ড শিল্প। যোধপুর পার্কের থিম এবার এক টুকরো শান্তির গ্রাম। নাকতলা আষাঢ় সংঘ মন্ডপ বানিয়েছে ইটের টুকরো দিয়ে। আবার সন্তোষপুরের লেক পল্লির ১২ ফুটের দুর্গা প্রতিমা তৈরি হয়েছে সোনার পাতে মুড়িয়ে। সখেরবাজার বড়িশা ক্লাবের থিম এবার ’ধংসের হাত থেকে পৃথিবীকে রক্ষা’। সভ্যতার বিবর্তনকে এবার থিম করেছে একর্টি পুজো কমিটি। আবার ঠাকুরমা’র ঝুলির নানা গল্প নিয়ে তৈরি হয়েছে একটি পুজো মন্ডপ। নদীকেও থিম করেছে একটি পুজো কমিটি। থিমের এই বৈচিত্র্যের পাশাপাশি রয়েছে আলোর খেলা। এলইডি আলোর যাদুতেও ভেসেছে প্রতিটি পুজো মন্ডপ। আর এ সবের আকর্ষণে কলকাতায় ছুটে এসেছেন ভিন রাজ্যের মানুষ। এমনকি বাংলাদেশ থেকেও এসেছেন অনেকে কলকাতার পুজোর বৈচিত্র্যের স্বাদ নিতে।