মোস্তফা কামাল : বিশ্বের সব দেশেই শিশু অধিকার নিয়ে আলোচনা হলেও প্রায় সব দেশেই কম বেশি শিশু নির্যাতনের ঘটনা ঘটছে নিয়মিত। সংবিধানে সব ধর্ম বর্ণের শিশুদের অধিকার নিশ্চিত করার কথা বলা থাকলেও আমরা তা কতটুকু নিশ্চিত করতে পেরেছি এটাই দেখার ব্যাপার। উন্নত রাষ্ট্র গুলোর তুলনায় আমাদের মতো উন্নয়নশীল রাষ্ট্রে শিশু নির্যাতনের ঘটনা বেশিই ঘটছে। প্রথমত আমাদের দেশের শিশুরা গৃহ, কর্মত্রেসহ বিভিন্ন ভাবে নির্যাতিত হচ্ছে। ঘুম থেকে ওঠে কাগজে চোখ রাখলেই গৃহপরিচারিকাদের উপর নির্মম নির্যাতনের কথা প্রায়ই প্রকাশিত হয়। আমাদের নৈতিকতার উন্নতি, বিবেক বোধের উন্নয়ন না হওয়া, আইনের যথাযথ প্রয়োগ না হওয়ায় এ থেকে পরিত্রানের উপায় নেই। তাই আমাদের আইনের যথাযথ ভাবে প্রয়োগ জরুরী। শিশুদের বিনোদনের জন্য গ্রামাঞ্চলের কোথাও কোথাও খেলার মাঠ থাকলেও শহরের অধিকাংশ বিদ্যালয়ে খেলার মাঠ নেই। ফলে বিনোদনসহ মনোবিকাশের যথেষ্ট সুযোগ থেকে বঞ্চিত হচ্ছে শিশুরা। শিশুদের নিয়ে বিভিন্ন সংগঠন কাজ করছে। শিশু অধিকার সুরায় বিশ্বব্যাপী কাজ করছে সেভ দ্য চিলড্রেন। শিশুদের প্রতি শোষণ, বঞ্চনা, অপব্যবহার, সহিংসতা রোধ সর্বোপরি কিভাবে তাদের রা করা যায় এ ব্যাপারে ১৯৮৯ সালের জাতিসংঘ শিশু অধিকার সনদে বিস্তারিত উল্লেখ রয়েছে। সেভ দ্য চিলড্রেন শিশুদের বহুমুখী নির্যাতন, শোষণ, অবহেলা ও বৈষম্য প্রতিরোধে কমিউনিটি থেকে সর্বত্র কাজ করে আসছে। সময়ের পথ পরিক্রমায় শিশুরাই কিশোর- কিশোরী, যুবক- যুবতী, প্রাপ্ত বয়স্ক- বয়স্কা নর নারীতে পরিণত হয়। শিশুরা ক্যচ্যুত হয়ে পা বাড়ায় ভূল পথে। প্রযুক্তির উন্নতির ফলে আজকের শিশুরা সাইবার বা কাল্পনিক জগতে প্রবেশ করছে। অনেক শিশু অনৈতিক বিষয়ের সাথে যুক্ত হয়ে মূল্যবোধের চরম অবয় ঘটাচ্ছে। অনেকে বন্ধুদের এ পথে নিয়ে আসছে। এ ছাড়া শিশুরা অতিমাত্রায় পর্ণোগ্রাফিতে ঝুঁকছে। শিশুরা প্রতিদিন মোবাইল ফোনে কোটি কোটি টাকার পর্ণোগ্রাফি ডাউনলোড করছে। তারা বিদ্যালয়ে, খেলার মাঠে, বন্ধুদের সাথে অবসরের আড্ডায় এসব পর্নোগ্রাফি উপভোগ করছে। এমনকি উঠতি বয়সের শিশুরা বিভিন্ন প্রকার মাদক সেবন করছে প্রতিদিন। মাদক দ্রব্য বিক্রির সাথেও জড়িয়ে পরছে অনেকে। দারিদ্রতার কারণে অনেক শিশুরা যুক্ত হচ্ছে শ্রম বিক্রির সাথে। মালিক প কাজের যথাযথ পরিবেশ করে না দিলেও শিশু শ্রমিককে কম বেতনে নির্ধারিত সময়ের চেয়ে বেশি পরিশ্রম করানো হচ্ছে। শিশুরা গৃহ, দোকান পাট, যানবাহনের কাজ এমনকি ওয়েল্ডিং এর মতো ঝুঁকিপূর্ণ কাজ ও করছে। মধ্য প্রাচ্যের দেশ গুলোতে আমাদের মতো দরিদ্র দেশের শিশু শ্রমিকদের উটের জকি হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছে। বাধ্যতামূলক প্রাথমিক শিা বাস্তবায়নের ল্েয শিশুদের বেতন মওকুফ, ফ্রি বই প্রদান করা হলেও শিা গ্রহন থেকে ঝড়ে পরা বিপুল সংখ্যক শিশু লেখা পড়া শেষ করতে পারছে না। যে সব শিশু ঝড়ে পরছে তাদের সুরায় উদ্যোগ গ্রহন করা হচ্ছে না। অনেক মেয়ে শিশু পরিবারের মা বোন খালা ফুফু দের দেখে শুনে অর্থ উপার্জনের জন্য, পরিবারকে সহায়তা করার জন্য নোটারী পাবলিকের মাধ্যমে বয়স বেশি দেখিয়ে প্রত্যয়ন নিয়ে যৌন কর্মী হিসেবে খদ্দেরের মনো রঞ্জন করছে। অসচেতন পরিবারের প্রধানরা সংশ্লিষ্ট ইউনিয়ন পরিষদ অথবা পৌরসভার চেয়ারম্যানকে ম্যানেজ করে অপ্রাপ্ত বয়স্ক ছেলে মেয়েদের প্রাপ্ত বয়স্ক দেখিয়ে জন্মসনদ নিয়ে বসিয়ে দিচ্ছেন বিয়ের পিঁড়িতে। অনেক েেত্র বিয়ে রেজিষ্ট্রি না করে মৌলভী ডেকে কলেমা পড়িয়ে ছেলে মেয়েদের বিয়ে দিয়ে সংসার করাচ্ছেন। পরে সুযোগ সুবিধা মতো সময়ে রেজিষ্ট্রি করাচ্ছেন। শিশু অপরাধ, কিশোর অপরাধ এবং বয়স্ক অপরাধীদের মধ্যে বয়সের তফাৎ থাকলেও তাদেরকে একই হাজত খানায় রাখা হয়। হাত কড়া পড়িয়ে জেল খানায় আনা নেয়া করা হয়। ফলে অপ্রাপ্ত বয়স্ক শিশুদের মনে বিরুপ প্রতিক্রিয়ার জন্ম হয়। অনেক েেত্র অস্বচ্ছল অসচেতন মা বাবা অধিক সংখ্যক সন্তান জন্ম দিয়ে তাদের লালন পালন করতে পারেন না। কেবল মাত্র পরিবারকে স্বচ্ছল করতে তাদেরকে পিতার কাজে সহায়তা করতে হয়। আর এসব পিতা মাতাও তাদের সন্তানকে শ্রমে নিযুক্ত করে নিজেদের আয়ের হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করেন। সংসারে বাড়তি স্বচ্ছলতার আশায় পিতা মাতা অনেকটা নিরুপায় হয়ে যান। যা হোক পারিবারিক আর্থিক অস্বচ্ছলতা যে শিশু শ্রমের প্রধান কারণ তা বলার অপো রাখেনা। শিশু বান্ধব পরিবেশ গড়তে আমাদের করণীয় হলো, সব পিতা মাতার উচিত শিশুদের প্রতি সব সময় নজর রাখা। তারা কোথায় যাচ্ছে কার সাথে মিশছে খোঁজ খবর রাখা এবং তারা বিপথগামী হলে তাদেরকে ভয়ভীতি না দেখিয়ে বুঝিয়ে সঠিক পথে ফিরিয়ে আনা। সাইবার অপরাধ, পর্ণোগ্রাফী, মাদকাসক্ত এসব বিষয়ে শিশু পিতামাতাকে এড়িয়ে যাবার চেষ্টা করবে এটাই স্বাভাবিক। ঝুঁকিপূর্ণ কাজ থেকে শিশুকে বিরত রাখতে হবে, শিশুদের মধ্যে বিদ্যমান অসমতা দূর করতে হবে। শিশুদের কাজেন নূন্যতম বয়সসীমা নির্ধারণ করতে হবে এবং তা যথারীতি মেনে চলতে হবে। এেেত্র আইন কমিশনকে হতে হবে আরো বেশি সচেতন। প্রয়োজনে নতুন আইন তৈরী করে বাস্তব েেত্র তার প্রয়োগ করতে হবে এবং আইন অমান্যকারীদের শাস্তির আওতায় আনতে হবে। বাল্য বিবাহ প্রতিরোধে অভিভাবক, ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান, সদস্য, কাজী, আইন প্রয়োগকারী সংস্থাসহ প্রশাসনের কর্তা ব্যক্তিদের যথাযথ ভূমিকা রাখতে হবে। বিশেষত ইউনিয়ন পরিষদের সদস্য ও চেয়ারম্যানদের সহায়তায় বাল্য বিয়ে বেশি সংঘটিত হয়ে থাকে। তাদের মধ্যে অনেকে জন্ম নিবন্ধন বহিতে কাটাকুটি করে অথবা ফুইড মেরে বয়স বাড়িয়ে কমিয়ে দিয়ে এ কাজে সহায়তা করে থাকে। পাশাপাশি অপ্রাপ্ত বয়স্করা নোটারী পাবলিকের সামনে হাজির হয়ে নিজেদের প্রাপ্ত বয়স্ক দাবী করে হলফনামা দিয়ে প্রাপ্ত বয়স্ক হয়ে যাচ্ছে। নৈতিকতার কারণে এটিও রুখতে হবে। নোটারী পাবলিক অথবা বিয়ের েেত্র ভোটার হওয়া আবশ্যক করলে এ সংকট কিছুটা হলেও কাটিয়ে ওঠা যেতে পারে। অপ্রাপ্ত বয়স্ক ছেলে মেয়েদের কোন ভাবে বিয়ে হয়ে গেলে তারা অবাধে মেলামেশা করলে তাদের যতই আইনের আওতায় আনা হোক না কেন বিবাহ বিচ্ছেদ ঘটানো কিন্তু সম্ভব হচ্ছে না। আর এ সুযোগটাই গ্রহন করছে তারা। অভিভাবক সচেতনতা, স্কুল ফিডিং কর্মসূচী জোড়দার, শিশু বান্ধব বিচার ব্যবস্থা, শিশুদের সাথে বন্ধুসুলভ আচরণ করে তাদের কিছুটা হলেও আমরা রা করতে পারি। জাতীয় বাজেটে শিশুদের জন্য বরাদ্দ বাড়িয়ে তা শিশু কল্যানে ব্যয় করা যেতে পারে। শহর থেকে শুরু করে গ্রামের পাড়া মহল্লা পর্যন্ত সচেতনা তৈরীর ল্েয সভা করে জনসচেতনতা বাড়িয়ে শিশুদের সুরার পথকে আমরা বিস্তৃত করতে পারি। সর্বোপরি রাষ্ট্রের পাশাপাশি পরিবার শিশু সুরায় সবচেয়ে বেশি ভূমিকা রাখতে পারে।