নোয়াখালীর হাতিয়া পৌরসভার ৫ নং ওয়ার্ডের বাসিন্দা তিন সন্তানের জননী শাহানারাকে নির্যাতনের ঘটনায় অবশেষে মামলা নিয়েছে থানা পুলিশ। ঘটনার ছয়দিন পর শনিবার ভোর ৫টায় মামলাটি নথিভুক্ত (মামলা নং জি আর-১১৬) করা হয়। এমন চাঞ্চল্যকর ঘটনায় গড়িমসি করে মামলা নেওয়ায় পুলিশের বিরুদ্ধেই অপরাধীদের প্রশ্রয় দেওয়া অভিযোগ ওঠেছে।
স্থানীয় রাজনৈতিক নেতাদের সঙ্গে ঘনিষ্ট যোগাযোগ থাকায় অভিযুক্ত ব্যক্তির বিরুদ্ধে মামলা নিতে পুলিশ গড়িমসি করে বলে অভিযোগ রয়েছে। ভুক্তভোগী নারীকে যথাসময়ে আইনী আশ্রয় না দিয়ে উল্টো নেওয়া হয়েছে উৎকোচ।
এই বিষয়ে জানতে চাইলে হাতিয়া থানার ওসি এটিএম আরিছুল হক জানান, শাহানারাকে নির্যাতন করায় ইতিমধ্যে মামলা হয়েছে। তারা আসামিকে গ্রেফতারের জন্য অভিযান অব্যাহত রেখেছেন। তিনি বলেন, ইতিমধ্যে আসামির মোবাইল ফোনের নেটওয়ার্কের মাধ্যমে প্রাথমিক অবস্থান নিশ্চিত হওয়া গেছে। শাহাজাহানের পেশা ও সামজিক পরিচয়ের বিষয়ে জানতে চাইলে এই পুলিশ কর্মকর্তা বলেন, এরা দুর্বৃত্ত, এদের কোনো সামাজিক পরিচয় নেই। শাহাজাহান থানার দালাল কী-না জানতে ওসি বলেন, আগে ছিলো কী-না তা তার জানা নেই। তবে তিনি যোগদানের পর কখনো শাহাজানকে থানায় দেখেন নাই।
সোমবার বিকেলে হাতিয়ায় প্রকাশ্যে মাটিতে ফেলে শাহানারাকে পিটিয়েছেন। থানার দালাল হিসেবে পরিচিত শাহজাহান এ ঘটনা ঘটান।চাঁদা না দেয়ায় তিরিশোর্ধ এ নারীকে পেটানো হয় বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে।
শাহানারা জানান, তাকে বিবস্ত্র করে পেটানো হয়েছিল দুইধাপে। প্রথম ধাপের ঘটনাটি একজন যুবক মোবাইল ফোনে ধারণ করে। কিন্তু দ্বিতীয় চিত্রটি সম্ভব হয়নি। সেদিন তাকে প্রথম ধাপে পেটানো হয় মুন্নি নামে শাহাজাহানের এক আত্মীয়ের বাসার সামনের রাস্তায়। শাহজাহান তাকে লাঠি পেটা করার পর লাথি মেরে রাস্তা থেকে পাশের খাদে ফেলে দেন। সেখানে কয়েকজন আটকানোর চেষ্টা করলেও তিনি (শাহজাহান) আরো অগ্নিমূর্তি ধারণ করেন। লাঠির আঘাতে একসময় জ্ঞান হারান শাহানা।
জ্ঞান ফিরে তিনি নিজেকে একটি হালকা অন্ধকার ঘরে বিবস্ত্র অবস্থায় দেখেন। তখন সামনে শাহজাহান ছাড়া আর কেউ ছিলো না। তিনি তাকে শ্লীলতাহানির চেষ্টাও চালান। শরীরের বিভিন্ন স্থানে কামড় দেয়। স্পর্শকাতর স্থানগুলো থেকে রক্ত বের হতে থাকে। পরে স্থানীয় লোকজন জড়ো হতে থাকলে তাকে ছেড়ে দিতে বাধ্য হয় শাহজাহান। ওই বাড়িটি শাহজাহানের এক আত্মীয়ের বাড়ি ছিল।
দুই মিনিট এক সেকেন্ডের ভিডিওতে দেখা যায়, ওই নারীকে পড়ে আছেন নির্মাণাধীন রাস্তার পাশের গর্তে। রাস্তার ওপর মানুষের হালকা জটলা। একজন এসে লাঠি দিয়ে গর্তে পড়ে থাকা নারীকে পেটাতে শুরু করে। সাদা কালো আর ধূসর রংয়ের ডোরাকাটা গেঞ্জি গায়ে ও কালো পেন্ট পরা ওই ব্যক্তিকে কেউ বাধা দেওয়ার সাহস পাচ্ছে না। সবাই রাস্তায় দাঁড়িয়ে গর্তে পড়ে থাকা নারীকে নির্মম ভাবে পেটানোর দৃশ্য দেখছেন। সাহস করে এক কিশোর এগিয়ে গিয়ে রক্ষার চেষ্টা করলেন। কিন্তু তাতেও থামছে না নারীর ওপর ক্রোধ। কিছুক্ষণ পরে আরো দুজন এগিয়ে এসে পাষণ্ড লোকটির হাত থেকে রক্ষা করলেন নারীকে।
নির্যাতনের শিকার শাহানারা জানান, নিজের স্বামীর সঙ্গে বিবাহ বিচ্ছেদ ঘটানোর খবর পেয়ে ত্রিশ হাজার টাকা চাঁদা দাবি করে শাহজাহান। সে এর আগেও শাহানারার ঘর নির্মাণের সময় ১৪ হাজার টাকা চাঁদা নেয়। সর্বশেষ দাবি করা ত্রিশ হাজার টাকা চাঁদা না পেয়ে দফায় দফায় শারীরিক ভাবে লঞ্ছিত করা হয় তাকে।
ঘটনার দিন গত সোমবার বিকেলে শাহানাকে হঠাৎ করে পেছন থেকে এসে তিন চারটি ঘুষি মারে শাহজাহান। এরপর এলোপাথাড়ি মারতে থাকে। সজ্ঞা হারিয়ে শাহানা নির্মাণাধীন রাস্তার পাশে গর্তে পড়ে যান। সেখানেও তার ওপর হামলা করা হয়। এরপর তাকে রাস্তা থেকে তুলে নিয়ে একটি বন্ধ কক্ষে বিবস্ত্র করে পেটানো হয় বলেও অভিযোগ করেছেন শাহানা। এসময় ছিনিয়ে নেওয়া হয় তার সঙ্গে থাকা নগদ তিন লাখ টাকা ও গলার স্বর্নের চেইন। সজ্ঞাহীন শাহানারার চিকিৎসাধীন অবস্থায় হাসপাতলে বসানো হয় পাহারা। নির্যাতনের জন্য মামলা করা হবে না এমন স্বীকারোক্তি ও দুটি রঙ্গিন খালি কাগজে স্বাক্ষর নেওয়া হয়।
এই ঘটনায় শুক্রবার মধ্যরাত পর্যন্ত মামলা নিতে গড়িমসি করে হাতিয়া থানা পুলিশ। গণমাধ্যমে নির্যাতনের ভিডিও প্রকাশের পর শুক্রবার রাতে একটি দায়সারা অভিযোগ গ্রহন করলেও শনিবার মামলা রুজু করা হয়। শাহজাহানের নামে মামলা না নিতে থানায় গিয়ে পৌরসভার মেয়র তদবির করেছেন বলেও অভিযোগ পাওয়া গেছে। এ বিষয়ে জানতে ফোন ও ক্ষুদে বার্তা দিয়েও মেয়র এ কে এম ইউসুফ আলীর কোনো সাড়া মেলেনি।