মধ্যপ্রাচ্যে কর্মরত বাংলাদেশী গৃহকর্মীদের সুরক্ষা উন্নত করতে সরকারের প্রতি আহ্বান জানিয়েছে প্রখ্যাত মানবাধিকার সংস্থা হিউম্যান রাইটস ওয়াচ (এইচআরডব্লিউ)। ১০ থেকে ১২ ডিসেম্বর ‘গ্লোবাল ফোরাম অন মাইগ্রেশন অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট’ অনুষ্ঠিত হবে বাংলাদেশে। এ সম্মেলনে মাইগ্রেশন নীতি নিয়ে নিজেদের ভাবনা শেয়ার করে বিভিন্ন দেশের সরকার। এইচআরডব্লিউর প্রতিবেদনে বলা হয়, মধ্যপ্রাচ্যে গৃহকর্মীদের চাহিদার যোগান দিয়ে থাকে বাংলাদেশ। কিন্তু এ কর্মীদের অধিকার সুরক্ষায় বাংলাদেশ ব্যর্থ হচ্ছে। তাদের মজুরীও নির্ধারন করা হচ্ছে সামান্য। ইন্দোনেশিয়া, শ্রীলঙ্কা ও নেপালের মতো দেশও গৃহকর্মী যোগান দিয়ে থাকে মধ্যপ্রাচ্যে। কিন্তু তারা তাদের গৃহকর্মীদের নির্যাতনের বিষয়ে কড়া প্রতিক্রিয়া দেখিয়েছে। তাদের সুরক্ষা বাড়িয়েছে। মজুরীর দাবিও বৃদ্ধি করেছে।
এইচআরডব্লিউর মধ্যপ্রাচ্যের নারী অধিকার বিষয়ক গবেষক রোথনা বেগম বলেন, ‘অভিবাসন বিষয়ে গুরুত্বপূর্ণ একটি বৈশ্বিক সম্মেলন আয়োজন করছে বাংলাদেশ। অথচ, নিজ নাগরিকদের সুরক্ষায় দেশটির রেকর্ড বেশ নাজুক। নিজ কর্মীদের জন্য সেরা সুযোগ খুঁজে বের করা উচিত বাংলাদেশের। কিন্তু তাদেরকে অর্থপূর্ণ সুরক্ষা ছাড়া পরিত্যাগ করার বিনিময়ে নয়।’ সাম্প্রতিক বছরগুলোতে, মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোর জন্য নারী গৃহকর্মী নিয়োগ বৃদ্ধি করেছে বাংলাদেশ। জর্দান ও সৌদি আরবের সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় চুক্তিও করেছে দেশটি। বর্তমানে লাখো বাংলাদেশী নারী মধ্যপ্রাচ্যে অবস্থান করছে। শুধুমাত্র এ বছরের জানুয়ারি থেকে অক্টোবরের মধ্যেই এদের মধ্যে ১ লাখেরও বেশি নারীকে সেখানে পাঠানো হয়েছে।
প্রতিবেদনে বলা হয়, মধ্যপ্রাচ্যের আইন ও পলিসি অভিবাসী গৃহকর্মীদের নির্যাতন ও শোষণে সুবিধা করে দেয়। নিয়ন্ত্রণমূলক কাফালা সিস্টেমে অভিবাসীও গৃহকর্মীদের ভিসা তাদের নিয়োগদাতাদের সঙ্গে যুক্ত করে দেওয়া হয়। এ পদ্ধতি মধ্যপ্রাচ্যে ব্যাপকহারে প্রচলিত। এর ফলে বর্তমান নিয়োগদাতার অনুমতি ছাড়া নতুন কারও জন্য কাজ করতে পারে না ওই কর্মী। এমনকি নিয়োগদাতা নির্যাতন করলেও চাকরি পাল্টানোর নিয়ম নেই। ওমান সহ মধ্যপ্রাচ্যের অনেক দেশ আবার গৃহকর্মীদের শ্রম আইনের সুরক্ষা থেকে বাদ রেখেছে। আর যেসব দেশে কিছু নিয়মনীতি আছে, সেখানেও সুরক্ষা খুব কমই।
তবে অনেক গৃহকর্মীর নিয়োগদাতাই তাদের অধিকার সম্পর্কে সচেতন ও তারা তা মেনেও চলেন। কিন্তু অন্য কর্মীরা গুরুতর নির্যাতন ও শোষণের শিকার হন। এর মধ্যে রয়েছে শারীরিক নির্যাতন, বেতন পরিশোধ না করা, পাসপোর্ট জব্দ করে রাখা যাতে তারা কোথাও যেতে না পারেন।
এ বছরের জুলাইয়ে হিউম্যান রাইটস ওয়াচ একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করেছিল। এতে ওমানে অভিবাসী গৃহকর্মীদের বিরুদ্ধে নির্যাতনের বিষয়টি তুলে ধরা হয়। গৃহকর্মীদের সঙ্গে ৫৯টি সাক্ষাৎকারের ভিত্তিতে ওই প্রতিবেদন তৈরি করা হয়েছিল। এদের অনেকেই ছিলেন বাংলাদেশের। প্রায় প্রত্যেক বাংলাদেশী নারীই জানিয়েছেন, নিয়োগদাতা তাদের পাসপোর্ট জব্দ করে রেখেছেন। অনেকে বলছেন, তাদেরকে পুরো মজুরী পরিশোধ করা হয় না। ছুটি বা বিরতি ছাড়াই দীর্ঘক্ষণ তাদেরকে কাজ করানো হয়। অনেককে দেওয়া হয় না পর্যাপ্ত খাবার ও থাকার সুযোগ। কেউ কেউ জানান নিয়োগদাতারা তাদের শারীরিকভাবে লাঞ্ছিত করেছেন। দু’-একজন যৌন নির্যাতনের অভিযোগও এনেছিলেন।
ওমানে হিউম্যান রাইটস ওয়াচ যত ঘটনা তদন্ত করেছে, তার মধ্যে সবচেয়ে গুরুতর একটি বিষয় ছিল বাংলাদেশী শ্রমিকদের বর্ণনা। জোরপূর্বক কাজ করানো ও মানবপাচারের ঘটনাও লিপিবদ্ধ হয়। ‘আসমা কে’ নামে এক বাংলাদেশী বলেন, তিনি বাংলাদেশে এক এজেন্টকে ৭৫০ ডলার পরিশোধ করেন আরব আমিরাতে কাজ পাওয়ার আশায়। কিন্তু আমিরাতের রেক্রুটমেন্ট এজেন্ট তাকে ‘বিক্রি’ করে দেয় এক ব্যক্তির কাছে, যে কিনা তার পাসপোর্ট জব্দ করে তাকে নিয়ে যান ওমানে। ওই লোক তাকে প্রতিদিন ২১ ঘন্টা করে খাটাতেন। তার পরিবারের সদস্যসংখ্যা ১৫ জন। তাকে কোন বিরতি দেওয়া হতো না। ছিল না কোন ছুটি। অনেকসময় খাবার থেকে বঞ্চিত থাকতেন। মৌখিকভাবে তাকে গালাগাল করা হতো। ওই ব্যক্তি তাকে যৌন নিগ্রহও করেছেন। এক পর্যায়ে তার পুরো মজুরি পরিশোধই বন্ধ করে দেওয়া হয়। এক পর্যায়ে দেশত্যাগের আবেদন করেন ওই নারী। এরপর তার নিয়োগদাতা তাকে এক এজেন্সির কাছে পাঠায়। কিন্তু ওই এজেন্সি তাকে ৫০ বার বেত্রাঘাত করে।
হিউম্যান রাইটস ওয়াচের প্রতিবেদনে বলা হয়, বাংলাদেশের উচিত বিদেশী কর্মরত নিজ শ্রমিকদের জন্য সর্বোচ্চ সুরক্ষা প্রদান করা। এর মধ্যে থাকতে পারে, নিজ দেশের রিক্রুটমেন্ট এজেন্টদের ওপর তত্বাবধান বৃদ্ধি, বিভিন্ন দেশে কর্মরত শ্রমিকদের জন্য সুরক্ষার প্রস্তাব দেওয়া, ও দুর্দশায় থাকা কর্মীদের সহায়তা করা।
মধ্যপ্রাচ্যের বেশিরভাগ সরকারই অভিবাসী শ্রমিকদের কাছ থেকে রিক্রুটমেন্ট ফি নেওয়া নিষিদ্ধ করেছে। অপরদিকে বাংলাদেশ লাইসেন্সকৃত রিক্রুটারদের জন্য ওই সুযোগ অবারিত রেখেছে। ওই রিক্রুটাররা ২০ হাজার টাকা পর্যন্ত আদায় করতে পারে। কিন্তু অনেক বাংলাদেশী নারী হিউম্যান রাইটস ওয়াচকে ওমানে বলেছেন যে, তারা এক লাখ টাকা পর্যন্ত পরিশোধ করেছেন। আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থার একটি গবেষণায় দেখা গেছে যে, সাব-এজেন্টদের একটি শৃঙ্খলের (চেইন) মাধ্যমে গৃহকর্মীদের রিক্রুট করা হয়। রিক্রুটমেন্ট ফি, উচ্চমাত্রার সুদের হার, আর কম বেতন বা বেতনহীন কর্ম Ñ সব কিছু মিলিয়ে শ্রমিকরা পড়ে যেতে শোষণের চক্রে আটকা পড়তে পারে। কারণ, শ্রমিকরা টাকা জোগাড় করে ঋণ পরিশোধের তাড়নায় কষ্ট করে হলেও থেকে যেতে চায়।
এইচআরডব্লিউ লিখেছে, বাংলাদেশের উচিত এমন প্রক্রিয়া সৃষ্টি করা যার মাধ্যমে গৃহকর্মীরা বিদেশী মিশনে বা দেশে ফিরে এজেন্টদের প্রতারণা, বাড়াবাড়ি ও নির্যাতনের অভিযোগ দায়ের করতে পারে। বাংলাদেশের বিদেশে অবস্থিত মিশন বা সরকারের উচিত এসব অভিযোগ তদন্ত করা ও অভিযোগ প্রমাণ সাপেক্ষে সাব-এজেন্ট বা রিক্রুটারদের নির্যাতনের দায়ে নিষিদ্ধ করা।
গৃহকর্মীদের জন্য কেবল কুয়েতেই ন্যুনতম মাসিক বেতন নির্ধারন করা হয়েছে ৬০ কুয়েতি দিনার বা ২০০ ডলার। এর বাইরে মধ্যপ্রাচ্যের কোন দেশই গৃহকর্মীদের ন্যুনতম মজুরী নির্ধারণ করেনি। অন্যান্য দেশগুলোর দূতাবাস নিজ গৃহকর্মীদের নিয়োগদাতাকে মাসিক ন্যুনতম বেতনে রাজি হতে বাধ্য করে। কিন্তু বাংলাদেশের বেলায় এ বেতন সর্বনিু : মাত্র ১৬ হাজার টাকা। ফিলিপাইন এক্ষেত্রে সর্বোচ্চ ৪০০ ডলার (প্রায় ৩৫ হাজার টাকা) দাবি করে। রিক্রুটমেন্ট এজেন্সিগুলো নিজেদের বিজ্ঞাপনে বিভিন্ন দেশভেদে গৃহকর্মীদের বেতনে তারতম্য দেখায়। অর্থাৎ, এ ক্ষেত্রে দক্ষতা বা অভিজ্ঞতা আমলে নেওয়া হয় না। গৃহকর্মীদের জাতীয়তাই তাদের বেতন নির্ধারণ করে। ফলে এটি বর্ণ বা জাতীয়তার ভিত্তিতে বৈষম্য সৃষ্টি করে।
গৃহকর্মীদের জন্য ন্যুনতম বেতন বৃদ্ধি করা উচিত বাংলাদেশের। এমন পদ্ধতি সৃষ্টি করা উচিত যাতে ন্যুনতম বেতন ও অন্যান্য সুবিধা আদায় করা সম্ভব হয়। যেমন, উপসাগরীয় দেশগুলোতে অবস্থিত ভারতীয় দূতাবাসগুলো একটি নিয়ম সৃষ্টি করেছে। এ নিয়মের আওতায়, ভারতীয় গৃহকর্মী নিতে হলে নিয়োগদাতাকে ফেরতযোগ্য নিরাপত্তা ডিপোজিট হিসেবে ৩০০০ ডলার জমা রাখতে হয়। যদি নিয়োগদাতা নির্যাতন করে বা বেতন না দেয়, সেক্ষেত্রে এই অর্থ ওই কর্মীর বকেয়া পরিশোধ ও ফেরার বিমান টিকেট ক্রয়ে ব্যবহৃত হয়।
ভারতের মতো বেশিরভাগ দেশের দূতাবাসই মধ্যপ্রাচ্যে নিজেদের গৃহকর্মীদের আশ্রয় দিয়ে থাকে। সহায়তা চাওয়া ও নিয়োগদাতার বিরুদ্ধে অভিযোগ দায়েরের সিদ্ধান্ত গ্রহণের সময়ও ওই কর্মীদের আশ্রয়ে রাখে দূতাবাস। কিন্তু বাংলাদেশের দূতাবাসগুলোর এই আশ্রয়ের সুবিধা রয়েছে অল্প কয়েকটি দেশে। আশ্রয়ের কোন সুবিধা না থাকায়, নির্যাতনকারী নিয়োগদাতার বাড়ি ছেড়ে চলে আসার পর নারীদের যাওয়ার জায়গাই থাকে না। দূতাবাসগুলোতে এমন কর্মীদের জন্য আশ্রয়ের সুবিধা ও সহায়তায় সামর্থ্য বৃদ্ধি নিশ্চিত করা উচিত বাংলাদেশের।
রোথনা বেগম বলেন, ‘সস্তা বেতন নির্ধারণ করা ও তেমন সুরক্ষা না দিয়ে, বাংলাদেশ সরকার শ্রমিকদের সম্ভাব্য নির্যাতনের দিকে ঠেলে দিচ্ছে। এ ক্ষেত্রে গৃহকর্মী সরবরাহকারী অন্যান্য দেশের সঙ্গে সমন্বয় করে ন্যুনতম মজুরী ও অন্যাম্য সুরক্ষা বা সুবিধা নির্ধারণ করা উচিত বাংলাদেশের।’
প্রতিবেদনে বলা হয়, বাংলাদেশের উচিত আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থার ‘ডোমেস্টিক ওয়ার্কার্স কনভেনশনে’ অনুস্বাক্ষর করা। এ চুক্তিতে সরবরাহকারী দেশ অভিবাসী গৃহকর্মীদের সুরক্ষা নিশ্চিতে অন্যান্য দেশকে সহযোগিতা করতে বাধ্য থাকে। একই সাথে নির্যাতন এবং রিক্রুটমেন্ট, স্থানান্তর ও কর্মসংস্থাকে প্রতারণার চর্চা বন্ধ করতে পদক্ষেপ নিতেও সরবরাহকারী দেশ বাধ্য থাকে। এই কনভেনশন ফিলিপাইন সহ ২৩টি দেশ অনুস্বাক্ষর করেছে।
গবেষক রোথনা বেগম আরও বলেন, ‘গৃহকর্মীদের আরও ভালোভাবে সুরক্ষা দিতে মধ্যপ্রাচ্যের সরকারগুলোর প্রতি তাদের আইন ও পলিসি সংস্কারের ডাক দেওয়া উচিত বাংলাদেশের। মধ্যপ্রাচ্যের পরিবারগুলোর জন্য রান্না, যতœ ও পরিচ্ছন্নতার কাজ করে অভিবাসী গৃহকর্মীরা। তাদের অধিকার সুরক্ষিত হওয়া উচিৎ।’