মামুনুর রশীদ রাজ, স্বদেশ এক্সক্লুসিভ,সম্পাদনায়-সাইমুর রহমান, স্বদেশ নিউজ টুয়েন্টিফোর ডটকমঃ অবহেলিত শব্দটি পথশিশুদের জীবনের সঙ্গে যেন কোনো না কোনোভাবে ওতপ্রোতভাবে জড়িত। জীবনের প্রতিটি অধ্যায়ে তারা বিভিন্ন ধরনের অবহেলা আর বঞ্চনার শিকার। রাস্তাঘাটে এক টাকা-দুই টাকার জন্য তারা পথচারীকে অনুরোধ করে নানাভাবে। কেউ কেউ আবার কাগজ কুড়ায়। তীব্র শীতের মধ্যেও তাদের প্রায়ই গরম কাপড় ছাড়া দেখা যায়, যা অমানবিক ও দুঃখজনক।
স্বাধীন দেশে এ পথশিশুদেরও সমান সুযোগ-সুবিধা নিয়ে বড় হওয়ার অধিকার আছে। খাদ্য, বস্ত্র, বাসস্থান, শিক্ষা, চিকিৎসা এ মৌলিক চাহিদাগুলো যথোপযুক্তভাবে পাওয়ার অধিকার তাদেরও আছে।
উন্নত দেশগুলোতে দেখা যায়, প্রত্যেকটি শিশুর দায়িত্ব রাষ্ট্র কোনো না কোনোভাবে পালন করে। বেশি খেয়াল রাখা হয় প্রত্যেক শিশুর সুস্থ জীবনযাপনের প্রতি। গড়ে দেওয়া হয় প্রত্যেক শিশুর ভবিষ্যৎ বিভিন্ন সুন্দর পদক্ষেপের মধ্য দিয়ে, কোনো শিশু যেন অবহেলার শিকার না হয়।
অথচ দুর্ভাগ্যের বিষয়, আশঙ্কাজনক হারে বাংলাদেশে বেড়ে চলেছে পথশিশুর সংখ্যা। মারাত্মক স্বাস্থ্যঝুঁকিতে দেশের ১০ লাখেরও বেশি পথশিশু। এদের বেশির ভাগই অপুষ্টি, যৌনরোগ ও মাদকের নেশায় আক্রান্ত। সর্বনাশা মাদকের বিষে আসক্ত হয়ে পড়ছে হাজার হাজার পথশিশু।
তবে শুধু যে এ সকল শিশু মাদকাগ্রস্ত তা নয়। এদের মধ্যে অনেকেই আবার বিভিন্ন সামগ্রী বিক্রিতে ব্যতিব্যস্ত। রাজধানীর শাহবাগ মোড় থেকে বিজয় সরণী হয়ে শ্যামলী শিশু পার্কে আসার পথে দেখা মিলবে এদের। বসন্ত আসতেই যেন ফুলের বাহারে ভরে ওঠে চারিদিক। মৌ মৌ গন্ধ বিলায় বসন্তের বাতাস। আর এ বসন্তকে মাথায় রেখেই অনেকেই নেমে পড়েন সিজনাল ফুল ব্যবসায়। আর তাদের এসব ফুল বিক্রিতে সাহায্য করে ছোট্ট এই পথশিশুরা। এদের কারো বাবা নেই, কারো নেই মা। কারো বা থাকলেও নানা কারণে আদর -আহ্লাদ থেকে বঞ্চিত হয়েছে এসব শিশু। বেঁচে থাকার তাগিদে, কেউ বা সংসারের হাল ধরতে এ বয়সেই নেমেছে জীবন যুদ্ধে।
রাজধানীর পান্থপথ মোড়েই দেখা মেলে সিজনাল ফুল ব্যবসায়ীদের বেশ কয়েকজনকে। ব্যস্ততম রাস্তার পাশেই বসেছেন গাঁদা – গোলাপের পসরা নিয়ে। কেউ মালা বানাচ্ছেন, কেউ আবার কয়েকটা ফুল নিয়ে আঁটি বাঁধছেন, কেউ গড়ছেন তোড়া।
আলাপচারিতায় জানা যায়, গোলাপের তোড়া সর্বনিম্ন ১০ টাকা এবং গাঁদাফুলের তৈরী মালা সর্বনিম্ন ২০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। ফুল বিক্রেতা কাশেম বলেন, এ বছর ফুল চাষীরা ভাল সুযোগ সুবিধা পাওয়ায় ফুলের উৎপাদন ভাল হয়েছে। অন্যান্য বছরের তুলনায় এ বছর তুলনামূলকভাবে পোকার আক্রমণ কম থাকায় আমরা চাষীদের থেকে ভাল ফুল বাজারে আনতে পেরেছি।
পথশিশু সুমাইয়ার মুখে আনন্দ ঢেউ খেলে অন্যদের থেকে বেশি বিক্রি করায়। শেফালী, রবিউল, শান্ত, কাকলী, ইলিয়াস সহ বেশ কয়েকজন মিলে ফুল বিক্রি করে ওরা। চলে বিক্রির প্রতিযোগিতা। সিগন্যালে গাড়ি দাঁড়াতেই শুরু হয় ওদের ব্যস্ততা। কে কার আগে দাঁড়াবে গাড়ির পাশে? হাসিমুখে কে বরণ করে নেবে ওদের? কে পূরণ করবে ওদের ছোট্ট আবদার?
প্রতি আঁটি গোলাপ বিক্রিতে ওরা পায় দুই টাকা আর গাঁদার মালায় পাঁচ টাকা। কিন্তু দিন শেষে ওদের এ সামান্য আয়েই খুশি ওরা। ছোট্ট হাতের আয় কেউ তুলে দিচ্ছে বাবার হাতে, কেউ বা মায়ের। কেউ সহযোগী হচ্ছে সংসারের ভরণ- পোষণের। যখন তার স্কুলে থাকার কথা, ঠিক সে সময় শিশুটি দারিদ্র্যতার কারণে পথে নামতে বাধ্য হয়েছে।
ওদের দেখলে স্বরচিত ‘কবিতা’ নামক কবিতার বেশ কয়েকটা লাইন মনে পড়ে যায়।
তুমি হতে পার বেইলী রোড বা সংসদে ফেরি করা ফুল বিক্রেতা শিশু।
যার হাতে থাকতে পারত চকচকে মলাটের চাররঙা ছাপা বই।
কিন্তু ; তার হাতে ফুল। ভালবাসায় কিংবা ভালবেসে দেয়া নয়, বিক্রির জন্য। যা বিক্রির টাকায় তার ক্ষুধার জ্বালা মেটে।
যে তার হাতের মালাটা বিক্রির জন্য তোমার রঙিন গাড়ির কাঁচে টোকা দিয়ে বলে-
স্যের; একটা মালা লন, মেডামরে সুন্দর লাগবো, মাত্র দশ টেকা।
আগামীর বাংলাদেশকে সুষ্ঠুভাবে এগিয়ে নিতে হলে এসব শিশুর কল্যাণে একটি পূর্ণাঙ্গ নীতিমালা তৈরি করা প্রয়োজন। যেখানে একটি সুনির্দিষ্ট কর্মপন্থা থাকবে এবং সেই কর্মপন্থার আলোকে পথশিশুর অধিকার নিশ্চিত করা, আইন প্রণয়ন, প্রকল্প গ্রহণ ও বরাদ্দ, পথশিশুর সংজ্ঞা যুগোপযোগী, গবেষণা, পথশিশুর তথ্য হালনাগাদ এবং পথশিশুর পথে আসার যে প্রবণতা সেটি বন্ধের একটি সুনির্দিষ্ট নির্দেশনা থাকবে। তা না হলে নানা সুযোগ-সুবিধা থেকে বঞ্চিত এ পথশিশুদের ভবিষ্যৎ যদি এভাবে অনিশ্চয়তার মধ্যে প্রতিনিয়ত চলতে থাকে, তাহলে তাদের মধ্যে অপরাধপ্রবণতা ক্রমেই বাড়বে।
পথশিশুরাও দেশের সম্পদ। দেশকে এগিয়ে নিতে গেলে কিংবা ডিজিটাল বাংলাদেশের স্বপ্ন পূরণ করতে হলে এ পথশিশুদের মূল্যায়ন করতে হবে যত্নসহকারে। সরকারের উচিত পথশিশুদের সম্পর্কে সচেতন হওয়া। প্রতিটি পথশিশুর জন্মনিবন্ধন করা। তবে এসব কাজ করা সরকারের একার পক্ষে হয়তো সম্ভব না, সে ক্ষেত্রে যে সংস্থাগুলো পথশিশুদের নিয়ে কাজ করছে সরকারের উচিত তাদের পাশে দাঁড়ানো। সরকারের পাশাপাশি ওই সংগঠনগুলো যদি সম্মিলিতভাবে কাজ করে এবং এ পথশিশুদের পুনর্বাসনের ব্যবস্থাসহ শিক্ষা, চিকিৎসা, খাদ্য, বস্ত্র ইত্যাদির ব্যবস্থা করে, তাহলে এ পথশিশুদের মধ্য থেকেও আমরা পেতে পারি অনেক ভালো কিছু।