লন্ডনে ওয়েস্টমিনস্টার ব্রিজে ও বৃটিশ পার্লামেন্টের আঙ্গিনায় বুধবারের সন্ত্রাসী হামলা ঘটানোর আগে খালিদ মাসুদকে বৃটিশ গোয়েন্দা কর্মকর্তারা সাধারণ অপরাধীই ভেবেছিলেন। তার দিক থেকে গুরুতর কোনো হুমকিও গোয়েন্দাদের রাডারে ধরা পড়েনি। বৃটেনে জন্মগ্রহণকারী মাসুদ ধর্মান্তরিত মুসলিম। সন্ত্রাসবাদ সংশ্লিষ্ট পূর্বতন তদন্তে তার নাম এসেছিল। এর ফলে বৃটেনের এমআই৫ গোয়েন্দা সংস্থা তাকে নিয়ে তদন্তও করে। কিন্তু এসব অনেক আগের ঘটনা। সাম্প্রতিক গোয়েন্দা নজরদারিতে অন্তর্ভুক্ত ছিল না মাসুদের নাম। বার্তা সংস্থা রয়টার্সের এক প্রতিবেদনে এসব বলা হয়েছে। বুধবার ওয়েস্টমিনস্টার সেতুতে পথচারিদের ওপর গাড়ি চালিয়ে ও পার্লামেন্টের কাছে এক নিরস্ত্র পুলিশ সদস্যকে ছুরিকাঘাত করেন তিনি। এতে নিহত হন কমপক্ষে ৪ জন। আহত হন অনেকে। পরে পুলিশের গুলিতে নিহত হন মাসুদ।
আমেরিকার এক সরকারি সূত্রের বরাতে রয়টার্স জানায়, মাসুদ যেসব লোকজনের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ছিল এদের কেউ কেউ বিদেশের বিভিন্ন জিহাদি গ্রুপে যোগ দিতে আগ্রহী ছিল। কিন্তু মাসুদ নিজে কখনও এ চেষ্টা করেনি। বৃটেনের জ্যেষ্ঠ কাউন্টার টেরোরিজম পুলিশ কর্মকর্তা মার্ক রৌলি সাংবাদিকদের বলেন, ‘আমাদের তদন্তে তার হামলার কারণ, অপারেশন ও সহযোগীদের ওপর জোর দেয়া হচ্ছে। আরো হুমকির কোনো প্রমাণ নেই। কিন্তু আমাদের লক্ষ্য হলো তিনি কি একাই সন্ত্রাসবাদী প্রোপাগান্ডায় উদ্বুদ্ধ হয়ে কাজটা করেছেন, নাকি অন্য কেউ উৎসাহ যুগিয়েছে, সমর্থন দিয়েছে বা নির্দেশ দিয়েছে, তা খতিয়ে দেখা।’ তিনি আহ্বান জানিয়ে বলেছেন, যারা মাসুদকে ভালোভাবে চেনেন ও তার সাম্প্রতিক গতিবিধি সম্পর্কে যাদের জানাশোনা আছে, তারা যেন পুলিশের সঙ্গে যোগাযোগ করেন। মধ্যপ্রাচ্যের জঙ্গিগোষ্ঠী ইসলামিক স্টেট মাসুদের হামলার দায় স্বীকার করেছে। তবে এই সন্ত্রাসী গোষ্ঠীর সঙ্গে মাসুদের কোন যোগসূত্র রয়েছে কিনা তা স্পষ্ট নয়। পুলিশ বলেছে, তার হামলা চালানোর উদ্দেশ্য সম্পর্কে আগাম কোন গোয়েন্দা তথ্য ছিল না।
রয়টার্স বলেছে, হামলাকারীর মূল নাম অ্যাড্রিয়ান রাসেল আজাও। দক্ষিণপূর্ব লন্ডনের কেন্টে ১৯৬৪ সালের বড়দিনে তার জন্ম। পরে ইংল্যান্ডে বিভিন্ন জায়গায় সে বসবাস করেছে। সম্প্রতি মধ্য ইংল্যান্ডের বার্মিংহ্যামে তিনি বসবাস করতেন বলে জানা গেছে। যুক্তরাজ্যের ডেইলি মেইল পত্রিকা বলেছে, ইংল্যান্ডের দক্ষিণ উপকূলীয় শহর রাইয়ে তার মা তাকে বড় করেছেন। পরে অ্যাড্রিয়ান রাসেল ইসলাম ধর্মে ধর্মান্তরিত হন ও নাম পরিবর্তন করে খালিদ মাসুদ নাম গ্রহণ করেন। অন্যান্য মিডিয়ার রিপোর্টে বলা হচ্ছে, তিনি তিন সন্তানের জনক ও সাবেক ইংরেজি শিক্ষক। তার একাধিক ছদ্মনাম ছিল। এর আগে বিভিন্ন অপরাধে খালিদ মাসুদ দোষী সাব্যস্ত হয়েছে বটে। কিন্তু এর কোনটিই সন্ত্রাসবাদ সংশ্লিষ্ট ছিল না। তার পেশা সম্পর্কে স্পষ্ট কিছু জানা যায়নি। ১৯৮৩ সালের নভেম্বরে প্রথম কর্তৃপক্ষের নজরে পড়ে মাসুদ। তখন ক্ষয়ক্ষতির দায়ে দোষী সাব্যস্ত হন তিনি। সর্বশেষ ২০০৩ সালের ডিসেম্বরে ছুরি রাখার দায়ে তাকে দোষী সাব্যস্ত করা হয়। সরকারিভাবে তার সম্পর্কে বিস্তারিত তেমন কিছুই জানানো হচ্ছে না। কেন তিনি বুধবারের হামলাটি চালালেন তারও কোনো বিস্তারিত ব্যাখ্যা নেই। ২০০৫ সালে লন্ডনে আত্মঘাতী বোমা হামলার পর এটিই বৃটেনের সবচেয়ে প্রাণঘাতী সন্ত্রাসী হামলা। তবে পুলিশ কর্মকর্তা রৌলি বলেছেন, ‘আমাদের অনুমান হচ্ছে যে, আন্তর্জাতিক সন্ত্রাসবাদ থেকে উদ্বুদ্ধ হয়েছে সে।’
তিনি বলেন, বর্তমানে নয় ব্যক্তিকে জেরা করছেন গোয়েন্দারা। এর আগে মধ্য ও উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলীয় ইংল্যান্ডে দু’টি ‘গুরুত্বপূর্ণ’ গ্রেপ্তারের ঘটনা ঘটে।
বার্মিংহ্যামে মাসুদের সাবেক এক প্রতিবেশী বলেন, টিভিতে ও পেপারে যখন আমি প্রথম হামলাকারীর ছবি দেখি, তখন সঙ্গে সঙ্গে আমি তাকে চিনতে পারি। কারণ, তিনি আমার পাশেই বসবাস করতেন। আইওনা রোমেক (৪৫) নামে ওই ব্যক্তি বলেন, তার এক ছোট সন্তান ছিল। আমার মনে হয় তার বয়স ৫-৬ বছর ছিল। তাদের সঙ্গে এক এশিয়ান মহিলা বসবাস করতেন। মাসুদকে বেশ ভালোই মনে হতো। নিজের বাগানের যত্ন করতেন, আগাছা পরিষ্কার করতেন। তবে ডিসেম্বরের দিকে আচমকা চলে যান মাসুদ।
রয়টার্সের খবরে বলা হয়, বার্মিংহাম বৃটিশ ইসলামিস্টদের অন্যতম ‘হটবেড’। হেনরি জ্যাকসন থিংকট্যাংকের সাম্প্রতিক এক গবেষণায় বলা হয়, ১৯৯৮ থেকে ২০১৫ সাল পর্যন্ত বৃটেনে সন্ত্রাসবাদের অভিযোগে ২৬৯ জন লোক দোষী সাব্যস্ত হয়। এদের ৩৯ জনই ছিল বার্মিংহামের বাসিন্দা। মাসুদ বুধবারের হামলা চালাতে যে গাড়িটি ব্যবহার করেছিলেন তা বার্মিংহাম থেকেই ভাড়া করা। এ থেকে ইঙ্গিত পাওয়া যায় যে, এখানে তার এখনও পরিচিত লোকজন আছে। লন্ডন হামলার পরপর পুলিশ এ শহরের বেশ কয়েকটি স্থানে অভিযান চালায়। অভিযানে ৫ পুরুষ ও ২ নারীকে সন্ত্রাসী হামলার প্রস্তুতি গ্রহণের সন্দেহে আটক করে।