বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার রাজনৈতিক কার্যালয়ে হঠাৎ তল্লাশি চালিয়েছে পুলিশ। একটি জিডি’র ভিত্তিতে মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেটের সার্চ ওয়ারেন্ট নিয়ে গতকাল সকালে পুলিশ দুই ঘণ্টা ধরে এ তল্লাশি চালায়। এ সময় কার্যালয়ের বিভিন্ন ফাইলপত্র ভিডিও করে পুলিশ। পরে পুলিশের পক্ষ থেকে লিখিতভাবে বলা হয়েছে, তল্লাশির সময় বিএনপি চেয়ারপারসনের কার্যালয়ে কিছুই পাওয়া যায়নি। চেয়ারপারসনের কার্যালয়ে আকস্মিক এ তল্লাশির প্রতিবাদ জানিয়েছে বিএনপি। রাজধানীসহ সারা দেশে তাৎক্ষণিকভাবে বিক্ষোভ করেছে বিএনপি ও দলটির অঙ্গ এবং সহযোগী সংগঠনগুলোর নেতাকর্মীরা। সেই সঙ্গে আজ সারা দেশে বিক্ষোভ কর্মসূচি ঘোষণা করেছে বিএনপি, যুবদল, স্বেচ্ছাসেবক দল ও ছাত্রদল। এ তল্লাশির ব্যাপারে আইনগত পদক্ষেপ নেয়া হবে বলে জানিয়েছেন বিএনপি’র ভাইস চেয়ারম্যান এডভোকেট জয়নুল আবেদিন।
বিএনপি চেয়ারপারসন কার্যালয়ের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা জানান, সকাল সাড়ে ৬টার সময় আকস্মিকভাবেই কার্যালয়ের সামনে অবস্থান নেয় পুলিশের একটি টিম। কিছুক্ষণের মধ্যে সেখানে পুলিশের উপস্থিতি আরও বাড়তে থাকে। ৭টার দিকে কার্যালয়ের সামনের ৮৬ নম্বর সড়কের দুই প্রান্ত আটকে দেয় পুলিশ। এ সময় পুলিশের পাশাপাশি সেখানে গোয়েন্দা পুলিশ, র?্যাব ও বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থার লোকজনের উপস্থিতি ছিল চোখে পড়ার মতো। সাড়ে ৭টার সময় তারা কার্যালয়ের মূল ফটকের তালা ভেঙে ভেতরে ঢোকার মাধ্যমে অভিযান শুরু করে। মূল ফটকের পর কার্যালয়ের প্রধান দরোজার (কলাপসিবল গেট) ও দোতলার দরোজার দুইটিসহ তিনটি তালা ভেঙেছে পুলিশ। পুলিশের সঙ্গে একজন মিস্ত্রি ছিল। এই মিস্ত্রিকে দিয়েই তালা ভাঙা হয়। দ্বিতীয় তলায় তল্লাশিকালে পুলিশ খালেদা জিয়ার কক্ষের চাবি চায়। এ সময় কার্যালয়ের কর্মীরা জানান, ওই কক্ষের চাবি তাদের কাছে থাকে না। পুলিশ সম্প্রতি বিএনপি ২০৩০ যে ভিশন ঘোষণা করেছে, সেসব বইগুলো কোথায় আছে তাও জানতে চায় এবং কার্যালয়ের সিসি ক্যামেরায় ধারণ করা ক্যাসেটগুলো চায়। সেগুলো না পেয়ে পুলিশ কিছু কাগজপত্র ফটোকপি করিয়ে নেয়। তল্লাশির সময় কার্যালয়ের ভেতরের ফাইলসহ বিভিন্ন কাগজপত্রে ভিডিও ও স্থিরচিত্র ধারণ করে পুলিশ। যাওয়ার সময় পুলিশ ভাঙা তালাগুলো নিয়ে যায়। কার্যালয়ের কর্মী সোহরাব সাংবাদিকদের জানান, প্রধান ফটকের তালা ভেঙে পুলিশ কার্যালয়ে ঢোকে। প্রথমেই তারা কার্যালয়ের চারজন কর্মীর মোবাইল ফোন নিয়ে নেয়। এ সময় তল্লাশির সঙ্গে যুক্ত পুলিশের গুলশান বিভাগের কর্মকর্তারা গণমাধ্যমের সঙ্গে কোনো কথা বলেননি। ডিএমপি’র গুলশানের জোনের উপ-কমিশনার মোস্তাক আহমেদের নেতৃত্বে সকাল ৮টা থেকে সাড়ে ৯টা পর্যন্ত পর্যন্ত সে অভিযান চলে। অভিযানে অংশ নেয়া পুলিশ কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, এই কার্যালয়ের ভেতরে রাষ্ট্রবিরোধী কোন কিছু আছে কি না, তা খতিয়ে দেখার আদালতের নির্দেশনা আছে। সে অনুযায়ী তল্লাশি করা হচ্ছে। দুইদিন আগে খালেদা জিয়ার রাজনৈতিক কার্যালয়ে এক ট্রাক বই আনার খবর তারা পেয়েছেন। সেই বইকে ঘিরে তাদের সন্দেহ হচ্ছে। অভিযান শেষে বেলা পৌনে ১০টার দিকে সড়কে বসানো ব্যারিকেড তুলে নেয় পুলিশ। আশপাশের লোকজনের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, প্রায় আড়াই ঘণ্টা ওই এলাকায় সাধারণ কোনো যানবাহন ঢুকতে দেয়া হয়নি। অভিযানের পর গুলশান থানার ওসি আবুবকর সাংবাাদিকদের বলেন, যে তথ্যের ভিত্তিতে অভিযান চালানো হয়, সে রকম কিছু পাওয়া যায়নি। অভিযান শেষে পুলিশ বেরিয়ে যাওয়ার পর কার্যালয়ে ঢুকে দেখা যায়, নিচতলা ও দোতলায় দু’টি সিসি ক্যামেরার মুখ ঘুরিয়ে রাখা হয়েছে। দোতলা ও তিনতলায় কাগজপত্র, ফাইলপত্র ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে। কার্যালয় সূত্রে জানা গেছে, অভিযানের সময় কার্যালয়ের দোতলায় অবস্থিত খালেদা জিয়ার কক্ষে প্রবেশ করেনি পুলিশ। কার্যালয়ের কর্মকর্তারা জানান, খালেদা জিয়ার কার্যালয়ে এটাই পুলিশের প্রথম অভিযান।
বিএনপি নেতারা জানান, অজ্ঞাতনামা ব্যক্তির দায়েরকৃত ওই জিডিতে সময় হিসেবে শুক্রবার ১৯শে মে সন্ধ্যা ৭টা ৫ মিনিট লেখা ছিল। তবে গুলশান ঠিকানা উল্লেখ করা হলেও কোথায় বিএনপি’র কার্যালয় লেখা ছিল না। জিডিতে লেখা রয়েছে, ‘গুলশান-২ নম্বরের ৮৬ নম্বর সড়কের ৬ নম্বর বাড়ি ও এর আশপাশের এলাকায় রাষ্ট্রবিরোধী ও আইনশৃঙ্খলা পরিপন্থি, রাষ্ট্রের শৃঙ্খলা বিনষ্টসহ বিভিন্ন ধরনের স্টিকার ও নাশকতামূলক কর্মকাণ্ডের সামগ্রী মজুতের খবর গোপন সূত্রে জানা গেছে।’ তল্লাশির পর পুলিশের পক্ষ থেকে বিএনপিকে একটি ‘তালিকা’ দেয়া হয়। পুলিশের গুলশান থানার পরিদর্শক (এসআই) আজিজুল ইসলাম স্বাক্ষরিত সেই তালিকায় তল্লাশিতে প্রাপ্ত মালামালের পরিমাণ ‘শূন্য’ বলে উল্লেখ করা হয়। তবে সেখানে তল্লাশির স্থান হিসেবে বিএনপি চেয়ারপারসনের কার্যালয়ের ঠিকানা লেখা ছিল না। পুলিশের সে তল্লাশি তালিকাটি রিসিভ করেন বিএনপি চেয়ারপারসনের নিরাপত্তা টিম সিএসএফ-এর প্রধান।
এদিকে অভিযানের সময় কার্যালয়ে ছিলেন না বিএনপি’র কোনো নেতা। খবর পেয়ে সকাল ন’টার দিকে প্রথমে সেখানে ছুটে যান বিএনপি’র সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রিজভী আহমেদ। পুলিশের সঙ্গে কথা বলে তিনি কার্যালয়ের ভেতর যান। এর মিনিট বিশেক পর দলের আরেক যুগ্ম মহাসচিব হাবিব-উন-নবী খান সোহেল ঘটনাস্থলে আসেন। এ সময় বিএনপি’র শীর্ষ কোনো নেতাকে গুলশান কার্যালয়ে আসতে দেখা যায়নি। এ সময় পুলিশের এই অভিযানকে ‘পুলিশি হানা’ আখ্যায়িত করে তার নিন্দা জানান রিজভী আহমেদ। তিনি বলেন, এই হানা সরকারের অগণতান্ত্রিক মনোবৃত্তির বহিঃপ্রকাশ। অজ্ঞাতনামা ব্যক্তির জিডি’র পরিপ্রেক্ষিতে দেশের সবচেয়ে জনপ্রিয় নেত্রী খালেদা জিয়াকে অসম্মান ও মানসিকভাবে বিপর্যন্ত করতে এই অভিযান চালানো হয়েছে। সারা দেশে খুন-গুম-হত্যা, সামাজিক অবক্ষয়সহ নানা ব্যর্থতা আড়াল করতেই সরকার এই অভিযান চালিয়েছে। রিজভী বলেন, দলের নেতৃবৃন্দকে এ বিষয়ে অবহিত করা হয়নি। পুলিশ আমাদের জানিয়েছে, অভিযানে তারা কিছুই পায়নি। তাদের প্রাপ্তি শূন্য। কিন্তু পুলিশ ওই অজ্ঞাতনামা ব্যক্তির নাম প্রকাশ করছে না। আমরা সংবাদ সম্মেলন করে এ ঘটনার প্রতিবাদ জানাবো। তবে পুলিশ চলে যাওয়ার পর দলের স্থায়ী কমিটির সদস্য গয়েশ্বর চন্দ্র রায়, নজরুল ইসলাম খান, ভাইস চেয়ারম্যান মোহাম্মদ শাহজাহান, এডভোকেট জয়নাল আবেদিন, চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা নিতাই রায় চৌধুরী, সাংগঠনিক সম্পাদক সৈয়দ এমরান সালেহ প্রিন্স ও শামা ওবায়েদ চেয়ারপারসন কার্যালয়ে যান। এ সময় বিএনপি স্থায়ী কমিটির সদস্য নজরুল ইসলাম খান সাংবাদিকদের বলেন, এই অভিযানের নামে খালেদা জিয়ার কার্যালয়ে পুলিশ বিস্ফোরক জাতীয় কোনো দ্রব্য রেখে গেছে কি না, সে বিষয়ে সন্দেহ তৈরি হয়েছে। কারণ তারা অভিযানের সময় কার্যালয়ে স্থাপিত সিসি ক্যামেরাগুলোর মুখ ঘুরিয়ে দিয়েছে। এ নিয়ে আমরা দুশ্চিন্তাগ্রস্ত। জনগণের ভোটবিহীন সরকারই এ ধরনের অপকর্ম করতে পারে। যে কাজটা তারা করেছে, এটা সাংঘাতিক অপরাধ। এটার সুষ্ঠু তদন্ত ও বিচার দাবি করছি। বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান অ্যাডভোকেট জয়নুল আবেদিন বলেন, সার্চ ওয়ারেন্ট থাকলে যেখানে সার্চ করবে সেখানে নোটিশ দিতে হবে। তারপর আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী বলবে, আপনাদের প্রতিনিধি দেন। কিন্তু তা না করে তালা ভেঙে সিসিটিভি ক্যামেরা ঘুরিয়ে তল্লাশি চালানো আইনের বিরোধী। জিডির বিষয়টিও দেখানো হয়নি। তা অফিসকে আগেই জানানো উচিত ছিল। তা না করে কর্মচারীদের জিম্মি করে এ কর্মকাণ্ড চালিয়েছে। এতে আইনের ব্যত্যয় ঘটেছে। আমরা আইনি পদক্ষেপ নেবো।
ওদিকে পুলিশি অভিযানের প্রতিবাদে বেলা সাড়ে ১২টার দিকে চেয়ারপারসনের রাজনৈতিক কার্যালয়ে সামনে তাৎক্ষণিক বিক্ষোভ করেছে ঢাকা মহানগর বিএনপি ও অঙ্গসংগঠনের নেতাকর্মীরা। দলের যুগ্ম মহাসচিব ও ঢাকা মহানগর দক্ষিণের সভাপতি হাবিব-উন-নবী খান সোহেলের নেতৃত্বে নেতাকর্মীরা মিছিল নিয়ে গুলশান ৮৬ নম্বর রোডের উত্তর থেকে দক্ষিণ প্রান্ত পর্যন্ত এ বিক্ষোভ মিছিল করে। এ সময় নেতাকর্মীরা সরকারের বিরুদ্ধে মুহুর্মুহু স্লোগানে মুখরিত করে তোলে ওই এলাকা। বিক্ষোভ মিছিল শেষে তারা একটি সংক্ষিপ্ত সমাবেশ থেকে এ ঘটনার নিন্দা ও প্রতিবাদ জানান। বিক্ষোভ মিছিলে যুবদল সভাপতি সাইফুল ইসলাম নিরব, সাধারণ সম্পাদক সুলতানা সালাউদ্দিন টুকু, এসএম জাহাঙ্গীর, স্বেচ্ছাসেবক দলের সভাপতি শফিউল বারী বাবু, সাধারণ সম্পাদক আবদুল কাদের ভূঁইয়া জুয়েল, ছাত্রদলের সভাপতি রাজিব আহসান, মহিলা দলের সভাপতি আফরোজা আব্বাস, সাধারণ সম্পাদক সুলতানা আহমেদ, সহ-আন্তর্জাতিক বিষয়ক সম্পাদক ফাহিমা নাসরিন মুন্নী, নির্বাহী কমিটির সদস্য নাদিম মোস্তফা, মহানগর বিএনপির শেখ রবিউল ইসলাম রবি, আমিনুল ইসলাম, যুবদলের সাংগঠনিক সম্পাদক মামুন হাসান, ঢাকা মহানগর যুবদল উত্তরের সভাপতি এসএম জাহাঙ্গীর হোসেন, সাধারণ সম্পাদক শফিকুল ইসলাম মিল্টন, যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক শরিফ উদ্দিন জুয়েল, সাংগঠনিক সম্পাদক মোস্তফা জগলুল পাশা পাপেল, স্বেচ্ছাসেবক দলের সাংগঠনিক সম্পাদক ইয়াসিন আলী, মহিলা দলের সিনিয়র যুগ্ম সম্পাদক হেলেন জেরিন খান, কেন্দ্রীয় নেত্রী হোসনাসহ কয়েকশ’ নেতাকর্মী অংশ নেন। পরে মহিলা দলের নেতাকর্মীরা কার্যালয়ের সামনে বসে রাস্তায় অবরোধ করেন। কিছুক্ষণ পর পুলিশ এসে তাদের সরিয়ে দেয়।
ওদিকে চেয়ারপারসন কার্যালয়ে তল্লাশির সময় নিজ জেলা ঠাকুরগাঁওয়ে অবস্থান করছিলেন বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। সেখানে নিজ বাসভবনে জরুরি সংবাদ সংম্মেলন করে সাংবাদিকদের তিনি বলেন, বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার কার্যালয়ে পুলিশের তল্লাশি প্রমাণ করে দেশে গণতন্ত্রের লেশমাত্র নেই। বর্তমান সরকার উদ্দেশ্যপ্রণোদিত হয়ে গণতান্ত্রিক চর্চা ব্যাহত করতে চাচ্ছে। বাংলাদেশ সম্পূর্ণ গণতন্ত্রবিহীন রাষ্ট্রে পরিণত হয়েছে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সাহায্যে এই সরকার দেশ চালাচ্ছে।
সারা দেশে বিক্ষোভ আজ
বিএনপি চেয়ারপারসনের রাজনৈতিক কার্যালয়ে পুলিশি তল্লাশির প্রতিবাদে আজ রোববার সারা দেশে বিক্ষোভ কর্মসূচি পালন করবে বিএনপি, যুবদল, স্বেচ্ছাসেবক দল ও ছাত্রদল। গতকাল আলাদাভাবে তারা এ কর্মসূচি ঘোষণা করেছে। দুপুরে বিএনপি’র সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রিজভী আহমেদ ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটি মিলনায়তনে এক অনুষ্ঠানে এই কর্মসূচির কথা জানান। রিজভী বলেন, এই তল্লাশি কাপুরুষোচিত। এটি আওয়ামী লীগ সরকারের গভীর ষড়যন্ত্রের অংশ। ঘৃণ্য এ দৃষ্টান্তের প্রতিবাদে বিএনপি রোববার ঢাকাসহ সারা দেশে বিক্ষোভ কর্মসূচি পালন করবে। পরে যুবদল, স্বেচ্ছাসেক দল ও ছাত্রদলের পক্ষ থেকে আলাদাভাবে এ কর্মসূচি ঘোষণা করা হয়।