আতঙ্ক আর হয়রানিতে স্বর্ণ ব্যবসায়ীরা। মঙ্গলবার বাংলাদেশ জুয়েলারি সমিতির (বাজুস) নেতারা জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) চেয়ারম্যানের কাছে এ অভিযোগ করেছেন।
এনবিআর চেয়ারম্যান নজিবুর রহমান বলেছেন, জুয়েলারি শিল্পের সঙ্গে জড়িত কাউকে কোনো প্রকার হয়রানি করা যাবে না। বাংলাদেশে জুয়েলারি শিল্প অর্থনীতি ও রাজস্বে গুরুত্বপূর্ণ খাত। এই খাতের বিকাশমান অগ্রগতি ধরে রাখার জন্য সর্বাত্মক সহযোগিতা করবে এনবিআর। প্রতিনিধিদের আশ্বস্ত করে নজিবুর রহমান বলেন, স্বর্ণ ব্যবসায়ীদের জন্য এনবিআর একটি নীতিমালা করছে। স্বর্ণ ব্যবসার আড়ালে যাতে কালো টাকার লেনদেন না হয়- সেদিকে ব্যবসায়ীদের নজর রাখতে হবে।
বাজুস সভাপতি গঙ্গাচরণ মালাকার বলেন, সারা দেশ থেকে আমাদের কাছে র্স্বণ ব্যবসায়ীরা একাধিক অভিযোগ করেছেন। এর মধ্যে উল্লেখ্যযোগ্য হলো- পুলিশ, বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থা ও ডিবি পুলিশ পরিচয়ে স্বর্ণ দোকানে অভিযানের নামে হয়রানি করছে। তারা দোকানের হিসাব, কি ধরনের স্বর্ণ এবং ক্যাশ মেমো দেখতে চায়। তাই বাধ্য হয়েই আমরা এনবিআরকে বিষয়টি জানিয়েছি।
এনবিআর চেয়ারম্যান অমাদের আশ্বস্ত করেছেন। আর যাতে কোনো হয়রানি না হয়। মালাকার বলেন, এ ছাড়া আপন জুয়েলার্সের ৫টি শোরুম থেকে চোরাচালানের দায়ে শুল্ক গোয়েন্দা কর্তৃক আটককৃত প্রায় ১৫.১৩ মণ স্বর্ণ আটকের পরিপ্রেক্ষিতে বিভিন্ন পর্যায়ে ভুলভাবে বার্তা যাওয়ায় সাধারণ স্বর্ণ ব্যবসায়ীদের মধ্যে আতঙ্ক বিরাজ করছে। ফলে ঈদের বাজারকে কেন্দ্র করে স্বর্ণ ব্যবসা ক্ষতির সম্মুখীন হচ্ছে বলে মন্তব্য করেন বাজুস সভাপতি। এদিকে শুল্ক গোয়েন্দা অধিদপ্তরের অভিযানের পর নানা কারণে আতঙ্কে রয়েছেন রাজধানীর নামিদামি জুয়েলারি ব্যবসায়ীসহ নগরের বিভিন্ন এলাকার পাইকারি ও খুচরা স্বর্ণ ব্যবসায়ীরা। আর স্বর্ণ ব্যবসায়ীদের এই আতঙ্ক ও অস্থিরতা ছুঁয়েছে স্বর্ণালঙ্কার ক্রেতাদের মধ্যেও।
রাজধানীর তাঁতীবাজার, শাখারিবাজার, কতোয়ালি, বায়তুল মোকাররম এলাকা ঘুরে পাইকারি ও খুচরা স্বর্ণ বিক্রেতা ও ক্রেতাদের সঙ্গে কথা বলে এমন চিত্র পাওয়া গেছে।
ব্যবসায়ীরা জানান, বিভিন্ন কারণে স্বর্ণালঙ্কার ক্রেতাও কমে গেছে আশঙ্কাজনক হারে। এমনকি আতঙ্কে জুয়েলারি শোরুম ও দোকানগুলোতে সাজিয়ে রাখা স্বর্ণও কমিয়ে ফেলেছেন ব্যবসাযীরা। ব্যবসায়ীরা বলছেন, স্বর্ণ ব্যবসায় একধরনের অস্থিরতা চলছে। এই অস্থিরতা আরো কিছুদিন থাকলে ব্যবসায় পুরোপুরি ধস নামবে। তারা জানান, শুধু রাজধানীই নয় সারা দেশেই একই অবস্থা। তাদের মতে, বিরূপ এই পরিস্থিতিতে তারা আতঙ্কে আছেন।
মঙ্গলবার রাজধানীর তাঁতীবাজার এলাকায় বেশকজন স্বর্ণ ব্যবসায়ীর সঙ্গে কথা হয় এই প্রতিবেদকের। কয়েকজন ব্যবসায়ী আলাপকালে জানান, শুধু রাজধানীই নয়, সারা দেশের স্বর্ণ ব্যবসায়ীদের আস্থার জায়গা রাজধানীর তাঁতীবাজার, কতোয়ালি, ইসলামপুর। এখান থেকেই স্বর্ণ কেনাবেচা করেন রাজধানীর বাইরের বিভিন্ন জেলা, উপজেলা ও প্রত্যন্ত অঞ্চল থেকে আসা পাইকারি ও খুচরা ব্যবসায়ীরা।
তবে, কিছুদিন আগে আপন জুয়েলার্সের ওই ঘটনার পর গত একমাস ধরে এই এলাকার স্বর্ণ ব্যবসায় একপ্রকার ‘ধস’ নেমেছে বলে মন্তব্য তাদের। তারা জানান, অবস্থা এমন হয়েছে যে, কেউ বেশি পরিমাণ স্বর্ণ কিনতে আসলেই গোয়েন্দা সংস্থা বা আইন শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর লোক ভেবে ‘স্বর্ণ নেই’ বলে জানানো হয়। শুধু তাঁতীবাজার নয় রাজধানীর বায়তুল মোকাররম, নিউমার্কেট, মৌচাকসহ বিভিন্ন স্বর্ণের পাইকারি ও খুচরাবাজারে স্বর্ণ ব্যবসায়ীরাও একদিকে আতঙ্কে দিন পার করছেন। অন্যদিকে ক্রেতাও কমে গেছে আশঙ্কাজনকহারে।
তাঁতীবাজারের মিশু জুয়েলার্সের স্বত্বাধিকারী হাজী মো. আসাফ উল্লাহ বলেন, আপন জুয়েলার্সের ওই ঘটনার পর থেকেই আমাদের খুব খারাপ সময় যাচ্ছে। এতে করে সাধারণ ও খুচরা স্বর্ণ ব্যবসায়ীরা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন।
সরজমিনে তাঁতীবাজার, শাখারিবাজার, কতোয়ালি, ইসলামপুর এলাকা ঘুরে দেখা গেছে, এখানকার বেশির ভাগ স্বর্ণ ব্যবসায়ী বন্ধকি ব্যবসা করেন। রাজধানীসহ দেশের নানা প্রান্ত থেকে আসা নারী, পুরুষেরা তাদের স্বর্ণ বন্ধক রেখে নির্দ্দিষ্ট সময়ের জন্য সুদে টাকা ধার দেন। তবে, পরিবির্তিত পরিস্থিতিতে এসব ব্যবসায়ীকে বন্ধকী ব্যবসাতেও ধস নেমেছে বলে জানান ব্যবসায়ীরা।
তাঁতীবাজারের বরুণ জুয়েলার্সের স্বত্বাধিকারী বরুণ কুমার দত্ত বলেন, আগে মাসে অন্তত ১৫ দিন ব্যবসা করার সুযোগ হতো। তাতেই পুরো মাসের ব্যবসা হয়ে যেত। কিন্তু গত এক মাসে কোন ব্যবসা বলতে গেলে নেই। কেউ যেমন স্বর্ণ কিনতে আসছেন না, তেমনি কেউ বন্ধকও রাখতে আসছেন না।
বাংলাদেশ জুয়েলারি সমিতির (বাজুস) কোষাধ্যক্ষ ও তাঁতীবাজার বণিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক পবিত্র চন্দ্র ঘোষ বলেন, কিছুদিন আগে আপন জুয়েলার্সের স্বর্ণ জব্দের ঘটনায় ব্যবসায়ী ও ক্রেতামহলে কিছুটা আতঙ্ক কাজ করাটাই স্বাভাবিক। যে কারণে ব্যবসায়ও মন্দাভাব যাচ্ছে। তবে, আমরা সরকারের সঙ্গে আলোচনা চালিয়ে যাচ্ছি। আশা করি ঈদের পর সবকিছু স্বাভাবিক হয়ে আসবে।