ঈদ এলেই রাঙ্গুনিয়ার ইসলামপুর ইউনিয়নের পাহাড়তলির ঘোনা বড়বিল এলাকার বাসিন্দা দ্বীন মোহাম্মদের ঘরে খুশির জোয়ার বইত।
আর্থিকভাবে অসচ্ছল হলেও পরিবারের সবার জন্য টুকটাক উপহার সংগ্রহ করতেন। কিন্তু এবার স্ত্রী ও দুই নাতিকে হারিয়ে শোকে বাকরুদ্ধ দ্বীন মোহাম্মদ। মঙ্গলবার সকালে ভয়াবহ পাহাড় ধসে ৩ জন মারা যান তার পরিবারের।
গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন থাকায় মাটিচাপা পড়ার পর আর কেউই বাঁচতে পারেননি। দুমড়ে-মুচড়ে যায় তার সবকিছু। বিকট আওয়াজে অন্যরা সটকে পড়ে কোনোভাবে প্রাণ বাঁচান।
এবার ঈদের আনন্দ মাটিচাপা পড়েছে। আগের স্মৃতি মনে করে ঢুকরে কেঁদে উঠছেন দ্বীন। বলেন, ‘ঈদের আনন্দ এখনো সবাইকে নিয়ে ভাগাভাগি করার স্মৃতি চোখের সামনে ভাসছে। এই তো গত বছরও সেমাই খেয়েছি। বাড়ির পাশের সবাই হাত বাড়িয়ে দিয়েছিলেন। এখন পুরো ঘর কান্নায় ভারি হয়ে উঠেছে।’
কেবল বড়বিল এলাকার এই বাসিন্দাই নন, চট্টগ্রামে পাহাড় ধসে নিহত সবার পরিবারেই চলছে মাতম। তাই এবার ঈদ যেন সেসব পরিবারের কাছে কান্না ছাড়া আর কিছুই নয়।
মঘাইছড়ি এলাকায় নিহত হয়েছেন মফিজুরের পরিবারের ৫ জন। তিনি বলেন, মঙ্গলবার ঘটনার সময় আমি বাসার বাইরে ছিলাম। তাই হয়তো বেঁচে গেছি। কিন্তু মাটির ভেতর থেকে যখন আমার স্ত্রী জোৎসনা বেগম, মা রিজিয়া বেগম, তিন সন্তান মুনমুন, সাজ্জাদ ও মানিকের লাশ টেনে তোলা হচ্ছিল, তখন মনে হলো যেন আমাকে কেউ কঠিন শাস্তি দিয়েছে।
মফিজ বলেন, বাচ্চাগুলোর জন্য গতবারও ঈদের জামা-পাজামা কিনেছিলাম। এবার তাদের রেখে যাওয়া জামা-কাপড় বুকে ধরে কাঁদছি। আর কোনো মানুষের জীবনে যেন এমন করুণ ঘটনা না ঘটে।
ভয়াল পাহাড়ধস রাঙ্গামাটি শহরের নতুনপাড়া এলাকায় প্রাণ কেড়ে নিয়েছে অটোরিকশা চালক নুরুন্নবীর পরিবারের ৬ জনের। গতকাল হাসপাতালে আহত থাকা অবস্থায় কান্নাজড়িত কণ্ঠে তিনি বলেন, ঈদ বলে আর কিছু নেই আমার। মাটিচাপা পড়ে মারা গেছে আমার স্ত্রী। তাকে বাঁচাতে গিয়ে দেখলাম মেয়ে, ছেলে ও নাতনিসহ মোট ৬ জন আর বেঁচে নেই। এত লোক মারা গেলে একটি পরিবারে কী আনন্দ থাকে বলুন?
দুই হাত তুলে বিলাপ করতে করতে তিনি বলেন, আমি কী অন্যায় করেছি। কেন আমার পরিবারে এমন দুর্যোগ নেমে এলো। আমার জীবনে আর ঈদ উদযাপন করা হবে না।
আবুধাবি থেকে দেশে ফিরেছিলেন বগারবিল এলাকার নজরুল ইসলাম। প্রবল বৃষ্টিতে পাহাড়ধসে মাটি এসে আছড়ে পড়ে ঘুমন্ত নজরুল, স্ত্রী আসমা আক্তার, দুই সন্তান মনজু ও সাথীর ওপর। ঘটনার সময় নানার বাড়িতে থাকায় প্রাণে বেঁচে যায় লাকী আক্তার।
বাবা-মা ও ভাই বোনকে হারিয়ে এবার ঈদ একাই করতে হচ্ছে এই মেয়েটিকে। বলেন, আমি ঈদ করতে চাই না। চোখ বন্ধ করলেই বাবা-মাকে স্বপ্ন দেখি। দরজা খুললেই মনে হয় আমার ভাইবোন হাত নেড়ে আমাকে ডাকছে।
চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসক মো. জিল্লুর রহমান চৌধুরী বলেন, পাহাড়ধসে এক-একটি পরিবারের বেশিরভাগ সদস্য মারা গেছেন। তাদের পরিবারে এখন শোক চলছে। আমরা ঈদের আগেই ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারগুলোর হাতে ত্রাণ তুলে দেয়ার চেষ্টা করছি।