ভয়াবহ পাহাড়ধসে নিহত ও ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারের মাঝে ত্রাণ বিতরণ করতে রাঙ্গামাটি যাওয়ার পথে চট্টগ্রামের রাঙ্গুনিয়ায় বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের গাড়িবহরে সশস্ত্র হামলার ঘটনা ঘটেছে। এতে  মির্জা ফখরুলসহ আহত কেন্দ্রীয় নেতারা। হামলার ঘটনায় রাজধানীতে তাৎক্ষণিক বিক্ষোভ করেছে বিএনপি। আজ সারা দেশে বিক্ষোভ কর্মসূচি ঘোষণা করেছে দলটি। বিএনপি চেয়ারপারসন বলেছেন, এ ন্যক্কারজনক হামলার পরিণতি শুভ হবে না। এ ঘটনায় নিন্দা ও প্রতিবাদ জানিয়ে বিবৃতি দিয়েছে বিভিন্ন রাজনৈতিক দল ও সংগঠন। গতকাল সকাল ১০টায় চট্টগ্রাম-কাপ্তাই সড়কের রাঙ্গুনিয়া ইছাখালি এলাকায় ৩০-৪০ জনের সশস্ত্র এক দল দুর্বৃত্ত এই হামলা চালায়। হামলায় বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর, স্থায়ী কমিটির সদস্য আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী, ভাইস চেয়ারম্যান রুহুল আলম চৌধুরী, চট্টগ্রাম বিভাগীয় সাংগঠনিক সম্পাদক মাহাবুবুর রহমান শামীম, স্বাস্থ্য বিষয়ক সম্পাদক ডা. মীর ফাওয়াজ হোসেন শুভ, চট্টগ্রাম মহানগর বিএনপির সাধারণ সম্পাদক আবুল হাশেম বকরসহ বেশ কয়েকজন আহত হয়েছেন। ভাঙচুর করা হয়েছে বহরের সাতটি গাড়ি। ফলে রাঙ্গামাটি যেতে পারেনি বিএনপির প্রতিনিধি দল। রাঙ্গুনিয়া থেকে ফিরে যান বিএনপি নেতারা। পরে তারা চট্টগ্রাম প্রেস ক্লাবে সংবাদ সম্মেলন করে বিকেলে ঢাকায় চলে যান। এই ঘটনার জন্য সরকার দলীয় ক্যাডারদের দায়ী করেছেন বিএনপি নেতারা। তারা বলছেন, আওয়ামী লীগের প্রচার ও প্রকাশনা সম্পাদক রাঙ্গুনিয়ার এমপি ড. হাছান মাহমুদের অনুসারী সন্ত্রাসীরা এই হামলা চালিয়েছে।
যেভাবে ঘটনার সূত্রপাত: মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের নেতৃত্বে বিএনপির একটি প্রতিনিধি দল সকালে পাহাড়ধসে রাঙ্গামাটির ক্ষতিগ্রস্ত এলাকা পরিদর্শন ও ত্রাণ বিতরণের জন্য যাচ্ছিলেন। চট্টগ্রাম-কাপ্তাই সড়ক দিয়ে ১৫/১৬টি গাড়ির একটি বহর নিয়ে যাচ্ছিলেন তারা। গাড়িবহর রাঙ্গুনিয়ার উপজেলা সদর ইছাখালীতে পৌঁছালে ৩০-৪০ জনের একদল সশস্ত্র সন্ত্রাসী গাড়ির বহরের সামনে লাঠিসোটা নিয়ে অতর্কিতে হামলা চালায়। গাড়ি বহরের নেতৃবৃন্দ কিছু বুঝে উঠার আগেই তাদের গাড়ি ও তাদের ওপর হামলা করে। হামলায় বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের হাত কেটে যায় এবং আহত হন। এ ছাড়াও আহত হন বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য আমির খসরু মাহমুদ, বিএনপির কেন্দ্রীয় কমিটির স্বাস্থ্য বিষয়ক সম্পাদক ডাক্তার ফাওয়াদ হোসেন, সাংগঠনিক সম্পাদক মাহাবুর রহমান শামীম, চট্টগ্রাম নগর বিএনপির সাধারণ সম্পাদক আবুল হাশেম বক্কর। হামলার পর  গাড়ির বহর ও নেতৃবৃন্দ রাঙ্গামাটি যেতে না পেরে আবার চট্টগ্রামে চলে যান। রাঙ্গুনিয়া উপজেলা বিএনপির যুগ্ম আহ্বায়ক অধ্যাপক মহসিন চৌধুরী পুরো ঘটনা আওয়ামী লীগ, ছাত্রলীগ, যুবলীগের সন্ত্রাসীরা ঘটিয়েছেন বলে দাবি করেছেন। ঘটনার সময় তিনি রাঙ্গামাটি-রানীর হাট সড়কে  দলীয় নেতাকর্মীসহ অবস্থান করছিলেন। তিনি বলেন, বিএনপি মহাসচিব ওই সড়ক দিয়ে রাঙ্গামাটি যাওয়ার কথা ছিল। রানীর হাট এলাকায় আওয়ামী লীগ ও তার অঙ্গ সংগঠনের নেতাকর্মীরা জড়ো হওয়ায় তারা হামলার শিকার হওয়ার আশঙ্কায় সড়ক পরিবর্তন করে রাঙ্গুনিয়া দিয়ে রাঙ্গামাটি যাওয়ার পথে এ ন্যক্কারজনক ঘটনার শিকার হন। এ ঘটনায় প্রমাণ করে আওয়ামী লীগ সন্ত্রাস দিয়ে দেশ চালায়। এর জন্য একদিন আওয়ামী লীগকে মাশুল দিতে হবে। রাঙ্গুনিয়া উপজেলা বিএনপির সভাপতি অধ্যাপক কুতুব উদ্দিন বাহার বলেন, গাড়ির বহরে তিনি ছিলেন। গাড়ির বহর ইছাখালী পৌঁছালে ছাত্রলীগ যুবলীগের সশস্ত্র সন্ত্রাসীরা হামলা করে। রাঙ্গুনিয়া থানার অফিসার ইনচার্জ ইমতিয়াজ আহসানুল কাদের ভূঁইয়া হামলার সত্যতা নিশ্চিত করে বলেন, হামলার পর পরই ঘটনাস্থলে উপস্থিত হয়ে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনি। ঘটনা  তদন্ত পূর্বক ব্যবস্থা নেয়া  হবে। এর আগে বেশি কিছু বলতে চাচ্ছি না। প্রত্যক্ষদর্শী একটি সূত্র জানায়, রাঙ্গুনিয়া থানার অফিসার ইনচার্জ ইমতিয়াজ আহসানুলকে ঘটনার পর স্থায়ী কমিটির সদস্য আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী বলেন, আপনারা নিরাপত্তা দিতে ব্যর্থ হয়েছেন। দেশের মানুষ আপনাদের কাছে নিরাপদ নয়।
আমার কাছে দুঃস্বপ্নের মতো- ফখরুল: সংবাদ সম্মেলনে মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন, রাঙ্গামাটি যাওয়ার পথে আক্রমণের ঘটনা আমার কাছে দুঃস্বপ্নের মতো। এটা অবিশ্বাস্য। যদি আমাদের এই লেভেলে হামলা হয়, তাহলে সাংবাদিক ভাইরা আপনারা বুঝে নিন দেশের সাধারণ মানুষের অবস্থা কী? তিনি বলেন, আমরা সবেমাত্র রাঙ্গুনিয়া থানা পার হয়েছি। ইছাখালী বাজারে যাওয়ার পথে প্রচণ্ড বৃষ্টি শুরু হয়। কিছু দেখা যাচ্ছিল না। হঠাৎ করে আমরা দেখলাম ৩০-৪০ যুবক লাঠিসোটা, হকিস্টিক, রামদা এবং পাথর নিয়ে আমাদের আক্রমণ করে বসলো। কেন, কী কারণে জিজ্ঞেস করারও সময় পাইনি। মির্জা আলমগীর বলেন, হামলাকারীরা অনবরত হকিস্টিক ও লাঠি দিয়ে আঘাত করতে থাকে। এতে গাড়ির কাচ ভেঙে যায়। আমার সঙ্গে থাকা মাহবুবের রহমান শামীমের মাথায় আঘাত করে। তার মাথা ফুলে গেছে। আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরীর হাত রক্তাক্ত হয়েছে। রুহুল আলম চৌধুরীর ঘাড়ে আঘাত লেগেছে। আমারও আঘাত লেগেছে। ধিক্কার দেই আমি। মির্জা আলমগীর ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, কার কী আঘাত লেগেছে, ব্যক্তিগতভাবে সেটা বড় কথা নয়। এই আঘাত কী ভালো? গণতন্ত্রের প্রতি, বাংলাদেশের রাজনীতিতে যারা মুক্তচিন্তা করেন তারা নিশ্চয় এই কাজকে সমর্থন করবেন না। তিনি বলেন, এই আঘাত জাতীয়তাবাদী রাজনীতির ওপর। এই আঘাতের পর আজ আওয়ামী লীগের চরিত্র সবার সামনে প্রকাশ পেয়েছে। তাদের চরিত্র উন্মোচিত হয়েছে। আওয়ামী লীগ সব সময় গণতন্ত্রের কথা বলে। কিন্তু তারা গণতন্ত্রে বিশ্বাস করে না। সহনশীলতা বলতে তাদের মধ্যে কোনো কিছু নেই তা আবার প্রমাণ করলো। বিএনপি মহাসচিব বলেন, এটা কোনো পার্টি সফর নয়। আমরা জনসভা করতে যাচ্ছিলাম না। পাহাড়ধসে যারা নিহত হয়েছেন, তাদের সাহায্য করতে দলের পক্ষ থেকে যাচ্ছিলাম। তিনি বলেন, আওয়ামী লীগের উচিত ছিল জাতীয় শোক দিবস ঘোষণা করা এই ঘটনায়। তারা নিশ্চুপ। অনেক মানুষ মারা গেছেন। আর আমাদের কিনা প্রধানমন্ত্রী বিদেশে চলে গেলেন। কোথায় জবাবদিহি। আপনারাই বলুন। কার ইন্ধনে হামলা হয়েছে সেটা আমি সাংবাদিক ভাইদের খুঁজে বের করার অনুরোধ করছি। বিএনপি স্থায়ী কমিটির সদস্য আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী বলেন, রাঙ্গামাটি যাওয়ার পথে রাঙ্গুনিয়ার গোছরা এলাকা পার হওয়ার পরপরই ৩৫/৪০ জন যুবক অতর্কিত আমাদের গাড়িবহর লক্ষ্য করে বৃষ্টির মতো ইট-পাথর ছুড়ে মারতে থাকে। এক পর্যায়ে তারা লোহার রড ও লাঠিসোটা নিয়ে গাড়িবহরে চড়াও হয়। গাড়ির সামনে ছিলেন বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। এ সময় আমরা গাড়ি ঘুরিয়ে ফিরে আসার সময়ও পাইনি। হামলায় মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর, আমি, রুহুল আলম ও শামীমসহ বেশ ক’জন আহত হয়েছি। হামলাকারীরা সরকার দলীয় ক্যাডার। হঠাৎ তাদের এমন হামলায় আমরা হতভম্ব হয়ে পড়ি। আমাদের ওপর এভাবে হামলা হতে পারে তা ভাবতেও পারিনি। এর আগে সকালে মির্জা ফখরুল ইসলামের নেতৃত্বে বিএনপির একটি প্রতিনিধি দল ইউএস বাংলা’র একটি ফ্লাইটে ঢাকা শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমান থেকে চট্টগ্রাম শাহ আমানত আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে পৌঁছেন। সেখানে চট্টগ্রামের বিএনপি নেতারা তাদের স্বাগত জানান। সেখান থেকে গাড়ি নিয়ে রাঙ্গামাটিতে যাচ্ছিলেন। আমীর খসরু চৌধুরীর পাজেরোতে উঠেন মির্জা ফখরুল ইসলাম। গাড়িতে ছিলেন বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান রুহুল আলম চৌধুরী ও চট্টগ্রাম বিভাগীয় সাংগঠনিক সম্পাদক মাহাবুবুর রহমান শামীমও। তাদের পেছনে আরো প্রায় ১০টি গাড়ি ছিল। এসব গাড়িতে ছিলেন চট্টগ্রামের বিএনপি নেতারা। বিকেল ৪টা ২০ মিনিটে নভো এয়ারের একটি বিমানে চট্টগ্রাম ত্যাগ করেন তারা।
অভিযোগ প্রসঙ্গে হাছান মাহমুদ: এদিকে হামলার ঘটনাকে নাটক বলে অভিহিত করেছেন রাঙ্গুনিয়ার সরকারদলীয় এমপি ড. হাছান মাহমুদ। মানবজমিন-এর কাছে তিনি বলেন, আমি তো প্রথমে শুনেছিলাম তাদের গাড়ির বহর রাস্তায় সাধারণ লোককে চাপা দিয়ে চলে যাচ্ছিল। এরপর উত্তেজিত জনতা তাদের রাস্তার গতিরোধ করে। তিনি বলেন, আমি কিংবা আমার কোনো নেতা-কর্মী এই ঘটনার সঙ্গে জড়িত নয়। পাহাড়ধস হয়েছে ৪ দিন আগে। অথচ এখন তারা আহত লোকজনকে দেখতে যাচ্ছেন। আবার যাওয়ার পথে একটা ঘটনা তৈরি করে ইস্যু বানাতে চাচ্ছেন। আন্তরিকতা থাকলে রাঙ্গামাটি না গিয়ে চট্টগ্রাম কেন ফিরে গেলেন। জনগণ তাদের এসব নাটক সবই বোঝে।
ঘটনা তদন্ত হচ্ছে-পুলিশ সুপার: মির্জা ফখরুলের গাড়ি বহরে হামলার ঘটনার তদন্ত হচ্ছে জানিয়ে চট্টগ্রাম পুলিশ সুপার নুরে আলম মিনা বলেন, কাজটি ভালো হয়নি। যারাই করুক। আমরা এটা সমর্থন করি না। হামলা কেন করা হবে? এটা অন্যায় করা হয়েছে। তিনি বলেন, এখন পর্যন্ত কোনো অভিযোগ পাইনি তাদের কাছ থেকে। সন্ধ্যার পরও কোনো মামলা হয়নি। মামলা হলে অবশ্যই আমরা ঘটনা খতিয়ে দেখবো। কেউ মামলা করতে চাইলে মামলা নেয়া হবে। তিনি বলেন, যতটুক খবর নিয়েছি বিএনপি নেতারা মূল সড়ক দিয়ে যাননি। বিষয়টি পুলিশের নজর এড়িয়ে গেছে। ফলে রাস্তায় কোনো পুলিশ না থাকায় কেউ এটা করে ফেলেছে। পুলিশ জানলে অবশ্যই তাদের নিরাপত্তা দিতো।