ঈদে নাড়ির টানে বাড়ি ছুটছে মানুষ। কয়েকদিন আগে থেকেই শুরু হয়েছে ঈদযাত্রা। নগর প্রবাসী কর্মজীবী মানুষের বাড়ি ফেরা। তবে প্রতিবারের মতো এবারও যাত্রা পথে দুর্ভোগের সঙ্গী হয়েছে দুর্ঘটনা। সড়ক-মহাসড়কে ঘটছে প্রাণহানি। ঝরছে রক্ত। হচ্ছে আহত। ঈদযাত্রায় চলছে মৃত্যুর মিছিল। বাড়ি ফেরার পথে গতকাল শনিবার সকালে রংপুরে সিমেন্টবাহী ট্রাক উল্টে প্রাণ হারিয়েছেন স্বল্প আয়ের ১৭ যাত্রী। এবারের ঈদযাত্রায় সড়ক দুর্ঘটনায় এ পর্যন্ত একটি বড় ট্র্যাজিক দুর্ঘটনা। তবে বাংলাদেশ যাত্রী কল্যাণ সমিতির হিসেবে গত সোমবার থেকে গতকাল শনিবার পর্যন্ত ৬ দিনে কম সময়ে সড়কে দুর্ঘটনায় প্রাণ হারিয়েছে ৮১ জন। এ সময়ে আহত হয়েছে আরও ২২২ জন।
বাংলাদেশ যাত্রী কল্যাণ সমিতির মহাসচিব মো. মোজাম্মেল হক চৌধুরী বলেন, মানুষ স্বজনদের সঙ্গে ঈদের আনন্দ ভাগাভাগি করতে বাড়ি ছুটছে। দীর্ঘদিন পর গ্রামের বাড়িতে ঈদ করবে। কিন্তু যাত্রা পথের ভোগান্তি এবারও পিছু ছাড়লো না। তার ওপর দুর্ঘটনার আশঙ্কা তো রয়েছেই। তারা নিরাপদে বাড়ি গিয়ে আবার কর্মস্থলে ফিরতে পারবেন কি না সেই গ্যারান্টি নেই। এরই মধ্যে দুর্ঘটনায় প্রাণ হারিয়েছে ৮১ যাত্রী ও পথচারী। বাড়ি থেকে আবার কর্মস্থলে ফেরা পর্যন্ত পুরো ঈদ যাত্রায় হতাহতের সংখ্যা আরও বাড়তে পারে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করেন তিনি। ঈদের আগে কর্মস্থল থেকে ব্যাপকহারে মানুষের বাড়ি ফিরছে। এতে যাতায়াতের প্রধান মাধ্যম স্থল পথের সড়ক ও মহাসড়কে কয়েকগুণ বেড়েছে যানবাহনের চাপ। একই সঙ্গে চাপ বেড়েছে ট্রেন ও নৌকায়। চাপ আকাশ পথেও। এর মধ্যে যথারীতি সড়ক পথেই সিংহভাগ যাত্রী ও মালামাল পরিবহন হচ্ছে। দুর্ঘটনার প্রবণতাও সড়ক পথে কয়েকগুণ বেশি। আর স্বাভাবিক সময়ের চেয়ে ঈদের আগে-পরে সড়কে দুর্ঘটনাও বাড়ে কয়েকগুণ। দুর্ঘটনার কারণগুলোর মধ্যে রয়েছে, ভাঙাচোরা ও খানাখন্দে ভরা সড়ক-মহাসড়ক, দ্রুত গতির মহাসড়কে ধীর গতির নসিমন, করিমন, ভটভটি চলাচল, ঈদ উপলক্ষে বাড়তি আয়ের জন্য ফিটনেসবিহীন লক্কড়-ঝক্কড় গাড়ি চলাচল, চালকের ঘাটতি পূরণে হেলপারের গাড়ি চালানো, নির্ঘুম থেকে চালকদের বারবার দূরযাত্রার গাড়ি চালানো, অতিরিক্ত গতি, মালবাহী গাড়িতে যাত্রী পরিবহন, যানজট এড়াতে ওভারটেকিংয়ের চেষ্টা, রাস্তা ও ফুটপাতে দোকানপাট, বেপরোয়া গাড়ি চালানো, নিয়ন্ত্রণ হারানো, রাস্তায় ঘন ঘন মোড় ও স্পিড ব্রেকার, গাড়িতে ও ছাদে অতিরিক্ত যাত্রী পরিবহন, যখন তখন রাস্তা পারাপার ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য।
বাংলাদেশ যাত্রী কল্যাণ সমিতি সূত্র জানায়, এসবের কোনো না কোনো কারণে যাত্রাপথে দুর্ঘটনার শিকার হচ্ছে যাত্রীরা। গাজীপুর থেকে স্বল্প আয়ের যাত্রীরা গাড়ি না পেয়ে ও কম ভাড়ায় যাওয়ার সুযোগ পেয়ে সিমেন্ট বোঝাই ট্রাকে চেপে যাত্রা শুরু করে। কিন্তু রংপুরে পৌঁছার পর উল্টে যায় ওই ট্রাকটি। তাতে ঘটনাস্থলেই ১১ জনসহ মারা গেছে ১৭ হতভাগা। তাদের প্রতীক্ষায় থাকা পরিবারগুলো ঈদের আগেই উপার্জনক্ষম স্বজনের লাশ পেয়ে বাকরুদ্ধ। সড়ক পরিবহনে অব্যবস্থাপনা ও যথেচ্ছার কারণে ঈদ আনন্দের পরিবর্তে শূন্যতা ও হতাশা তাদেরকে গ্রাস করলো স্বজনহারাদের। এছাড়া এবারের ঈদ যাত্রায় কয়েকশ দুর্ঘটনার শিকার কবলে পড়েছে ঘরমুখো মানুষ। গত ২০শে জুন ঈদযাত্রা শুরুর আগের দিন থেকে গতকাল শনিবার সকাল ১০টা পর্যন্ত নিহত হয়েছেন ৮১ হতভাগা। এর মধ্যে অন্তত ১০ দুর্ঘটনায় মৃত্যু হয়েছে ৩ জন করে যাত্রী বা পথচারীর। বাকি দুর্ঘটনায় ১ বা ২ দুজন যাত্রী ও পথচারী প্রাণ হারান। ওই ৬ দিনে ২২২ জন আহত হয়েছে। তাদের অনেকের ঈদ কাটবে হাসপাতালে। পঙ্গুত্ব করেছেন কয়েকজন।
ঢাকা থেকে কক্সবাজারের চকরিয়ায় গ্রামের বাড়ি যাওয়ার পথে গত বৃহস্পতিবার দুর্ঘটনার শিকার হন আব্দুল সালাম। তিনি বলেন, ঢাকা থেকে রওনা দেয়ার পর মহাসড়কে অপর একটি গাড়ি আমাদের গাড়িকে পেছন থেকে ধাক্কা দেয়। এতে গাড়ি ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার পাশাপাশি আমি ও আমার স্ত্রী আহত হয়েছি। তাই চিকিৎসার জন্য যাত্রা বাতিল করে ৩ দিন পর ঈদের আগের দিন বাড়ি যাচ্ছি। গ্রামে মা-বাবাসহ সবাই তাকিয়ে আছে। তাই সড়কে দুর্ঘটনার ঝুঁকি ও ঝক্কি ঝামেলা থাকা সত্ত্বেও বাড়ি যেতে হচ্ছে। দায়িত্বরত বিভাগ ও কর্মকর্তা-কর্মচারীরা সজাগ হলে চালক এবং চালক হেলপারদের সচেতন করা গেলে তো দুর্ঘটনা কমে।
যাত্রী কল্যাণ সমিতির মহাসচিব মোজাম্মেল হক বলেন, সড়কে বিরাজমান ব্যাপক ব্যবস্থাপনা ও নৈরাজ্য এত বেশি দুর্ঘটনা ও হতাহতের মূল কারণ। অন্তত ঈদযাত্রায় গাড়ির অতিরিক্ত গতি, ফিটনেসবিহীন গাড়ি চলাচল, হেলপারদের যানবাহন চালানো, পণ্যবাহী গাড়িতে যাত্রী পরিবহনসহ কয়েকটি অনিয়ম কঠোর হাতে নিয়ন্ত্রণ করা গেলে এ সময় দুর্ঘটনা ৮০ ভাগ কমিয়ে আনা সম্ভব। কিন্তু চোখের সামনে এত এত প্রাণহানির পরও কাজের কাজ কিছুই হচ্ছে না।