বিশিষ্ট অভিনেতা ও সংগীতশিল্পী নাজমুল হুদা বাচ্চু আর নেই। গতকাল ভোর ৪টা ১৪ মিনিটে তিনি রাজধানীর স্কয়ার হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মৃত্যুবরণ করেন (ইন্নালিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন)। তার বয়স হয়েছিল প্রায় ৭৯। বাসায় হার্টঅ্যাটাক হলে তাকে নিকটস্থ হাসপাতাল স্কয়ারে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানেই চিকিৎসাধীন অবস্থায় তিনি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। গতকাল বাদ জোহর রাজধানীর গুলশানের আজাদ মসজিদে নামাজে জানাজা শেষে তাকে বনানী কবরস্থানে দাফন করা হয়। নাজমুল হুদা বাচ্চু চলচ্চিত্র এবং নাটকের অভিনেতা হিসেবেই পরিচিত। কিন্তু এর বাইরেও তিনি একজন সংগীতশিল্পী এবং সংগীত পরিচালকও ছিলেন। জীবনের শুরুটাই তার সংগীত দিয়ে। অথচ সংগীতশিল্পী না হয়ে তিনি হন অভিনেতা। বেশ উল্লেখযোগ্য সংখ্যক নাটক এবং চলচ্চিত্রে অভিনয় করলেও সব থেকে বেশি জনপ্রিয়তা তিনি পেয়েছেন হানিফ সংকেতের জনপ্রিয় ম্যাগাজিন অনুষ্ঠান ‘ইত্যাদি’র বিভিন্ন নাটিকায় কাজ করে। নাজমুল হুদা বাচ্চুর মতো একজন গুণী শিল্পী অভিনয় করতে করতে দর্শকের ভালোবাসায় নিজেকে পরিণত করেছিলেন একজন কিংবদন্তিতে। ছোটবেলা থেকেই গানের প্রতি তার ছিল অন্যরকম ভালোলাগা। আর তাই ১৯৫৮ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগে ভর্তি হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে গানেও নিজেকে সম্পৃক্ত করেন। তবে গানের চেয়ে তখন তিনি বেশি ব্যস্ত হয়ে উঠেন অভিনয়ে। এসএম হলের আবাসিক ছাত্র ছিলেন তিনি। হলের নাটক নির্দেশনা দেয়ার পাশাপাশি তিনি অভিনয়ও করতেন। ডাকসুরও অনেক নাটক নির্দেশনা দিয়েছেন তিনি। ছাত্র জীবনেই বাংলাদেশ টেলিভিশনের প্রয়াত প্রযোজক মনিরুল আলমের প্রযোজনায় একটি নাটকে অভিনয়ের মধ্যদিয়ে টিভি নাটকে তার অভিষেক ঘটে। এ নাটকে তার সহশিল্পী ছিলেন সৈয়দ আহসান আলী সিডনী ও আবদুল্লাহ আল মামুন। তবে শুরুর দিকে দেশ স্বাধীনের আগে যে নাটকে অভিনয় করে তিনি আলোচনায় আসেন সেটি হচ্ছে আবদুল্লাহ আল মামুনের প্রযোজনায় নির্মিত ধারাবাহিক ‘চাচা-ভাতিজা’। এতে চাচা চরিত্রে বাচ্চু এবং ভাতিজা চরিত্রে টেলিসামাদ অভিনয় করেছিলেন। এরপর থেকে বহু নাটকে তিনি অভিনয় করেছেন। চলচ্চিত্রে নাজমুল হুদা বাচ্চুর অভিষেক ঘটে একজন প্লে-ব্যাক সিঙ্গার হিসেবে। ১৯৬১ সালে মুস্তাফিজ পরিচালিত ‘হারানো দিন’ চলচ্চিত্রে প্রয়াত রবিন ঘোষের সুর সংগীতে ‘অভিমান করো না’ গানটিতে প্রথম কণ্ঠ দেন। এরপর তিনি ‘জোয়ার এলো’, ‘চান্দা’ , ‘ফির মিলিঙ্গে হাম দোনো’, ‘কার পাপে’সহ বহু চলচ্চিত্রে প্লে-ব্যাক করেন। বাবুল চৌধুরীর নির্দেশনায় তিনি প্রথম ‘আঁকাবাঁকা’ চলচ্চিত্রে অভিনয় করেন। নাজমুল হুদা বাচ্চু এ প্রসঙ্গে বলেছিলেন, ‘আঁকাবাঁকা’ চলচ্চিত্রে আলতাফ মাহমুদের সুর সংগীতে আমি একটি প্লে-ব্যাক করি। এতে তিনি আমারই গানে লিপসিং করতে বলেন। তার জোরাজুরিতেই আসলে অভিনয়ে আসা আমার। তা না হলে হয়তো অভিনেতা বাচ্চুর এভাবে অভিনয়ে আসা হতো না।’ এরপর ‘অচেনা অতিথি’,‘ সারেং বউ’, ‘সখি তুমি কার’, ‘জীবন মৃত্যু’, ‘স্বামী’, ‘গাংচিল’, ‘ভালো মানুষ’, ‘বাজিমাত’, ‘মাটির মায়া’, ‘কী যে করি’, ‘ঘর জামাই’, ‘আবার তোরা মানুষ হ’,‘সূর্য দীঘল বাড়ি’, ‘দুই বেয়াইয়ের কীর্তি’, ‘দরিয়া পাড়ের দৌলতী’, ‘রানওয়ে’ চলচ্চিত্রে অভিনয় করেন। সর্বশেষ তিনি তৌকীর আহমেদ পরিচালিত ‘অজ্ঞাতনামা’ চলচ্চিত্রে অভিনয় করেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে রাষ্ট্র বিজ্ঞানে অনার্স মাস্টার্স পড়াকালীনই তিনি বেতারের তালিকাভুক্ত কণ্ঠশিল্পী হন। ‘লালন ফকির’সহ অনেক নাটকের সংগীত পরিচালক হিসেবে কাজ করেছেন তিনি। প্রয়াত নায়ক বুলবুল আহমেদ নাজমুল হুদা বাচ্চুর আপন ফুফাতো ভাই। বুলবুল আহমেদ অভিনীত প্রথম নাটক ‘উল্কা’র নির্দেশক ছিলেন বাচ্চু। নাজমুল হুদা বাচ্চুর বাবা শামসুল হুদা ও মা আনোয়ারা হুদা। ১৯৩৮ সালের ১১ই জুলাই বাচ্চুর জন্ম। ১৯৬৪ সালের ২৬শে সেপ্টেম্বর তিনি লিনার সঙ্গে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন। তার তিন মেয়ে সানিয়া নাজ, সায়কা নাজ ও সাদিয়া নাজ।