হলি আর্টিজান। নজিরবিহীন এক জঙ্গি হামলার সাক্ষী। জঙ্গিদের তাণ্ডব আর তাদের নির্মূলে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর অভিযানে অনেকটা ক্ষত-বিক্ষত হয়ে যায় রেস্তরাঁটি। ঘটনার পর তদন্তের স্বার্থে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর নিয়ন্ত্রণে ছিল ভবনটি। পরে তা বুঝিয়ে দেয়া হয় মালিক পক্ষকে। এক সময়ের সাজানো গোছানো ওই বাড়িটি হামলার পর মানুষের কাছে পরিচিতি পায় একটি অভিশপ্ত বাড়ি হিসেবে। তবে হামলার এক বছর পর সংস্কার করে আগের অবস্থায় ফিরিয়ে আনা হয়েছে বাড়িটিকে।
বাড়িটি এখন ব্যবহার হচ্ছে আবাসিক ভবন হিসেবে। অবশ্য আবাসিক ও ক্লিনিকের জন্য অনুমোদন পাওয়ার পর নিয়ম ভেঙে প্লটটিতে গড়ে উঠেছিল ওই ব্যবসা প্রতিষ্ঠান। এখন তা আবার আবাসিকে ফিরেছে। স্ত্রীর উত্তরাধিকার সূত্রে পরিবার নিয়ে সেখানে
উঠেছেন সাদাত মেহেদী। বনানীর বাসা ছেড়ে স্ত্রী ও একমাত্র সন্তানকে নিয়ে সেখানে থাকছেন তিনি। তবে এক বছর আগের স্মৃতি চিহ্ন এখনও ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। অন্য দিকে গুলশান নর্থ এ্যাভিনিউর র্যাংগস আর্কেডের দ্বিতীয় তলায় ছোট পরিসরে চলছে হলি আর্টিজান বেকারি। ৫০০ বর্গফুটের ওই স্থানে তারা চালু করতে পারেনি রেস্তরাঁ। ততে নেই আগের সেই জৌলুসও। হলি আর্টিজান বেকারির অন্যতম স্বত্বাধিকারী সাদাত মেহেদী বলেন, গত ১লা জুলাই জঙ্গি হামলা ও বিদেশিদের খুন শুধু আমার ব্যবসা প্রতিষ্ঠান নয়, সারা দেশ ও পুরো জাতির অপূরণীয় ক্ষতি করে গেছে। এখন এখানে আর বেকারি নয়, সংস্কারের পর পরিবার নিয়ে থাকছি। আবাসিক ভবন হিসেবে রূপান্তরের কাজ শেষ পর্যায়ে। আর ক্ষত সারিয়ে ক্লিনিকও চালু করা হয়েছে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর প্রতি আমাদের চাওয়া দেশে যেন এমন কোন হামলা আর না হয়।
গতকাল সরজমিনে গিয়ে দেখা গেছে, গুলশান-২ এর ৭৯ নম্বর সড়কের এক প্রান্তে হলি আর্টিজানের প্লটের প্রধান ফটক খোলে দেয়া হয়েছে। যা এক বছর আগে জঙ্গি হামলার পর থেকে দীর্ঘদিন বন্ধ ছিল। নেই সেই সময়ের মতো প্রধান ফটকের বাইরে পুলিশ পাহারাও। লেকের পাশের ওই মনোরম প্লটের দু’পাশে যথারীতি দুটি ভবন দাঁড়িয়ে আছে। এক পাশে হলি আর্টিজান বেকারির সেই ভবন। অন্য পাশে লেক ভিউ ক্লিনিক ভবন। সামনের লনে সবুজ ঘাস। লেকে মৃদু বাতাসে হাজারো ঢেউয়ের ঝিলিমিলি। ঠিকঠাক চার পাশের সব পরিবেশ। তবে বেশ কিছু পরিবর্তন এসেছে হলি আর্টিজানের প্লট ও ভবনে। প্রধান ফটকের ভেতরে লোহার বেষ্টনীতে দু’ভাগ হয়েছে প্লট। আর্টিজানের ভবনের সামনে বসেছে আরো একটি নতুন গেট। ভবনটির সামনের অংশ আড়াল করে দাঁড়িয়েছে সবুজ রংয়ের উঁচু টিনের প্রাচীর। অপারেশন থান্ডার বোল্টের গুলি ক্ষত-বিক্ষত করেছিল দু’ভবনকেই। তাতে ভেঙ্গে ছিল লেকভিউ ক্লিনিকের কাচ। গুলির ক্ষত ছিল সামনের দেওয়ালে। লেক ভিউ ক্লিনিকের সেই ভাঙ্গা কাচ সরে উঠেছে নতুন কাচ। আস্তর এবং রংয়ে সেরেছে ক্ষতগুলোও। চালু হয়েছে ক্লিনিক।
২০১৬ সালের ১লা জুলাই শুক্রবার রাতে হলি আর্টিজান বেকারিতে সন্ত্রাসী হামলার ঘটনার পর প্রায় সাড়ে পাঁচ মাস তা আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর হেফাজতে ছিল। ধ্বংসস্তূপের বাইরে ছিল পুলিশ পাহারা। গত বছরের ১৩ই নভেম্বর ভবনের দায়িত্ব প্লটটির প্রকৃত মালিক প্রয়াত প্রফেসর ডা. সুরাইয়া জাবিনের দু’কন্যাকে হস্তান্তর করা হয়। এরপর শুরু হয় এর সংস্কার কাজ। ভবনের দ্বিতীয় তলার সুপরিসর কাচের স্থানে এখন উঠেছে কাঠের দেওয়াল। তাতে দ্বিতীয় তলা থেকে সামনের দিকে বেলকনিতে আসার দরজাও বসেছে। কাঠের দেওয়াল ও দরজা-জানালা বসেছে আগের বিক্রয় বা প্রদর্শনীর স্থানেও। সাদাত মেহেদী বলেন, জঙ্গি হামলাটি এখনও আমাদেরকে দুঃস্বপ্নের মতো তাড়ায়। সেদিন গুলির আঘাতে ভবনসহ প্রায় আসবাব ও জিনিসপত্র ক্ষতিগ্রস্ত হয়। তা সরিয়ে ফেলা হয়েছে। ধুয়ে-মুছে ও সব ক্ষতগুলো সারিয়ে বসবাসের উপযোগী করা হচ্ছে। তবে কাজ শেষ হতে আরো সময় লাগবে। এদিকে নতুন হলি আর্টিজানেও বিদেশিদের আনাগোনা বেশি। ২০১৪ সালের জুনে শুরু ও ২০১৫ সালের ফেব্রুয়ারিতে উৎপাদন ও বিপণন শুরু করেছিল প্রতিষ্ঠানটি। পরের বছর ২০১৬ সালের মাঝামাঝিতে ওই হামলার শিকার হয়। ছয় মাসের বেশি সময় বন্ধ থাকার পর চলতি বছরের ১০ই জানুয়ারি গুলশান-২ এ আবার যাত্রা শুরু করে হলি আর্টিজান। সুপারসপ গরমেট বাজারের এক অংশে ৫০০ বর্গফুটের আয়তনে ছোট পরিসরে এ পথচলা। হলি আর্টিজানের মালিক সাদাত মেহেদী ও নাজমুস সাদাত পরাগ। নতুন হলি আর্টিজানে বেকারি পণ্যের পাশাপাশি জুস বা বিভিন্ন ধরনের ফাস্টফুডসহ এখন প্রায় ৬৫ আইটেমের খাবার ম্যানু দেখা গেছে। আগের মতো কাপড় বিছিয়ে লনে শুয়ে থাকার ব্যবস্থা না থাকলেও এখানেও বিদেশিদের আনাগোনাই বেশি। সাদাত মেহেদী বলেন, আমাদের অনেক জিনিস নষ্ট হয়ে গেলেও ওভেনটি অক্ষত ছিল। সেটি আমরা এখন গুলশান-১ জাপানি রেস্টুরেন্ট ইজুমিতে বসিয়েছি। নতুন চালু করা আর্টিজানের জন্য বেকারি পণ্য তৈরি করছি। তবে ভবিষ্যতে আবারও হলি আর্টিজান রেস্তরাঁ খোলার পরিকল্পনা রয়েছে বলে জানান তিনি।
গতকাল হলি আর্টিজানের কাজে ব্যস্ত থাকতে দেখা কর্মকর্তা শাহরিয়ার ও রাকিব আহমেদ রকি বলেন, ওই দিনের ভয়াল স্মৃতি এখনও আমাদের কষ্ট দেয়। তা মনে করতে চাই না। হামলার পর রেস্তরাঁ বন্ধ হয়ে যাওয়ায় আমরা অনেক দিন কাজ ছাড়া ছিলাম। এখন আবার এখানে কাজ করছি। এখন রেস্তরাঁর পণ্য উৎপাদন ও পরিবেশন না হলেও বেকারির পণ্যে ভালোই চলছে।