লালমনিরহাটের আদিতমারী উপজেলার দু’শতাধিক বিদ্যালয় পড়ুয়া কোমলমতি শিশু ছাত্রছাত্রীর বিদ্যালয়ে যেতে ঝুঁকিপূর্ণভাবে নদী পারাপারের দৃশ্য দেখলে যে কেউ বিষ্মিত ও শঙ্কিত হতে বাধ্য হবে। শিক্ষার জন্য প্রতিদিন তারা ভেলা আর নৌকায় করে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে নদী পাড়ি দিয়ে নিয়মিত বিদ্যালয়ে যাতায়াত করছে।
সামান্য অসতর্ক হলেই ভেলা থেকে পড়ে গিয়ে সলিল সমাধি হবার ঝুঁকি থাকলেও জ্ঞানের তৃষ্ণা তাদের ও তাদের অভিভাবকদের এই ঝুঁকি নিতে বাধ্য করছে। শিক্ষা নিয়ে জাতীয় ও স্থানীয় পর্যায়ে বিভিন্ন মহল থেকে অনেক কথা বলা হয় প্রতিদিন। কিন্তু এই শিশু শিক্ষার্থীদের বিদ্যালয়ে যাওয়ার এই জীবনবাজী রাখা যুদ্ধ দেখবার যেন কেউ নেই। তিস্তা চরাঞ্চলের বালাপাড়া সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়ের দ্বিতীয় শ্রেনীর ছাত্রী আশা মণি (৮)। প্রতিদিন তাকে প্রায় ১০ কিলোমিটার নদীপথ পেরিয়ে একটি সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়ে আসতে হয় লেখাপড়ার জন্য। কিন্তু এত কষ্ট করে নদীপথ পেরিয়ে এলেও তার এতটুকু মনে ভয় নেই, বর্ষা মৌসুমে নৌকা পারাপারে।
আশা মণি উপজেলার মহিষখোচা ইউনিয়নের তিস্তা নদীর ওপারে চাঁদের চরের বাসিন্দা আশরাফুল আলমের মেয়ে। ২ বোন ও এক ভাইয়ের মধ্যে সবার বড় সে। কিন্তু আশা মণির স্বপ্ন লেখাপড়া করে তাকে বড় হতেই হবে। শুধু আশা মণিই নয়, এরকম প্রায় দু’শতাধিক শিক্ষার্থী চাঁদের চর থেকে তিস্তা নদী পেরিয়ে এপারে আসেন লেখাপড়া করতে।
মঙ্গলবার দুপুরে নৌকা পারাপারের সময় কথা হয় প্রতিনিধির সাথে। এসময় একই বিদ্যালয়ে অধ্যায়নরত প্রথম শ্রেনীর ছাত্রী রাহেনা, সুলতানা, দ্বিতীয় শ্রেনীর ছাত্র আসাদ বাবু ও দক্ষিণবালাপাড়া সিনিয়র ফাজিল মাদরাসার ২য় শ্রেনীর ছাত্র মিজানুর, সিরাজুল ইসলামসহ আরও অনেকের।
তারা জানান, তিস্তা নদীর ওপারে চাঁদের চরে বসবাসরত প্রায় শতাধিক পরিবার রয়েছে। কিন্তু এ চরে কোমলমতি শিশুদের শিক্ষার জন্য নেই কোন প্রাথমিক বিদ্যালয়। তাই শত কষ্ট হলেও এরা জীবনের ঝুঁকি নিয়ে নৌকা পারাপার হয়ে আসে লেখাপড়া করতে। তাদের ভাষ্য মতে, সকাল ৮ টার সময় বিদ্যালয়ে আসার জন্য বাড়ি থেকে বের হতে হয়। বিদ্যালয়ে আসতে তাদের ২ ঘন্টা সময় লেগে যায়। অনেক সময় একটু দেরি হলে নৌকা (খেয়া) ছেড়ে চলে যায় তাদেরকে। ফলে সেদিন আর বিদ্যালয়ে ক্লাস করা হয়না।
তবে নৌকা পারাপারে এদেরকে বছর শেষে ঘাটের টাকা দিতে হয়। মাঝে মধ্যে বর্ষা মৌসুমে নৌকা পারাপারে তাদের ভীষণ ভয়ও লাগে বললেন, আসাদ বাবু। চাঁদের চরে বসবাসরত অনেক পরিবার তিস্তা নদীর ভয়ে তাদের সন্তানকে বিদ্যালয়ে পাঠাতে অনীহা। ফলে শিক্ষার আলো থেকে বঞ্চিত থেকে যাচ্ছে এসব শিশুরা।
নৌকার মাঝি সিরাজুল ইসলাম জানান, তিস্তার উত্তাল ঢেউ সামলে অনেক কষ্টে কোমলমতি শিশুদের প্রতিদিন পারাপার করতে হয়। তিস্তার চরাঞ্চলে শিশুদের জন্য একটি বিদ্যালয় স্থাপন করা হলে সেখানে বসবাসরত পরিবারের ছেলে-মেয়েরা সবাই লেখাপড়া শিখতে পারত।
বালাপাড়া সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক সাইফুল ইসলাম জানান, তার বিদ্যালয়টি তিস্তা নদীর পাশে আর অধিকাংশ শিক্ষার্থীই চরাঞ্চলের।
চরাঞ্চলের শিশুদের কথা বিবেচনা করে সেখানে একটি বিদ্যালয় স্থাপন করা হলে শিক্ষার আলো থেকে কোন শিশুই বঞ্চিত হত না।
উপজেলা সহকারী প্রাথমিক শিক্ষা অফিসার নাসির উদ্দিন জানান, চরাঞ্চলের শিক্ষার্থীরা অনেক পরিশ্রমী ও মেধাবী। তিনি আরও জানান, চর স্থায়ী না হওয়ায় সেখানে কোন বিদ্যালয় স্থাপন করা সম্ভব হচ্ছে না।