তাহিরপুর উপজেলা সদর থেকে ইঞ্জিনচালিত নৌকায় যেতে লাগে বেশ সময়। কোথাও এক ঘণ্টা, কোথাও দেড় ঘণ্টা, কোথাও আধা ঘণ্টা। রতনশ্রী, নিশ্চিন্তপুর, আনন্দনগর, দুর্লভপুর, শরিফপুর ও দুমাল গ্রাম। মূল জনপদ থেকে বিচ্ছিন্ন দারিদ্র্যপীড়িত এলাকা। বোরো ধান এসব এলাকার মানুষের প্রধান জীবিকা। সেই বোরো নিয়ে গেছে বন্যায়। এখন বেঁচে থাকার লড়াই করছেন এসব এলাকার মানুষ। ঘরে ভাত নেই। ত্রাণ পর্যাপ্ত নয়। মাছ ধরে কোনো রকমে জীবিকা নির্বাহ করার চেষ্টা করছেন। এনজিওর কিস্তি আর দাদনের টাকা শোধ করতে গিয়ে তারা পড়ছেন আরো দুর্বিপাকে।
রতনশ্রী, নিশ্চিন্তপুর, আনন্দনগর, দুর্লভপুর, শরিফপুর, দুমাল প্রতিটি এলাকায় নৌকা থেকে নামার পরই জড়ো হয়েছেন গ্রামের অনেক মানুষ। হাতে কাগজ কলম থাকায় অনেকে ভেবেছেন ত্রাণ নিয়ে গেছি। দু’একজনের নাম জানতে চাওয়ায় অন্যরা ভেবেছেন নাম লেখাতে এসেছি। খুব আবদারের সঙ্গে ‘আপা আমার নামটা লেখেন’ বলে ঘিরে ধরেছেন। আবার কেউ কেউ হাত ধরে বলেছেন, ‘তোমারে মা ডাকবো আমার নামটা লেখ।’ এইসব গ্রামের হাজার হাজার মানুষ আধপেটে দিন পার করছেন। জানেন না পরের দিনে হাঁড়িতে ভাত উঠবে কিনা।
টাঙ্গুয়ার হাওরের ঠিক পাশেই দুমাল গ্রামের বাসিন্দা নাদিরা বেগম। স্বামী ওমর ফারুক ও সাত ছেলেমেয়েসহ নয় জনের সংসার। এত বড় সংসারে প্রতিদিন দুই বেলা খাবার যোগাড় করতেই হিমশিম খাচ্ছেন তারা। জায়গা-জমি বলতে নিজেদের ভিটেটুকুই। তবে ভিটেও ভাঙা শুরু হয়েছে। হাওরে বৃষ্টি হলেই ঢেউয়ের পানি ঘরে চলে আসে। আর টিনের চাল মেরামত করতে না পারায় ঘরের বিভিন্ন জায়গায় বৃষ্টির পানি পড়ে। নাদিরা বলেন, স্বামী-সন্তান নিয়ে তিন বেলা পেটভরে খেতে পাই না। ঘরের চাল মেরামত করবো কি দিয়ে? হাওরে নিজেদের জমি না থাকলেও অন্যের জমিতে বর্গা চাষ করেছিলেন তারা। ফসলের আগে মহাজনি সুদ আর কিস্তিতে ঋণ নিয়েছেন ৭০ হাজার টাকা। সুদের টাকা না দিতে পারায় মহাজন বিচার ডেকেছেন বলে জানান নাদিরা। এদিকে প্রতি সপ্তাহে ৪৫০ টাকা করে কিস্তি নিতে আসেন এনজিও কর্মীরা। নাদিরা বেগম বলেন, ‘হাওর ডুবে এক মুঠ ফসলও ঘরে তুলতে পারি নাই। সরকারের ত্রাণের চাল এবং টাকা পাই না। কিভাবে বাঁচবো সেটাও জানি না। এদিকে হাওরে ঢেউ বেশি থাকায় প্রতিদিন চিংড়ি ধরা যায় না। কোনো আয় নাই সংসারে।’
অজুহা আক্তারের ঘরের অবস্থাও একই রকম। বৃষ্টি হলে উত্তাল হাওরের ঢেউয়ের পানি ঘরে চলে আসে। একবেলা রুটি আর একবেলা ভাত খেয়ে কোনোভাবে পার করছেন দিন। পাচ্ছেন না সরকারের দেয়া ত্রাণের চাল এবং টাকা। হাওরে জমি নেই। অন্যের জমিতে চাষ করে ফসল ডুবে এখন দিশাহারা।
একই গ্রামের মাহমুদা বলেন, কাল ভাত খাবো কোথা থেকে সেটা জানি না। ফসল ডুবে গেছে কিন্তু কিস্তির আর সুদের টাকা গলায় ঝুলে আছে। এখন যদি কিস্তি না দেই সামনে আর ঋণ পাবো না। সরকার যদি আমাদের ফসলের সময় ঋণ দিতো তাহলে কিস্তির চিন্তা থাকতো না। আমরা এখন আধ পেট খেয়ে থাকি তবুও কিস্তির টাকা দিতে হয়।
নাদিয়া, অজুহা কিংবা মাহমুদা নয়- হাওর এলাকার প্রতিটি গ্রামের মানুষের জীবনের গল্প একই রকম। একদিকে খাবার সংকট অন্যদিকে কখন ঢেউ এসে ঘর নিয়ে যাবে সেই দুশ্চিন্তায় নির্ঘুম রাত কাটাচ্ছেন এসব এলাকার মানুষ।
দুর্লভপুর গ্রামের আবেদননেছা বলেন, নিজের জমি নেই। বর্গা চাষ করেছিলাম ঋণ নিয়ে। এখন ঋণের বোঝা মাথায় নিয়ে বসে আছি। এদিকে ঘরে চাল নাই। গ্রামের কয়েকজন ত্রাণ পেলেও তিনি ত্রাণ থেকে বাদ পড়েছেন। দশ টাকা কেজি দরে চাল পেতেন আবেদননেছা। বলেন, পাঁচ মাস আগে দশ টাকা কেজি করে চাল পাইছি। যে কারণে আমাকে ত্রাণ দেয়া হয়নি। ওই চালও পাচ্ছি না পাঁচ মাস হলো।
একই গ্রামের সেজোনা বলেন, স্বামীর নামে ত্রাণ আসছে তাই আমি পাইনি। কিন্তু আমার স্বামী তো অন্য বউ নিয়ে থাকে ১৫ বছর থেকে। আমাকে ঘর থেকে বের করে দিছে তাহলে আমি কেন বাদ পড়ছি। পাঁচ ছেলেমেয়ে নিয়ে খুবই কষ্টে আছি আমি। নিরুপায় হয়ে চৌদ্দ বছরের ছেলেকে বউলাই নদীতে পাঠাই মাছ মারার জন্য। সাহায্য না করলে আমরা বাঁচবো কিভাবে?