শর্ত না মেনে শিক্ষক নিয়োগ, শিক্ষকের বিরুদ্ধে শিক্ষকের ৫৭ ধারায় মামলা, মতের মিল না থাকায় ব্যবস্থাসহ গত সপ্তাহের কয়েকটি ঘটনায় আবারও আলোচনায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। এনিয়ে আলোচনা-সমালোচনায় লিপ্ত শিক্ষক-শিক্ষার্থী ও সংশ্লিষ্টরা। চাপা ক্ষোভ বিরাজ করছে অনেকের মধ্যে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে অনেকেই ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ ঘটাচ্ছেন। গত ১২ই জুলাই রাতে বিশ্ববিদ্যালয়ের সিন্ডিকেট সভায় ইন্টারন্যাশনাল বিজনেস বিভাগে সাত জনের বিপরীতে নয়জনকে শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ দেয়া হয়েছে। সিলেকশন কমিটির সুপারিশ অনুযায়ী তাদের নিয়োগ দেয়া হয়। নিয়োগপ্রাপ্তরা হলেন- মোহাম্মদ মোবারক হোসেন, মৌরি মেহতাজ, হাজেরা আক্তার, কাজী রমা জামশেদ, ফাহমিদা মুস্তাফিজ, একরামুল হুদা, পল্লবী বিশ্বাস, আসমিনা আক্তার এবং অনামিকা দত্ত। বিশ্ববিদ্যালয়ের নিয়ম অনুযায়ী, ব্যবসায় শিক্ষা অনুষদে শিক্ষক হিসেবে নিয়োগপ্রাপ্ত হতে হলে যোগ্যতা হিসেবে চারবছর মেয়াদি বিবিএ এবং এমবিএ ডিগ্রি থাকতে হবে। এই দুই পরীক্ষায় সিজিপিএ ৪.০০ এর মধ্যে ৩.৭৫ থাকতে হবে। একই সঙ্গে এসএসসি ও এইচএসসি পরীক্ষায় জিপিএ ৫.০০ এর মধ্যে ন্যূনতম ৪.২৫ থাকতে হবে। তবে এদের মধ্যে হাজেরা আক্তার, ফাহমিদা মুস্তাফিজ ও অনামিকা দত্ত ছাড়া বাকি ছয়জন শর্ত পূরণ না করেই শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ পেয়েছেন। এদিকে বিশ্বধর্ম ও সংস্কৃতি বিভাগেও শূন্য পদে দুই জনের বিপরীতে আরো দুইজন বাড়িয়ে চারজনকে নিয়োগ দেয়া হয়েছে। এভাবে অতিরিক্ত শিক্ষক নিয়োগ দেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের আইনের পরিপন্থি। কারণ ২০১৩ সালের ১৭ই ফেব্রুয়ারি অনুষ্ঠিত সিন্ডিকেট সভায় সিদ্ধান্ত হয়, ‘এখন হইতে সকল বিভাগ/ইন্সটিটিউটে শিক্ষক নিয়োগের ক্ষেত্রে বিজ্ঞাপনের অতিরিক্ত একজনের বেশি নিয়োগ করা যাইবে না। বিজ্ঞাপনের অতিরিক্ত নিয়োগের বিষয়ে সিএন্ডডি কমিটির সুপারিশ সিলেকশন বোর্ডের সভা অনুষ্ঠিত হইবার পূর্বেই পাঠাইতে হইবে।’ কিন্তু এ সিদ্ধান্তকে আমলে না নিয়ে সিন্ডিকেট সভা অতিরিক্ত নিয়োগ দেয়। এ বিষয়ে ভিসি অধ্যাপক ড. আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিক বলেন, সিলেকশন কমিটির সুপারিশের ভিত্তিতে নিয়োগ দেয়া হয়েছে। সেক্ষেত্রে একের অধিক নিয়োগ দেয়া যায়। বুধবারের ওই সভায় সহকর্মীদের সঙ্গে বাজে আচারণ করার অভিযোগে অর্থনীতি বিভাগের সহকারী অধ্যাপক ড. রুশাদ ফরিদীকে বাধ্যতামূলক ছুটি, পপুলেশন সায়েন্সেস বিভাগের অধ্যাপক বিল্লাল হোসাইনের বিরুদ্ধে পিএইচডি শেষ না হওয়ায় এবং দুর্নীতি দমন কমিশনের অভিযোগের প্রেক্ষিতে ফার্মেসি বিভাগের অধ্যাপক ড. আবু সারা শামসুর রইফের বিরুদ্ধে তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। তবে অভিযোগের বিষয়ে অধ্যাপক বিল্লাল হোসাইন বলেন, পিএইচডি শেষ করতে এখনো আমার হাতে সময় রয়েছে। তাহলে কেন তদন্ত কমিটি করা হয়েছে জানতে চাইলে তিনি বলেন, সম্পূর্ণ রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে এটি করা হয়েছে। গত সিনেট নির্বাচনে ভিসি বিরোধী প্যানেলে ছিলাম বলে তদন্ত কমিটি করা হয়েছে। তিনি বলেন, ওই সময় যারা ভিসি বিরোধী ছিল তাদের প্রায় সবাইকেই নানাভাবে হেনস্তা করা হচ্ছে। সর্বশেষ বুধবার সন্ধ্যায় বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের অধ্যাপক ফাহমিদুল হকের বিরুদ্ধে বিভাগের অপর এক শিক্ষক অধ্যাপক ড. আবুল মনসুর আহম্মদ ৫৭ ধারায় মামলা দায়ের করেন। অথচ রোববার বিভাগের শিক্ষার্থীরাই তথ্য ও যোগাযোগপ্রযুক্তি আইনের ৫৭ ধারা বাতিলের দাবিতে মানববন্ধন করে। সেখানে বিভাগের শিক্ষার্থীদের পাশাপাশি শিক্ষকরাও উপস্থিত ছিলেন। অধ্যাপক ফাহমিদুল হক উচ্চ আদালতে ৫৭ ধারা বাতিল চেয়ে রিটকারীদের মধ্যে অন্যতম। মামলার এজাহারে অধ্যাপক ড. আবুল মনসুর আহম্মদ উল্লেখ করেন, বিভাগের একটি ক্লোজড গ্রুপে অধ্যাপক ফাহমিদুল হক আমাকে উদ্দেশ্য করে মিথ্যাভাবে উল্লেখ করেন যে, আমার কারণেই নাকি মাস্টার্স পরীক্ষার ফলাফল দীর্ঘসূত্রতায় পড়েছে এবং অধ্যাপক ড. গীতির মতো একজন অধ্যাপককে বিপদে ও হয়রানির মধ্যে ফেলেছি এবং একাডেমিক পরিবেশকে কলুষিত করেছি। সমকাল পত্রিকায় পরীক্ষা সংক্রান্ত রিপোর্ট নির্মাণে ভূমিকা রেখেছি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সামান্য একটি বিষয়কে জটিল করার ব্যাপারে অসামান্য অবদান রেখেছি। শত্রুতামূলক উদ্যোগ গ্রহণ করেছি। এবং এ কাজ সিনেট সদস্য হিসেবে কন্ট্রোলার অফিস ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসনকে সঙ্গে করে করেছি। যা সম্পূর্ণ মিথ্যা ও ভিত্তিহীন। ফেসবুকের যে গ্রুপটিতে এটা প্রকাশিত হয়েছে, তাতে ৬৯ জন সদস্য রয়েছেন। ওই গ্রুপের অনেক সদস্যের কাছে তার মানসম্মানের হানি হয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের সঙ্গে আলোচনা করে কিছুটা বিলম্বে এজহারটি দায়ের করেন বলে উল্লেখ করেন তিনি। শিক্ষকের বিরুদ্ধে শিক্ষকের মামলা করার বিষয়টি ছড়িয়ে পড়লে বিভাগের বেশ কয়েকজন শিক্ষার্থী সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে স্ট্যাটাস দিয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করেন। কারও নাম উল্লেখ না করেই সাংবাদিক ও বিভাগের প্রাক্তন শিক্ষার্থী রিয়াদুল করিম লিখেছেন, শ্রদ্ধাভাজনদের রাজনীতিতে নতুন সংযোজন মামলাবাজি। নারী কেলেঙ্কারিতে ফাঁসানোর চেষ্টার চেয়ে এটা অবশ্য ভালো। শ্রদ্ধাভাজনদের একটা অংশ আবার নিজেদের মধ্যেই গুতুগুতি সীমাবদ্ধ রাখেন না। অপছন্দের শিক্ষার্থীদের দেখে নেয়ার হুমকি দেন, কেউ কেউ ভাইবা-ইনকোর্সে চাপিয়ে দেন। এরসঙ্গে এখন থেকে তারা শিক্ষার্থীদের বিরুদ্ধে মামলা করার বিষয়টিও বিবেচনায় নিতে পারেন। অপর এক প্রাক্তন শিক্ষার্থী ইকবাল মাহমুদ রানা লিখেছেন, বিশ্ববিদ্যালয়ের মাস্টার হওয়ার খায়েস ছিল। কিন্তু রেজাল্ট কাঙ্ক্ষিত মান ছুঁইছুঁই করেও ছুঁইলো না। সে আশায় গুড়েবালি। কিন্তু ফাহমিদুল হক স্যারকে দেখলে এখনো শিক্ষক না হওয়ার আফসোস জাগে। আবার অন্য কয়েকজন শিক্ষক আছেন যাদের কার্যকলাপ দেখলে মনে হয় ওইসব নোংরা জায়গায় না গিয়ে ভালোই করেছি। আমি কাছ থেকে দেখেছি গবেষণার ব্যাপারে স্যার দারুণ দক্ষ এবং শিক্ষক হিসেবে প্রচুর অনেস্ট। কালাকানুনে ফাহমিদ স্যারের বিরুদ্ধে মামলা তার মর্যাদা বরং আরো বাড়িয়ে দিলো। স্যারের পাশে আছি। আর ভ্যাগিস প্রাক্তন হয়ে গেছি। প্রিয় বিভাগের এই ছেঁচড়ামি কাছ থেকে দেখতে হচ্ছে না। এ বিষয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি অধ্যাপক ড. আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিক বলেন, তারা দুইজনই আমাদের সহকর্মী। এ নিয়ে আমি কোনো মন্তব্য করতে চাই না। তবে একটি আহ্বান থাকবে, শিক্ষকরা যখন ফেসবুক বা সোশ্যাল মিডিয়া ব্যবহার করবেন, তখন দায়িত্বশীলতার সঙ্গে ব্যবহার করবেন। অন্যের সম্পর্কে অশোভন কিছু শিক্ষকরা করবেন, এটা কাম্য নয়। তিনি বলেন, সবাই স্বাধীনভাবে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম, গণমাধ্যম ব্যবহার করবেন। কিন্তু মনে রাখতে হবে স্বাধীনতা মানে স্বেচ্ছাচারিতা নয়। রাস্তায় বের হলে আমি মাঝ রাস্তায় হাঁটতে পারি না। ট্রাফিক আইন মেনে আমাকে চলতে হবে। ঠিক তেমনি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে লিখতে হলে কিছু নিয়মকানুন রয়েছে। সেগুলো মেনেই লিখতে হবে। খেয়াল রাখতে হবে অন্যের স্বাধীনতায় যাতে হস্তক্ষেপ না ঘটে।
এসব কর্মকাণ্ডের কারণে বিশ্ববিদ্যালয়ের মর্যাদা ক্ষুণ্ন হচ্ছে কিনা জানতে চাইলে বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ভিসি অধ্যাপক ড. এসএমএ ফায়েজ বলেন, বিশ্ববিদ্যালয় একটি পরিবার। এই পরিবারে কোনো সমস্যা হলে এর মধ্যেই আলোচনা করে সমাধান করার চেষ্টা করা উচিত। আইনি প্রক্রিয়ায় যাওয়া না যাওয়া সেটা ভিন্ন হিসাব। তিনি বলেন, শিক্ষকদের মধ্যে সমস্যা না হওয়ার কথা। কিন্তু এখন হচ্ছে। তাই বিশ্ববিদ্যালয়ের অভিভাবকের উচিত আলোচনার মাধ্যমে সমস্যাগুলোর সমাধান করা।