মাঠে তাদের ছোট গ্যালারি। আর স্টেডিয়ামটি নির্মিত হয়েছে গাড়ি পার্কিংয়ের স্থানে। তবে দক্ষ ফুটবলার তৈরির কারখানা হিসেবে ক্রীড়াবিশ্বের নজর কেড়েছে মোনাকো। এবারের দলবদলে ইতিমধ্যে খেলোয়াড় বিক্রি বাবদ ফরাসি ক্লাব এএস মোনাকোর আয় ১৫৫ মিলিয়ন পাউন্ড। আর দলবদল শেষে অঙ্কটা বেড়ে যেতে পারে অনেকটা। ইউরোপিয়ান সংবাদমাধ্যমের খবর, মোনাকোর ১৮ বছর বয়সী ফরাসি স্ট্রাইকার কিলিয়ান এমবাপ্পের জন্য রেকর্ড ১৬০ মিলিয়ন পাউন্ড দিতে রাজি স্প্যানিশ ক্লাব রিয়াল মাদ্রিদ। আর মোনাকোর ২১ বছর বয়সী ফরাসি মিডফিল্ডার থমাস লেমারের জন্য ৪৫ মিলিয়ন পাউন্ডের প্রস্তাব রেখেছে ইংলিশ ক্লাব আর্সেনাল। সদ্য রেকর্ডগড়া ৫২ মিলিয়ন পাউন্ডের ট্রান্সফারে মোনাকো থেকে ইংলিশ জায়ান্ট ম্যানচেস্টার সিটিতে পাড়ি দেন ফরাসি ডিফেন্ডার বেনজামিন মেন্দি। বিশ্বের সবচেয়ে দামি ডিফেন্ডারের মর্যাদা পাচ্ছেন ২৩ বছর বয়সী এ ফুটবলার। এতে তিনি পেছনে ফেলেন ব্রাজিলিয়ান ডিফেন্ডার ডেভিড লুইজ ও ইংলিশ ফুল-ব্যাক কাইল ওয়াকারকে। ২০১৩ সালে চেলসি থেকে ৫০ মিলিয়ন পাউন্ডের ট্রান্সফারে ফরাসি ক্লাব প্যারিস সেইন্ট জার্মেইতে পাড়ি দেন ডেভিড লুইজ। একই অঙ্কের ট্রান্সফারে এবার টটেনহ্যাম হটস্পার থেকে ম্যানচেস্টার সিটির জার্সি গায়ে তোলেন ওয়াকার। মোনাকোর খেলোয়াড় পালন, বিক্রি ও শূন্যস্থান পূরণে সাফল্যের নেপথ্য কারণ কী?
উচ্চাকাঙ্ক্ষা
ব্যবসার সহজ নীতি সবসময় মেনে চলে না মোনাকো। ২০১২ সালে ১০০ মিলিয়ন ইউরোতে মোনাকো ক্লাব কিনে নেন রুশ ধনকুবের দিমিত্রি রিবোলভলেভ। আর মোনাকোর নতুন মালিকের মাথায় ছিল ভিন্ন চিন্তা। ফ্রান্সের দ্বিতীয় বিভাগ ফুটবল লীগের তালিকায় ১৮ নম্বরে অবস্থান করছিল তখন দলটি। তবে ক্লাবের নতুন মালিকের প্রথম টার্গেট ছিল প্রথম বিভাগে উন্নতি ও শীর্ষ ক্লাব প্যারিস সেইন্ট জার্মেইয়ের সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বিতা। পরের বছর মোটা অঙ্কের অর্থ ব্যয় করেন রিবোলভলেভ। কলম্বিয়ান স্ট্রাইকার রাদামেল ফ্যালকাওকে দলে ভেড়ান স্প্যানিশ জায়ান্ট অ্যাটলেটিকো মাদ্রিদ থেকে ৫০ মিলিয়ন পাউন্ডের ট্রান্সফারে। ৬০ মিলিয়ন পাউন্ডে এফসি পোর্তো থেকে দলে টানেন কলম্বিয়ান ফরোয়ার্ড হামেস রদ্রিগেজ ও পর্তুগিজ মিডফিল্ডার জোয়াও মুটিনহোকে। এসব কাজে দিলো মোনাকোর। তারকার হাট পিএসজির পাশে নজরে এলো মোনাকোর জৌলুসটাও। তবে মাত্র ৯০০০ দর্শক ধারণক্ষম স্টেডিয়াম, টেলিভিশন সম্প্রচার থেকে মামুলি আয় ও ছোট স্পন্সর চুক্তি নিয়ে ব্যয়বহুল একটি ক্লাবের টিকে থাকা কঠিন। তাদের আয়ের চেয়ে ব্যয়ের পরিমাণটা ছিল বহুগুণ বেশি। এতে ইউয়েফার ফিন্যানশিয়াল ফেয়ার প্লে বিধি মেনে চলা অসম্ভব হয়ে পড়েছিল তাদের।
জোরদার কৌশল
২০১৪ বিশ্বকাপে দারুণ নৈপুণ্য নিয়ে সবার নজর কাড়েন আসরের সর্বোচ্চ গোলদাতা হামেস রদ্রিগেজ। আর ওই সময়ের বিশ্ব রেকর্ডে চতুর্থ সর্বোচ্চ ৭১ মিলিয়ন পাউন্ডের ট্রান্সফারে রদ্রিগেজকে দলে ভেড়ায় স্প্যানিশ জায়ান্ট রিয়াল মাদ্রিদ। আর মোনাকো রদ্রিগেজের ছেড়ে যাওয়া স্থান পূরণ করতে দলে টানে অপেক্ষাকৃত অপরিচিত ফুটবলার লেমারকে। ফরাসি দল ক্যাঁ থেকে লেমারকে দলে পেতে মোনাকোর খরচ হয় মাত্রই ৩.২ মিলিয়ন পাউন্ড। এএস মোনাকো পথ পেয়ে যায়। নতুন পন্থা গ্রহণ করে তারা। প্রতিশ্রুতিশীল তরুণ ফুটবলারদের খুঁজে নিয়ে তাদের উন্নতিতে মনোযোগী হয় ক্লাবটি। তরুণদের তাদের নৈপুণ্য দেখানোর সুযোগ করে দেয় তারা। পরে তাদের বিক্রি করে দিয়ে ধ্যান দেয় পরের প্রজন্ম গঠনে।
দুই মৌসুম আগে প্রথম ব্যাচের খেলোয়াড়দের বিক্রি করে মোনাকোর ব্যাংক একাউন্টে জমা পড়ে ১৬১ মিলিয়ন পাউন্ড। ২০ বছর বয়সী ফরাসি স্ট্রাইকার অ্যান্থনি মার্শিয়ালকে তারা ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডের কাছে বিক্রি করে ৭১.৬ মিলিয়ন পাউন্ডে। অথচ মাত্রই ১২ মাস আগে মার্শিয়ালকে অলিম্পিক লিঁও থেকে ৪ মিলিয়ন পাউন্ডে কিনে নেয় তারা। মোনাকো থেকে বেলজিয়ান মিডফিল্ডার ইয়ানিক কারাসকো অ্যাটলেটিকো মাদ্রিদে, তিউনিশিয়ান ডিফেন্ডার আইমেন আবদুননুর ভ্যালেন্সিয়ায় ও ফরাসি লেফট-ব্যাক লেনভিন কুরাজাওয়া পাড়ি দেন প্যারিস সেইন্ট জার্মেইতে। আর ফরাসি মিডফিল্ডার জেওফ্রি কন্ডোবিয়া মোনাকোর জার্সি গায়ে খেলেন এক মৌসুম। ২০১৫ চ্যাম্পিয়ন্স লীগে ইংলিশ জায়ান্ট আর্সেনালকে বিদায় করার পথে বল পায়ে নৈপুণ্য দেখান মোনাকোর এ মিডফিল্ডার। পরের মৌসুম ইতালিয়ান ক্লাব ইন্টার মিলানের কাছে তাকে বেঁচে দেয় ২৫ মিলিয়ন পাউন্ডে। এতে মোনাকো মুনাফা দেখে ১২ মিলিয়ন পাউন্ডের। যদিও ওই সময় সমালোচনা ওঠে- ফুটবল স্পিরিট নষ্ট করছে মোনাকো।
গত মৌসুমে ফরাসি লীগ ওয়ানে ২৯ ম্যাচে ১৫ গোল পান মোনাকোর ফরাসি স্ট্রাইকার কিলিয়ান এমবাপ্পে। এবার মোনাকোর বড় বাজিটাও তিনি। মোনাকোর বিশেষত্বটা তাদের দারুণ সুযোগ-সুবিধা সমৃদ্ধ ফুটবল একাডেমি। ফ্রান্সের সেরা ফুটবল একাডেমির মর্যাদা পাচ্ছে তারা। প্রতিবছর এ একাডেমিতে তারা খরচ করে ৭.১ মিলিয়ন পাউন্ড। এবং তাদের পদ্ধতিও আলাদা। বয়সভিত্তিক প্রত্যেক গ্রুপের সেরা ফুটবলাররা পায় এক বছরের উপরের গ্রুপে খেলার সুযোগ। এতে খেলোয়াড়রা দ্রুত উন্নতি করে।
সেরা স্কাউটিং
যুব পর্যায়ে ইউরোপের সেরা স্কাউটিং নেটওয়ার্ক মোনাকোর। কেবল প্যারিসেই তাদের রয়েছে ৬টি স্কাউট। অন্য কোনো ক্লাবের এমন নেই। তারা তৃণমূল থেকে খেলোয়াড় খুঁজে আনে। মাত্র ১৪ বছর বয়সে এমবাপ্পেকে সহজেই দলে টানে তারা। কারণ তখন এমবাপ্পের পরিবারের কাছে এএস মোনাকোই অনেক ব্যাপার ছিল। লেমার, তিয়েমু বাকায়োকো, জিবরিল সিদিবে ও বেনজামিন মেন্দিকেও দলে টানে তারা নামমাত্র মূল্যে। মোনাকো ফুটবলারদের এজেন্টদের পরামর্শও গুরুত্ব দিয়ে শোনে। ২০১৪তে এজেন্ট হোর্হে মেন্ডেসই খুঁজে বের করেন বারনার্দো সিলভাকে। কে জানতো তিন বছরের ব্যবধানে বেনফিকা থেকে ৪৩ মিলিয়ন পাউন্ডের ট্রান্সফারে ম্যানচেস্টার সিটিতে পাড়ি দেবেন বারনার্দো সিলভা।
মোনাকোর দায়িত্ব রয়েছে ‘পারফেক্ট কোচ’ লিওনার্দো জারদিমের কাঁধে। ১৭ বছর পর জারদিমের অধীনেই ফরাসি লীগ ওয়ান শিরোপা ঘরে তোলে মোনাকো। তারুণ্য নির্ভর দল নিয়ে জারদিম দেখান সর্বশেষ ইউয়েফা চ্যাম্পিয়ন্স লীগে সেমিফাইনালের কৃতিত্ব। তিনি আক্ষরিক অর্থেই একজন শিক্ষক। কোচের ভূমিকা নেয়ার আগে মাদেইরা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্পোর্টস ডিগ্রি অর্জন করেন তিনি। মোনাকোর প্রজেক্ট উন্নয়নে ভূমিকা ছিল সাবেক দুই কোচ লুইস ক্যাম্পোস ও আন্তোনিও করডনেরও।
আর্ট অব সেল
রিবলভলেভ ও ক্লাবের ভাইস-প্রেসিডেন্ট ভাদিম ভাসিলিয়েভ জাত ব্যবসায়ী। কমদামে কিনে বেশি দামে বিক্রি করাটাই তাদের প্রথম কথা। ফুটবলে এসেও তাদের দর্শনটা ধরে রেখেছেন তারা। তারা চতুর, ভয়ডরহীন ও স্পষ্টভাষী। কিভাবে দাম তুলতে হয়, জানেন তারা। ২০১৫তে দু’পক্ষের ঘনঘন আলোচনা হলেও ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডকে তারা ঝুলিয়ে রাখে দলবদলের শেষ দিন পর্যন্ত। এবার মেন্দিকে নিয়ে একই ঘটনা। ম্যানচেস্টার সিটিকে ঝুলিয়ে রেখে সদ্য সম্পাদন করে মেন্দির ট্রান্সফার। গত মৌসুমে ১১.৪ মিলিয়ন পাউন্ডে অলিম্পিক মাসেই থেকে মেন্দিকে দলে ভেড়ায় মোনাকো। আর সিটির কাছে তারা মেন্দিকে বিক্রি করলো ৫২ মিলিয়ন পাউন্ডে। একই ঘটনা বাকায়োকোর বেলায়ও। ২০১৪ সালে ৬.৩ মিলিয়ন পাউন্ডে রেন থেকে মোনাকোয় পাড়ি দেন বাকায়োকো। এবার মোনাকো থেকে বাকায়োকো লন্ডনে উড়িয়ে নিতে চেলসির খরচ পড়লো ৪০ মিলিয়ন পাউন্ড।