টাঙ্গাইল সদর ও দেলদুয়ার নিয়ে নানা আলোচনা। নির্বাচনকে ঘিরে সরব রাজনীতি। সদর উপজেলা নিয়ে গঠিত টাঙ্গাইল-৫ আসন। আর এ আসন থেকে যিনি এমপি নির্বাচিত হন কাকতালীয়ভাবে সেই প্রার্থীর দলই সরকার গঠন করে। প্রথম সংসদ থেকে দশম সংসদ পর্যন্ত একই চিত্র। তবে, পঞ্চম সংসদ নির্বাচনে জাতীয় পার্টি থেকে মেজর জেনারেল (অব.) মাহমুদুল হাসান  জয়লাভ করলেও পরবর্তী সময়ে তিনি বিএনপিতে যোগদান করেন। সেই হিসেবে টাঙ্গাইল-৫ সরকার গঠনেরই আসন। ১৯৭৩ সালে প্রথম সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগ দলীয় প্রার্থী আবদুল মান্নান জয়লাভ করেছিলেন। এরপর যথাক্রমে  বিএনপির আবদুর রহমান (১৯৭৯), জাতীয় পার্টির মীর মাজেদুর রহমান (১৯৮৬), জাতীয় পার্টির মেজর জেনারেল (অব.) মাহমুদুল হাসান ( ১৯৮৮), জাতীয় পার্টি, পরবর্তীতে বিএনপির মে.জে (অব.) মাহমুদুল হাসান (১৯৯১), বিএনপির মে.জে (অব.) মাহমুদুল হাসান (১৯৯৬, ১৫ই ফেব্রুয়ারি), আওয়ামী লীগের আবদুল মান্নান (১৯৯৬, ১২ই জুন), বিএনপির  মাহমুদুল হাসান (২০০১), জাতীয় পার্টির আলহাজ আবুল কাশেম (২০০৮) এবং আওয়ামী লীগের আলহাজ ছানোয়ার হোসেন (২০১৪) পর্যায়ক্রমে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়েছেন।
আগামী নির্বাচন আওয়ামী লীগ ও বিএনপি প্রার্থীর মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকলেও দু’টি দলেই রয়েছে কোন্দলের সমস্যা। আওয়ামী লীগের কোন্দল গোপনে হলেও বিএনপির এ সমস্যা তীব্র ও প্রকট। এই সেদিনও  আওয়ামী লীগের জেলার রাজনীতি নিয়ন্ত্রণ করতেন শহরের আলোচিত খান পরিবার। খান পরিবারের চার ভাইয়ের জ্যেষ্ঠ আমানুর রহমান খান রানা এমপি মুক্তিযোদ্ধা ফারুক আহমেদ হত্যা মামলায় বর্তমানে কারাগারে রয়েছেন। একই মামলায় অপর তিন ভাই যথাক্রমে ব্যবসায়ী নেতা জাহিদুর রহমান খান কাকন, টাঙ্গাইল পৌরসভার সাবেক মেয়র ও শহর আওয়ামী লীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক সহিদুর রহমান খান মুক্তি ও ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় কমিটির সাবেক সহ-সভাপতি সানিয়াত খান বাপ্পা রয়েছেন পলাতক। চার ভাইকেই দল ও অঙ্গ সংগঠন থেকে বহিষ্কার করা হয়েছে। জেলা আওয়ামী লীগের নতুন কমিটি সম্মেলনের মধ্য দিয়ে গঠিত হলেও সঙ্গত কারণে কমিটিতে তাদের স্থান হয়নি। খান পরিবার জেলার রাজনীতি থেকে আউট হলেও রয়ে গেছে তাদের অনেক অনুসারী। অপর দিকে ইন হয়েছেন খান পরিবারের বিপক্ষ কৃষক শ্রমিক জনতা লীগ থেকে আসা বর্তমান পৌর মেয়র জামিলুর রহমান মিরন এবং জার্মান প্রবাসী দুই ভাই গোলাম কিবরিয়া ও তানভীর হাসান। এই দুই ভাই বড় মনি ও ছোট মনি হিসেবে পরিচিত। বড় মনি ও ছোট মনি এক সময় মুরাদ সিদ্দিকীর ঘনিষ্ঠজন ছিলেন। আগামী নির্বাচনে দলের প্রার্থী খান পরিবারের মনমতো না হলে তার অনুসারীরা প্রার্থীর বিপক্ষে কাজ করবে এ রকম ধারণা পোষণ করেন অনেকেই। এই আসনের বর্তমান এমপি আলহাজ ছানোয়ার হোসেন। অনেকটা ক্লিন ইমেজের এই এমপি আগামী নির্বাচনেও মনোনয়ন চাইবেন। খান পরিবারের সমর্থক হিসেবে তার ক্লিন ইমেজে প্রলেপ দেয়ার চেষ্টা হলেও তিনি মূলধারায় নিজের অবস্থানকে ধরে রাখতে সচেষ্ট রয়েছেন।
বহুদিন থেকে আওয়ামী লীগে যোগ দেয়ার চেষ্টা করছেন সিদ্দিকী পরিবারের অন্যতম সদস্য মুরাদ সিদ্দিকী। এর আগে তিনি এই আসন থেকে পরপর তিনবার নির্বাচন করেছেন। প্রতিবারই পেয়েছেন উল্লেখযোগ্য ভোট। গত ৫ই জানুয়ারির নির্বাচনে জেলার ৮টি আসনের মধ্যে তিনটিতে নির্বাচন হয়েছিল। তার একটি টাঙ্গাইল-৫। স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে প্রতিকূলতার মধ্যেও মুরাদ সিদ্দিকী প্রায় ষাট হাজার ভোট পেয়ে দ্বিতীয় হয়েছিলেন। তার আগে নবম নির্বাচনে তিনি ৪০৪৫৬ ভোট পেয়ে তৃতীয় হয়েছিলেন। মুরাদ সিদ্দিকীর সমর্থকদের ধারণা তার প্রাপ্ত ভোটগুলো আওয়ামী লীগ-বিএনপি-জাপার বাইরের। তাকে যদি আওয়ামী লীগ থেকে মনোনয়ন দেয়া হয় তাহলে দলীয় ভোটের সঙ্গে তার ভোট যুক্ত হলে তিনি অনায়াসে এমপি নির্বাচিত হবেন। আওয়ামী লীগ থেকে তিনি এখনো কোনো গ্রিন সিগনাল পাননি। এছাড়া প্রার্থী হিসেবে পৌর মেয়র জামিলুর রহমান মিরন ও সদর উপজেলা চেয়ারম্যান এডভোকেট খোরশেদ আলমের নাম শোনা যাচ্ছে। মনোনয়নের ব্যাপারে জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি ও জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান সাবেক এমপি ফজলুর রহমান খান ফারুকের সমর্থন যার প্রতি থাকবে তিনিই লড়বেন এ আসন থেকে। এ কারণে এখনো স্পষ্ট নয় শিকে ছিঁড়বে কার ভাগ্যে।
অপর দিকে বিএনপির কোন্দল এতটাই তীব্র যে আগামী নির্বাচনে এর বিরূপ প্রতিক্রিয়া হতে পারে। এ কোন্দল নবগঠিত জেলা বিএনপির কমিটিকে কেন্দ্র করে। সম্প্রতি ঘোষিত কমিটির বিপক্ষে অবস্থান নেয়া বিদ্রোহীদের সঙ্গে প্রায়ই ঘটছে ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়ার ঘটনা। এ ব্যাপারে জেলা বিএনপির সাধারণ সম্পাদক এডভোকেট ফরহাদ ইকবাল বলেছেন, ‘তথাকথিত বিদ্রোহীরা পুলিশের ছত্রছায়ায় গোলযোগের চেষ্টা করছে। পুলিশও তাদের পক্ষে বাদী হয়ে মামলা করছে। ইতিমধ্যে চার বিদ্রোহীকে দল থেকে বহিষ্কার করা হয়েছে।’ মূলধারা বিএনপির নেতা ও কর্মীদের মতে কমিটিকে নিয়ে সামান্য কোন্দল হলেও আগামী নির্বাচনে প্রার্থিতা নিয়ে কোনো সমস্যা হবে না। আগামী নির্বাচনে বিএনপি থেকে প্রার্থী হবেন মেজর জেনারেল (অব.) মাহমুদুল হাসান। মনোনয়ন চাইবেন, কেন্দ্রীয় যুবদলের সাধারণ সম্পাদক সুলতান সালাউদ্দিন টুকু, বিএনপির কেন্দ্রীয় নির্বাহী কমিটির সদস্য খন্দকার আহসান হাবিব, জেলা বিএনপির সিনিয়র সহ-সভাপতি ছাইদুল হক ছাদু ও সাধারণ সম্পাদক ফরহাদ ইকবাল। তবে দলের নেতা ও কর্মীরা মনে করেন মাহমুদুল হাসানই মনোনয়ন পাবেন। ইতিপূর্বে এ আসন থেকে তিনি চারবার এমপি নির্বাচিত হয়েছেন। তারা মনে করেন দলে যতই কোন্দল থাকুক মাহমুদুল হাসানের নিজস্ব ঘরানার কর্মী  ও সমর্থকরা বরাবরের মতো এবারো তার পক্ষে কাজ করে তার জয়কে নিশ্চিত করবে।
জাতীয় পার্টি থেকে মনোনয়ন চাইবেন ক্লিন ম্যান হিসেবে পরিচিত আলহাজ আবুল কাশেম, সাবেক উপজেলা চেয়ারম্যান আবদুস সালাম চাকলাদার ও জেলা জাপার সাধারণ সম্পাদক মোজাম্মেল হক। নবম নির্বাচনে আবুল কাশেম মহাজোটের প্রার্থী হিসেবে জয়লাভ করেছিলেন। জাপা এবার জোটবদ্ধ হয়ে নির্বাচন করলে এ আসনের দাবিদার হিসেবে দল আবুল কাশেমের প্রার্থিতা চাইবে। একক কিংবা পৃথক জোট করলেও আবুল কাশেমই এ আসনের প্রার্থী হবেন।
এদিকে স্বতন্ত্র প্রার্থী হবেন সৈয়দ খালেদ মোস্তফা। তিনি দীর্ঘদিন থেকে মানুষের দ্বারে দ্বারে গিয়ে ভোট চাইছেন।
নির্বাচনের হাওয়ায় ভেসে বেড়াচ্ছেন আওয়ামী লীগের নেতা ও কর্মীরা। দলীয় কার্যক্রম থেকে শুরু করে ব্যক্তিগত অনুষ্ঠানও তারা বর্ণাঢ্যভাবে আয়োজন করে। অপরদিকে হামলা-মামলায় পর্যুদস্ত বিএনপি এখনো গা ঝাড়া দেয়নি। তবে সুষ্ঠু নির্বাচনের আশায় নীরবে প্রতীক্ষা করছে বিএনপির সমর্থকেরা।