আমাদের ২১ আগস্ট যেহেতু অমাবস্যা আছে এবং একটা জোয়ারের আশঙ্কা আছে। মোহনাগুলো প্রায় ভরে থাকবে; সে কারণে পানি নেমে যেতে পারবে না। আপনারা দেখছেন, আমাদের চৌহালীর (সিরাজগঞ্জ) এ অঞ্চলে ৯৮-এর বন্যার সীমানা ছাড়িয়ে গেছে প্রায় সব জায়গায়। আমরা নৌকা নিয়ে যে জায়গায় গেলাম, সেটা একটা অফিস ছিল এবং এখান থেকে আমাদের প্রায় কমপক্ষে আধা কিলোমিটার হেঁটে আসতে হতো নদীতে ওঠার জন্য; এখন একদম আমরা ঘর থেকে নদীতে উঠলাম। এর থেকে বোঝা যায়, পানির অবস্থা ভালো নয়; বিশেষ করে মধ্যাঞ্চলে মানিকগঞ্জ থেকে শুরু করে শরীয়তপুর পর্যন্ত বন্যা পরিস্থিতির আরও অবনতি হতে পারে।
প্রথম আলো: আমাদের যে সড়ক বা নানা রকম স্থাপনা নদী অববাহিকায় করা হয়েছে, এটা কি পানি নেমে যাওয়ার ক্ষেত্রে বাধা তৈরি করছে?
গওহার নঈম ওয়ারা: কিছু কিছু জায়গায় সড়কগুলো এখন প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করছে; কারণ সড়কে যথেষ্ট পানি বেরিয়ে যাওয়ার মতো মুখ খোলা নেই। আসলে ফ্লাডপ্লেন এর মূল কারণ হচ্ছে পানিটা বেরিয়ে যাওয়ার একটা ব্যবস্থা রাখা; সেটা নেই। আমাদের অভ্যন্তরীণ অনেকগুলো ত্রুটিপূর্ণ ব্যবস্থাপনার কারণে সমস্যা হচ্ছে। এই পানিটা একটু কমার সঙ্গে সঙ্গে স্রোত আরও প্রবল বেগে হতে থাকবে। এই ভাঙনে গ্রামগুলোর টিকে থাকাটা কঠিন হয়ে যাবে। বেশির ভাগ গ্রামই একদম শেষ হয়ে যাবে।
প্রথম আলো: আপনি বলছেন বড় একটা ধাক্কা তখন আবার আসবে।
গওহার নঈম ওয়ারা: হ্যাঁ আসবে; নদীতে তখন ভাঙন শুরু হবে এবং এটা শুরু হবে অমাবস্যার পর।
প্রথম আলো: এ সময়ে গণমাধ্যম ও কমিউনিটির কী করা উচিত?
গওহার নঈম ওয়ারা: সরকার এটা খুব সহজে করতে পারে; কারণ ইউনিয়ন পরিষদ পর্যন্ত লিস্ট তৈরি করা আছে কোথায় কোন মানুষ আছে; সবচেয়ে গরিব মানুষ, প্রান্তিক মানুষেরা আছে এবং যাদের ঘরবাড়ি ভেঙে যাচ্ছে, তাদের তালিকা আপডেট করা যায়। তাদের একটা প্রোটেকশন মেকানিজমের মধ্যে আনাটা খুব জরুরি। কারণ, এদের নতুন করে জায়গা চিহ্নিত করে ঘরবাড়ি তৈরি করতে হবে। সবচেয়ে সমস্যায় পড়বে শিশুরা যারা স্কুলে পড়াশোনা করছে; ক্লাস ফাইভে যারা পড়ে, তাদের নভেম্বরে কিন্তু পিএসসি পরীক্ষা। এইটে যারা পড়ে, তাদেরও পরীক্ষা। পরীক্ষা যারা মিস করবে, তারা ড্রপ আউট হয়ে যাবে। তাদের জন্য দ্রুত একটা ব্যবস্থা ঘোষণা করা উচিত। যারা এলাকা ছাড়ছে, তারা নিকটবর্তী স্কুলে যেন বসতে পারে, পরীক্ষা দিতে পারে—এ ব্যবস্থা করা উচিত। মানে সে যেন তাঁর স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসতে পারে, সেই প্রক্রিয়া শুরু করা দরকার।
১০ টাকা দিয়ে সবার ব্যাংক অ্যাকাউন্ট খোলা হয়েছিল। ত্রাণের টাকাটা খুব সহজে তাদের ব্যাংক অ্যাকাউন্ট পাঠিয়ে দেওয়া যায়। এমন হতে পারে খুব কাছে ব্যাংক নেই; এটা তাদের ইলেকট্রনিক মানি ট্রান্সফার যে পদ্ধতি আছে; তাদের মাধ্যমে টাকাটা সুষ্ঠুভাবে প্রদান করা সম্ভব, যদি মেম্বারদের (ইউপি সদস্য) এর জন্য দায়বদ্ধ করা হয়। তাহলে তাদের কাছে টাকা পৌঁছানো সম্ভব। কিন্তু মুশকিল হচ্ছে এগুলোর (নগদ অর্থসহায়তা) ছবি তোলা যাবে না, এর কোনো ক্যামেরা ভ্যালু নেই এবং প্রচার হবে না। কিন্তু এটাই মানুষের দরকার। মানুষ টাকা চায় এবং টাকাটা যত সহজে তাঁর কাছে পৌঁছাতে পারে, সেটার ব্যবস্থা করা দরকার।
এখন ডিজিটালের কথা বলছি, আমরা ইলেকট্রনিক ব্যবস্থাপনার কথা বলছি—এই ব্যবস্থাপনায় এটা খুব সহজে করা সম্ভব।
আমরা যখন আরেকটু দূরবর্তী এলাকায় যাব, সেখানে একটা বাজার আছে। এখানে এই বন্যার মধ্যেও বাজার চালু আছে এবং সেখানে সবকিছু পাওয়া যাচ্ছে। শুধু মানুষের দরকার তার কেনার জন্য টাকাটা। সেটা যদি থাকে, সে তার পছন্দের মতো জিনিস কিনতে পারবে।
প্রথম আলো: বন্যা পরবর্তী কর্মসূচি কীভাবে মানুষের উপযোগী করা যায়?
গওহার নঈম ওয়ারা: সেই প্রক্রিয়ার মধ্যেও আমি বলব; যেমন ধরেন কৃষি ও গবাদিপশু রক্ষণাবেক্ষণের বিষয়টিকে মাথায় রাখতে হবে এবং এখন থেকেই শুরু করতে হবে। আপনি দেখছেন, মানুষ যারা পানিবন্দী হয়ে আছে, তারা প্রত্যেকে গরু-ছাগল নিয়ে একটা বিপৎসংকুল অবস্থার মধ্যে আছে। তাদের খাবার নেই, গরুকে কী খাওয়াবে—এটা আমাদের মাথায় রাখতে হবে। বন্যার পানি যখন নেমে যাবে, তখন যেন তারা সঙ্গে সঙ্গে কৃষিতে যেতে পারে; কারণ আমন তো হলো না; আমনের পরে আমরা আরও দেড় মাসের মতো সময় পাব রবিতে যাওয়ার। মাঝামাঝি ছোট করে কোনো রবি করা যায় কি না; শাকসবজি-জাতীয় রবি, যেটা খুব দ্রুত হবে। তারপর হয়তো সে রবিতে গেল। এই পরিকল্পনাগুলো আমাদের এখন নিতে হবে।
প্রথম আলো: বাঁধ পুনর্নির্মাণ বা অনেক স্কুল-কলেজের অবকাঠামো পুনর্নির্মাণ; সেখানে মানুষের কর্মসংস্থানের সুযোগটা কীভাবে তৈরি হবে, যাতে তাদের রোজগারটা আবার নিয়মিত হয়?
গওহার নঈম ওয়ারা: এখানে দুই রকমের চিত্র আসছে।
এ অঞ্চলের মানুষ যেমন তাদের ঘরগুলো খুলে নিয়ে অন্য জায়গায় যাচ্ছে; সেখানে তারা যেন এটা করতে পারে। এটাও কাজের বিনিময়ে খাদ্যের আওতায় নিয়ে আসা যায়। পরে শুকনোর সময় যখন আমাদের বাঁধগুলো পুনর্নির্মাণের কথা হবে, সেখানে এই মানুষগুলোকে অগ্রাধিকার দিতে হবে। তারা বাঁধগুলো যেন নিজেদের পরিকল্পনামতো তৈরি করতে পারে এবং নিজেদের রক্ষণাবেক্ষণের ব্যাপারটা তারা নিশ্চিত করতে পারে। বাঁধের ওপরেও মানুষকে পুনর্বাসন করা সম্ভব; কিন্তু পানি উন্নয়ন বোর্ডের এই কথাটা পছন্দ হবে না। বাংলাদেশের অনেক জায়গায় এটা করা হয়েছে; পানি উন্নয়ন বোর্ডই করেছে এবং সেটার পুনরাবৃত্তি করা যায়। তাদের যদি সেই ব্যবস্থাপনার মধ্যে আনা যায়, যে মানুষ বাঁধের ওপর বসবাস করবে এবং রক্ষণাবেক্ষণ করবে; তাহলে আমরা অদূর ভবিষ্যতে একটি অন্য বাংলাদেশ দেখতে পারব।সুত্র: প্রথম আলো