বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের (পিডিবি) কম খরচে বিদ্যুৎ উৎপাদনের সুযোগ থাকা সত্ত্বেও বেশি দামে বিদ্যুৎ উৎপাদন করছে। স্বল্পতম ব্যয়ে উৎপাদন কৌশল গ্রহণ না করায় ভোক্তারা বছরে ৭ হাজার ৮৪৩ কোটি ৮৩ লাখ টাকা ক্ষতির শিকার হচ্ছে বলে জানিয়েছে কনজ্যুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ক্যাব)। এই অবস্থায় পাইকারি বিদ্যুতের দাম বৃদ্ধির পাশাপাশি খুচরা বিদ্যুতের দাম বাড়ানোর প্রস্তাব দিয়েছে বিতরণকারী সংস্থা কোম্পানিগুলো । গতকাল বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশনে (বিইআরসি) প্রথমবারের মতো বিদ্যুতের দাম কমানো নিয়ে গণশুনানিতে ক্যাব এসব তথ্য তুলে ধরে। ক্যাব বিদ্যুতের দাম বাড়ানোর প্রস্তাবকে অযৌক্তিক দাবি করে বিদ্যুতের দাম কমানোর জন্য আবেদন করে বিইআরসি’র কাছে। সংগঠনটির আবেদনের প্রেক্ষিতে এই গণশুনানির আয়োজন করে বিইআরসি। এর আগে গত ২৫শে সেপ্টেম্বর বিদ্যুতের পাইকারি দাম বাড়াতে পিডিবির প্রস্তাবের ওপর শুনানি অনুষ্ঠিত হয়েছিল। এরপর ৪ঠা অক্টোবর পর্যন্ত বিতরণ সংস্থা- কোম্পানিগুলোর খুচরা দামবৃদ্ধির ওপর শুনানির আয়োজন করা হয়।
এদিকে শুনানিতে বিদ্যুতের দাম বৃদ্ধি নয়, বরং দাম কমানোর দাবি জানিয়েছেন ভোক্তারা। তারা বলেন, এই মুহূর্তে দেশে বিদ্যুতের দাম বাড়ালে মানুষের অসুবিধা হবে। গণপরিবহনে বিশৃঙ্খলা তৈরি হবে। মানুষ এমনিতেই নিত্যপণ্যের ঊর্ধ্বমুখী দাম নিয়ে কষ্টে আছেন। ক্যাব’র যুক্তির কাছে পিডিবি অবশেষে বলতে বাধ্য হয়েছে, বিদ্যুতের দাম কমানো সম্ভব। তবে কিছু শর্ত জুড়ে দিয়েছে সংস্থাটি। বিইআরসি’র মাধ্যমে বিদ্যুতের দাম সমন্বয়ের ব্যবস্থা করলে এবং ৪ হাজার ৩০০ টাকা ভর্তুকি পাওয়া গেলে হ্রাসকৃত মূল্যে বিদ্যুৎ সরবরাহ করা সম্ভব হবে বলে পিডিবি’র কর্মকর্তারা মনে করেন। ক্যাব বলেছে, পিডিবি প্রতি ইউনিট পাইকারি বিদ্যুতের দাম গড়ে ৭২ পয়সা বাড়ানোর প্রস্তাব করেছে এবং তা ৫৭ পয়সা বৃদ্ধির পক্ষে মত দিয়েছে নিয়ন্ত্রক সংস্থা বিইআরসি’র কারিগরি কমিটি। অথচ বিদ্যমান পরিস্থিতিতে বিদ্যুৎ উৎপাদনের খাতভিত্তিক খরচগুলো সঠিকভাবে সমন্বয় এবং স্বল্পতম ব্যয়ে বিদ্যুৎ উৎপাদিত হলে প্রতি ইউনিট পাইকারি বিদ্যুতের দাম ৬ পয়সা কমানো যায়।
ক্যাবের জ্বালানি বিষয়ক উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. এম শামসুল আলম হিসাব কষে দেখিয়ে দেন, কিভাবে বিদ্যুতের দাম না বাড়িয়ে কমানো যায়। তিনি বলেন, সরকারি বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোকে বসিয়ে রেখে বেসরকারি কোম্পানির বিদ্যুৎকেন্দ্রে গ্যাস সরবরাহ করা হচ্ছে, উৎপাদন খরচ বেড়ে যাচ্ছে। সরকার যদি সাশ্রয়ী মূল্যে উৎপাদনে প্রাধান্য দিতো, তাহলে ৭ হাজার ৮৪৩ কোটি টাকা সাশ্রয় হতো। তাহলে এখন বিদ্যুতের দাম বাড়ানোর প্রয়োজন হতো না। বরং ইউনিটপ্রতি ১ দশমিক ৫৬ টাকা কমানো যেতো। তিনি বলেন, সরকার কমদক্ষ এবং বেসরকারি রেন্টাল বিদ্যুতে গ্যাস দিয়ে বিদ্যুতের উৎপাদন খরচ বাড়াচ্ছে। অথচ পিডিবি’র বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলো গ্যাসের অভাবে অপেক্ষাকৃত কম খরচের বিদ্যুৎ উৎপাদন করতে পারছে না। ওই গ্যাস পিডিবি পেলে কম খরচে বিদ্যুৎ উৎপাদন করা যায়। প্রভাবশালী ও ব্যবসায়ীদের একটি গোষ্ঠীর স্বার্থ রক্ষা করতে গিয়ে জনগণের ওপর খরচের বোঝা চাপিয়েই যাচ্ছে সরকার। এই দুর্নীতি বন্ধ এবং নীতিগত ভুল সংশোধন করতে হবে। তিনি বলেন, কর্তাব্যক্তিদের দুর্নীতি, অনিয়ম ও নীতিগত ভুলের মাশুল বিদ্যুতের দামবৃদ্ধির মাধ্যমে দিতে হচ্ছে জনগণকে। অন্যায্যভাবে উৎপাদন খরচ বাড়িয়ে বিদ্যুতের দাম বাড়ানো অন্যায় ও অযৌক্তিক। শামসুল আলম বিদ্যুৎখাতের নানা অসঙ্গতি তুলে ধরে বলেন, বিনা দরপত্রে অমীমাংসিতভাবে যে বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলো নির্মিত হচ্ছে সেগুলোতে কারিগরি ও আর্থিক দুর্নীতি হচ্ছে। এগুলো নির্মাণে যে ব্যয় দেখানো হচ্ছে প্রকৃত ব্যয় তার চেয়েও অন্তত অর্ধেক কম।
শুনানিতে অংশ নিয়ে সিপিবি’র সভাপতি মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম বলেন, মানুষের অন্ন, বস্ত্র, চিকিৎসা এবং অন্যান্য মৌলিক অধিকারগুলো নিশ্চিত করা সরকারের দায়িত্ব। এসবের সঙ্গে বিদ্যুৎ যোগ করতে হবে। এটা তারই একটি অংশ। আয়ের সঙ্গে ব্যয়ের সমন্বয় ব্যবসার ক্ষেত্রে প্রযোজ্য, সরকারি সেবার ক্ষেত্রে নয়। মানুষ কর-ভ্যাটের মাধ্যমে সরকারকে টাকা দিচ্ছে। তা থেকে এ খাতে বরাদ্দ দিতে হবে, ভর্তুকি নয়।
কলামিস্ট সৈয়দ আবুল মাকসুদ বলেন, বিদ্যুতের দাম বাড়ানো হলে অনেক সেবা ও পণ্যের দামও বেড়ে যায়। এর প্রভাব আরো বেশি। তিনি বলেন, একটি গণতান্ত্রিক সরকার মানুষের বোঝা কমাবে কিন্তু বোঝা চাপিয়ে দিতে পারে না। অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক এমএম আকাশ বলেন, বিদ্যুৎ একটি কৌশলগত পণ্য এবং এটির দাম বেড়ে গেলে অন্য সব পণ্যের উৎপাদন খরচ বেড়ে যায়। ফলে দুটি প্রতিক্রিয়া হয়। একটি মুদ্রাস্ফীতি, এতে জনগণের প্রকৃত আয় কমে যায় এবং অন্যটি দেশের পণ্যের উৎপাদন খরচ বেড়ে যায়। এতে রপ্তানিখাত প্রতিযোগিতায় পিছিয়ে যায়। তাই বিদ্যুতের দাম কমানো সম্ভব হলে তা কমানো দরকার। বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টির সাধারণ সম্পাদক সাইফুল হক বলেন, সরকার কিছু উদ্যোগ গ্রহণ করলে বিদ্যুতের দাম না বাড়িয়ে কমানোর সুযোগ রয়েছে। বিইআরসি গণশুনানি গ্রহণ করেছেন বিইআরসি চেয়ারম্যান মনোয়ার ইসলাম, সদস্য মিজানুর রহমান, রহমান মুরশেদ, আবদুল আজিজ খান ও মাহমুদ-উল হক ভুঁইয়া। অন্যান্যের মধ্যে বক্তব্য রাখেন এফবিসিসিআইয়ের পরিচালক আমজাদ হোসেন, সিপিবি’র সম্পাদক রুহিন হোসেন প্রিন্স, গণসংহতির সমন্বয়ক জোনায়েদ সাকি ও প্রকৌশলী মোবাশ্বের হোসেন।