একটি নাটকের প্রাণ হলো গল্প। একটি গল্পই পারে দর্শকদের ধরে রাখতে। কিন্তু আজকাল দেশের টিভি নাটকে এই গল্পের বেশ সংকট দেখা দিয়েছে। প্রায় নাটকেই গতানুগতিক গল্প দেখা যায়। অভিনেতা-অভিনেত্রীদের চরিত্রেও কোনো বৈচিত্র্য থাকে না। যার ফলে দর্শক সেই সব নাটক দেখা থেকে দূরে সরে থাকছে।বিশেষ করে ধারাবাহিকগুলোতে গল্পের সংকট বেশি। প্রতিদিনই প্রতিটি চ্যানেলে প্রচার হচ্ছে একাধিক ধারাবাহিক। কিন্তু এই ধারাবাহিকগুলোর বেশির ভাগেই গল্পে নেই কোনো নতুনত্ব। যার ফলে অনেক ধারাবাহিক প্রচারের কিছু দিন পরই বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। কিছু ধারাবাহিক নিয়মিত প্রচার হলেও দর্শকদের টানতে পারছে না। একই সমস্যা খণ্ড নাটকের ক্ষেত্রেও। বিশেষ দিবসের বাইরে খণ্ড নাটকের নির্মাণের সংখ্যাও অনেক কম। আবার যেগুলো নির্মাণ হচ্ছে সেগুলো অধিকাংশেই নেই গল্পের কোনো বৈচিত্র্য। এদিকে খণ্ড নাটক নির্মাণ কম হওয়ার কারণে অনিচ্ছা সত্ত্বেও সারা বছরই বিভিন্ন মানহীন ধারাবাহিকে কাজ করতে হয় বলে অনেক শিল্পী মত প্রকাশ করেন। ফলস্বরূপ দর্শক দেশীয় নাটক দেখা বন্ধ করে বিদেশি সিরিয়ালে আকৃষ্ট হয়ে পড়ছে। এই প্রসঙ্গে টিভি পর্দার শক্তিমান অভিনেতা ড. ইনামুল হক বলেন, এখন ধারাবাহিকগুলোতে গল্প নেই বললেই চলে। সাহিত্য থেকেও নাটক নির্মাণ হচ্ছে না। এক সময় আমাদের অনেক সাহিত্যনির্ভর নাটক নির্মিত হয়েছে। দর্শক সেই সময় নাটকগুলো স্বাচ্ছন্দ্যে গ্রহণ করেছে। সেই সময় কিছু কিছু নাটকের সংলাপ মানুষের মুখে মুখে শোনা যেত। আর এখন দর্শক নাটক দেখাই প্রায় বন্ধ করে দিচ্ছে। অধিকাংশ ধারাবাহিকে শিল্পীদের ছোটাছুটি, লাফালাফি করতে দেখা যায়। সত্যি বলতে আমাদের এখন ভালো গল্পকারের সংকট রয়েছে। দর্শকদের নাটকমুখী করতে হলে নির্মাতাদের ভালো গল্পের পাশাপাশি সাহিত্যনির্ভর নাটক নির্মাণেও এগিয়ে আসতে হবে। তিনি আরো বলেন, এখন অনেকে বাজেট স্বল্পতার কথা বলছেন। একটু নিয়ম-নীতির মধ্যে আসলে এই বাজেট স্বল্পতাও কিছুটা কাটিয়ে ওঠা সম্ভব। শুটিং স্পটে শিল্পীদের আসার জন্য নির্দিষ্ট সময় থাকবে। কারণ অনেকে এখন ৯টায় শিডিউল দিয়ে ১১টায় আসে। যার কারণে সঠিক সময়ে কাজ শেষ করা যায় না এবং বাজেট বেড়ে যায়। নির্দিষ্ট সময়নুযায়ী কাজ করতে পারলে স্বল্প বাজেটেও ভালো কিছু নির্মাণ করা যায় বলে আমি মনে করি। জনপ্রিয় অভিনেতা ফজলুর রহমান বাবু বলেন, দর্শকদের জন্য নাটক নির্মাণ করা হয়। সেই দর্শক যদি নাটক না দেখে তাহলে নির্মাণের কোনো মানেই হয় না। দর্শক সব সময় নাটকে গল্প খোঁজে। গল্পহীন কোনো নাটকই কোনোকালেও দর্শকদের কাছে সমাদৃত হয়নি। তিনি আরো বলেন, আজকাল অনেক নির্মাতাকে শুটিং স্পটে স্ক্রিপ্ট করতে দেখা যায়। এভাবে তো কখনো একটি ভালো নাটক নির্মাণ সম্ভব নয়। একটি ভালো নাটকের জন্য সুষ্ঠু পরিকল্পনার প্রয়োজন। দেশীয় টিভি মাধ্যমে যতগুলো নাটক এ পর্যন্ত দর্শকপ্রিয়তা পেয়েছে তার সবক’টির গল্পের গভীরতা অনেক বেশি। সংলাপ ও শিল্পীদের চরিত্রেও নতুনত্ব ছিল। আমাদের নাটকের উন্নয়নের জন্য ভালো গল্পকার ও স্ক্রিপ্ট রাইটারের প্রয়োজন। একই সঙ্গে দক্ষ নির্মাতাদের নাটক নির্মাণে এগিয়ে আসতে হবে। এদিকে আমাদের দেশে নাটকের অধিকাংশ দর্শক মহিলা। তারা স্টার জলসা, জি বাংলা ও স্টার প্লাসের সিরিয়ালে মুগ্ধ। এই সব চ্যানেলের সিরিয়ালে এক ধরনের টান টান উত্তেজনা থাকে বলে তারা সেই সিরিয়ালগুলো দেখছে। কিন্তু আমাদের দেশীয় নাটক তার ব্যতিক্রম। শিল্পীদের চরিত্রের মধ্যে কোনো উত্তেজনা চোখে পড়ে না। নাটক সংশ্লিষ্টদের মতে, এভাবে গল্পহীন নাটক নির্মাণ ও বৈচিত্র্য না থাকার কারণেই দর্শক নাটক বিমুখ হয়ে পড়েছে। আমাদের দেশীয় নাটকে দেশীয় নির্মাতাদের ভালো গল্প ও সাহিত্যনির্ভর নাটক নির্মাণের মধ্য দিয়ে আবারো দর্শকদের নাটকমুখী করতে হবে। পাশাপাশি সময়ের সঙ্গে আধুনিক প্রযুক্তির ব্যবহার করতে হবে। না হয় টিভি নাটকের বিপর্যয় অনিবার্য।