পররাষ্ট্রমন্ত্রী আবুল হাসান মাহমুদ আলী বলেছেন, রোহিঙ্গা সমস্যা সমাধানে রাশিয়া ও চীন বাংলাদেশের পাশে আছে। সমপ্রতি জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদের বৈঠকে রাশিয়ার প্রতিনিধি রাখাইন সমস্যার সমাধানে আনান কমিশনের সুপারিশ বাস্তবায়নের কথা বলেছেন। চীনের প্রতিনিধিও এ সমস্যার মূল উৎসে যাওয়ার কথা বলেছেন। এ ইস্যুতে চীন ও রাশিয়ার অবস্থান আগের চেয়ে অনেক পরিবর্তন হয়েছে দাবি করে মন্ত্রী বলেন, দেশ দু’টির সঙ্গে আলোচনায় প্রয়োজনে বিশেষ দূত পাঠানো হবে। রোহিঙ্গা বিষয়ে সামপ্রতিক অগ্রগতি নিয়ে গতকাল পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের আনুষ্ঠানিক সংবাদ সম্মেলনে মন্ত্রী এসব কথা বলেন। সেখানে রোহিঙ্গা সংকট নিরসনে চলমান কূটনৈতিক কার্যক্রমের বিস্তারিত তুলে ধরেন।মন্ত্রী বলেন, মিয়ানমারের গণহত্যা থেকে বাংলাদেশে পালিয়ে আসা রোহিঙ্গাদের নিজ দেশে ফিরে যাওয়া উচিত বলে মনে করে চীন ও রাশিয়া। চলমান কূটনৈতিক তৎপরতার কারণে আন্তর্জাতিক সমপ্রদায় রোহিঙ্গা সংকটে বাংলাদেশের পাশে আছে। পররাষ্ট্রমন্ত্রী তার লিখিত বক্তব্যে চীনের সঙ্গে জাপানের নাম যুক্ত করে বলেন, এ দুটি দেশের বক্তব্যে আশাব্যঞ্জক পরিবর্তন লক্ষ্য করা গেছে। উভয় দেশই তাদের বক্তব্যে রোহিঙ্গাদের স্বদেশে ফিরে যাওয়ার বিষয়টি উল্লেখ করেছে। রোহিঙ্গা সমস্যার সমাধান যে মিয়ানমারকেই করতে হবে তা স্বীকার করেছে। সমপ্রতি জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদের বৈঠকে রাশিয়ার প্রতিনিধি রাখাইন সমস্যার সমাধানে আনান কমিশনের সুপারিশ বাস্তবায়নের কথা বলেছেন। চীনের প্রতিনিধিও এ সমস্যার মূল উৎসে যাওয়ার কথা বলেছেন। এ সমস্যা সমাধানে আন্তর্জাতিক সমপ্রদায় জোরালোভাবে বাংলাদেশের পাশে আছে জানিয়ে তিনি বলেন, বাস্তুচ্যুত রোহিঙ্গাদের মিয়ানমারে ফিরিয়ে নিতে আমরা দীর্ঘদিন ধরে দ্বিপক্ষীয়, আঞ্চলিক ও বহুপক্ষীয় ফোরামে নিয়মিত যোগাযোগের পাশাপাশি নেপথ্যে কূটনৈতিক প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি। সমস্যার সমাধানে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা জাতিসংঘে যে পাঁচ দফা প্রস্তাব দিয়েছেন তার উল্লেখ করে মন্ত্রী বলেন, বাংলাদেশে কূটনৈতিক প্রচেষ্টার একটি গুরুত্বপূর্ণ লক্ষ্য হলো প্রধানমন্ত্রীর পাঁচ দফা প্রস্তাব বাস্তবায়নে বিশ্বব্যাপী জনমত গড়ে তোলা। তাই জাতিসংঘ মহাসচিব ও জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদের মাধ্যমে মিয়ানমারের ওপর চাপ অব্যাহত রাখা অত্যন্ত জরুরি। এ বিষয়ে বাংলাদেশের সর্বাত্মক প্রচেষ্টা অব্যাহত রয়েছে। মন্ত্রী মাহমুদ আলী বলেন, সমপ্রতি জাতিসংঘের মানবিক সহায়তাবিষয়ক সংস্থার (ওসিএইচএ) প্রধান, জাতিসংঘ শিশু তহবিলের (ইউনিসেফ) প্রধান, আন্তর্জাতিক অভিবাসন সংস্থার (আইওএম) মহাপরিচালক বাংলাদেশ সফর করেছেন এবং রোহিঙ্গা ইস্যুতে বাংলাদেশকে সমর্থনের আশ্বাস দিয়েছেন। এরই পরিপ্রেক্ষিতে ২৩শে অক্টোবর জেনেভায় একটি প্লেজিং কনফারেন্স (রোহিঙ্গাদের সহায়তার আর্থিক তহবিল সংগ্রহের সম্মেলন) অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে। ওই সম্মেলনে বাংলাদেশকে আমন্ত্রণ জানানো হয়েছে। বাংলাদেশ ইতিমধ্যেই জাতিসংঘের মানবাধিকারবিষয়ক হাইকমিশনারের দপ্তরের তিনটি প্রতিনিধিদলকে কক্সবাজারে আশ্রয় নেয়া রোহিঙ্গাদের সঙ্গে কথা বলার সুযোগ করে দিয়েছে জানিয়ে তিনি বলেন, যার ফলে প্রতিনিধিদল গত ৩রা ফেব্রুয়ারি ও ১১ই অক্টোবর দুটি প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে। প্রতিবেদনগুলোতে মিয়ানমারের রোহিঙ্গাদের ওপর নির্যাতনের তথ্যচিত্র উঠে এসেছে। মাহমুদ আলী বলেন, আমাদের এসব কূটনৈতিক উদ্যোগ ও জনসংযোগ কার্যক্রমের ফলে আন্তর্জাতিক মহলে আজ রোহিঙ্গা ইস্যুটি এত গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচিত হচ্ছে। নিরাপত্তা পরিষদে আরিয়া ফর্মুলা সভার আয়োজন এবং ওই আলোচনায় সব সদস্যের বক্তব্য থেকে এটি পরিষ্কার যে রোহিঙ্গা সমস্যা সমাধানে আন্তর্জাতিক মহল নিবিড়ভাবে যুক্ত আছে।
পররাষ্ট্রমন্ত্রীর বক্তব্যের বিস্তারিত: পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে ২৫শে আগস্টের পর থেকে শুরু হওয়া নিরাপত্তা বাহিনীর অভিযানের প্রেক্ষিতে বাংলাদেশ এক নজিরবিহীন মানবিক সংকটের উদ্ভব হয়েছে। জাতিসংঘের তথ্য অনুযায়ী এ যাবৎ ৫ লাখ ৫০ হাজার রোহিঙ্গা সীমান্ত পেরিয়ে বাংলাদেশে আশ্রয় নিয়েছে। সহিংসতা বন্ধ না হওয়ায় অনুপ্রবেশ ঘটেই চলছে। এছাড়া ৩০ বছর ধরে প্রায় আরো ৪ লাখ অনিবন্ধিত রোহিঙ্গা বিভিন্ন সময়ে সহিংসতার শিকার হয়ে বাংলাদেশে আশ্রয় নিয়েছে; যাদের বেশিরভাগই কক্সবাজারে মেইকশিফট ক্যাম্পে বসবাস করছে। সব মিলিয়ে এখন ৯ লাখের অধিক রোহিঙ্গা বাংলাদেশে বসবাস করছে। অত্যন্ত জনবহুল বাংলাদেশ বিশেষ করে প্রধানমন্ত্রী মানবিক কারণে এই রোহিঙ্গাদের আশ্রয় ও অন্যান্য মানবিক সহায়তা দেয়ার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছেন। তবে রোহিঙ্গাদের নিরাপদে স্বদেশে ফেরত পাঠানোই আমাদের এখন মূল লক্ষ্য। মন্ত্রী বলেন, জাতিসংঘ মহাসচিবের লিখিত অনুরোধে নিরাপত্তা পরিষদ ইতিমধ্যে কয়েক দফা রোহিঙ্গা বিষয়ে আলোচনা করেছে। ১৩ই সেপ্টেম্বর ২০১৭ তারিখে নিরাপত্তা পরিষদ সর্বসম্মতিক্রমে একটি বিবৃতি প্রকাশ করে। ১৯৮৯ সালের পর এইবারই প্রথম জাতিসংঘ মহাসচিব নিরাপত্তা পরিষদের কাছে পত্র পাঠান (২রা সেপ্টেম্বর ২০১৭) এবং বিগত ৯ বছরে এবারই প্রথম নিরাপত্তা পরিষদ সর্বসম্মতিক্রমে মিয়ানমার বিষয়ে বিবৃতি দিয়েছে। ২৮শে সেপ্টেম্বর ২০১৭ তারিখে নিরাপত্তা পরিষদের সদস্য রাষ্ট্রসমূহের সর্বসম্মতিক্রমে নিরাপত্তা পরিষদে একটি উন্মুক্ত আলোচনা অনুষ্ঠিত হয়। বাংলাদেশ উক্ত আলোচনায় অংশ নেয় এবং বক্তব্য দেন। সর্বশেষ ১৩ই অক্টোবর ২০১৭ তারিখে নিরাপত্তা পরিষদে রোহিঙ্গা বিষয়ে ‘আরিয়া-ফর্মুলা’ সভা অনুষ্ঠিত হয়। উক্ত সভায় রাখাইন অ্যাডভাইজারি কমিশনের চেয়ারম্যান ড. কফি আনান বক্তব্য রাখেন। বাংলাদেশ ও মিয়ানমারও উক্ত আলোচনায় অংশ নেয়।
ড. কফি আনান তার বক্তব্যে তার নেতৃত্বাধীন কমিশনের প্রতিবেদন গ্রহণ করায় এবং তা বাস্তবায়নে উদ্যোগ নেয়ায় মিয়ানমার সরকারকে ধন্যবাদ দেন। তিনি বাংলাদেশের সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় আলোচনার মাধ্যমে তার কমিশনের সুপারিশসমূহ বাস্তবায়ন, বিশেষত জোরপূর্বক বাস্তুচ্যুত মিয়ানমার নাগরিকদের ফিরিয়ে নিতে উদ্যোগ নেয়ার জন্য মিয়ানমানকে আহ্বান জানান। তিনি এ বিষয়ে মিয়ানমারের সামরিক বাহিনীর ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ বলে উল্লেখ করেন। এছাড়া তিনি মিয়ানমারে অবিলম্বে সহিংসতা বন্ধের এবং উক্ত অঞ্চলে মানবিক সহায়তা প্রদানের জন্য আন্তর্জাতিক সংস্থার প্রবেশাধিকার নিশ্চিত করার জন্য মিয়ানমারকে আহ্বান জানান। ড. কফি আনান তার কমিশনের সুপারিশ বাস্তবায়নে, বিশেষত মিয়ানমার নাগরিকদের প্রত্যাবাসন এবং প্রত্যাবাসিত নাগরিকদের সুরক্ষিত ও নিরাপদ জীবন ও নিশ্চিত জীবিকা নির্বাহের লক্ষ্যে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে উপযুক্ত ব্যবস্থা নেয়ার অনুরোধ জানান। নিরাপত্তা পরিষদের ওই আরিয়া ফর্মুলা সভায় সকল রাষ্ট্রই কফি আনান কমিশনের প্রতিবেদনের প্রতি তাদের সমর্থন ব্যক্ত করে এবং রোহিঙ্গা সমস্যার স্থায়ী সমাধানে এটিকে একটি রোডম্যাপ হিসেবে উল্লেখ করে তা বাস্তবায়নের আহ্বান জানায়। এছাড়া সকল সদস্য রাষ্ট্রের বক্তব্যে তিনটি বিষয়ে প্রাথমিক ঐকমত্য লক্ষ্য করা গেছে, যা হলো- ক) মিয়ানমারে অবিলম্বে সহিংসতা বন্ধ করা, খ) মিয়ানমারে নিরবচ্ছিন্ন মানবিক সহায়তা প্রদানের ব্যবস্থা করা এবং গ) জোরপূর্বক বিতাড়িত এসব মিয়ানমার নাগরিকের স্বদেশে ফিরে যাওয়ার ব্যবস্থা করা। সভায় বিশেষত চীন ও জাপানের বক্তব্যে আশাব্যঞ্জক পরিবর্তন লক্ষ্য করা গেছে। উভয় দেশই তাদের বক্তব্যে রোহিঙ্গাদের স্বদেশে ফিরে যাওয়ার বিষয়টি উল্লেখ করেছে এবং রোহিঙ্গা সমস্যার সমাধান যে মিয়ানমারকেই করতে হবে তা স্বীকার করেছে। মিয়ানমারের প্রতিনিধি তার বক্তব্যে বাংলাদেশের সঙ্গে চলমান কূটনৈতিক আলোচনার কথা উল্লেখ করেছেন এবং কফি আনান কমিশনের সুপারিশ বাস্তবায়নে এ যাবৎ গৃহীত পদক্ষেপ, যথা: ‘ইউনিয়ন এন্টারপ্রাই’ গঠন, মন্ত্রী পর্যায়ের বাস্তবায়ন কমিটি গঠন এবং অ্যাডভাইজারি গ্রুপ প্রতিষ্ঠার কথা উল্লেখ করেছেন।