চাকরি করেন একটি প্রতিষ্ঠিত ওষুধ কোম্পানিতে। কাজ করেন ময়মনসিংহের ভালুকা এলাকার জুনিয়র ফিল্ড অফিসার হিসেবে। উদ্দেশ্য প্রতিষ্ঠিত ওই কোম্পানির ওষুধের পাশাপাশি নকল ওষুধ তৈরি করা। সেগুলো কোম্পানির নামেই চালিয়ে দিয়ে বিক্রি করা। মূলত এটিই তার প্রধান পেশা। চাকরিটাকে তিনি ঢাল হিসেবে ব্যবহার করেন মাত্র।আর তার এই নকল ওষুধ বাজারজাত করতে দেশের বিভিন্ন এলাকায় গড়ে তোলেন নেটওয়ার্ক। এজন্য তিনি কৌশলে মোবাইল ফোনের মাধ্যমে বিভিন্ন নারী-পুরুষের সঙ্গে সম্পর্ক তৈরি করেন। পরবর্তীতে তাদেরই কাজে লাগান। এই প্রতারকের নাম জয়নুল আবেদীন। বয়স ৩৯ বছর। বাড়ি টাঙ্গাইল ধনবাড়ি থানার বলদীআটা গ্রামে। অবশেষে ধরা পড়েছে তার প্রতারণা। আটক করা হয়েছে তাকে। একইসঙ্গে আটক করা হয়েছে চক্রের অপর সদস্য মো. ফারুক মিয়া (৩৭)কে । গত মঙ্গলবার ঢাকা মহানগর পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (পিবিআই) তাদের আটক করে। এরমধ্যে রাজধানীর কল্যাণপুর থেকে ওইদিন অভিযান চালিয়ে বিকাল সাড়ে ৪টার দিকে আটক করা হয় জযনুল আবেদীনকে এবং সন্ধ্যা ৬টার দিকে খিলগাঁও ফ্লাইওভার এলাকা থেকে আটক করা হয় ফারুককে। পিবিআই সূত্র বলছে, এই প্রতারকচক্রের নেটওয়ার্ক সারা দেশে বিস্তৃত। এ ব্যাপারে তারা অভিযান অব্যাহত রেখেছেন।
সূত্র জানায়, চলতি বছরের ১৪ই জুন মোছাম্মৎ শারমিন ওরফে উম্মে খাদিজা নামে এক নারী রাজধানীর খিলগাঁও তিলপাপাড়া রোডের লাকী ফার্মেসিতে দি একমি ল্যাব লিমিটেডের সর্বাধিক বিক্রীত ওষুধ মোনাস-১০ (মন্টিলুকাস্ট ১০ এম.জি) নিয়ে গিয়ে নির্ধারিত মূল্যের অর্ধেক দামে বিক্রি করার প্রস্তাব দেয়। এতে ফার্মেসির লোকজনের বিষয়টি সন্দেহ হওয়ায় তারা পরে অর্ডার দেবে বলে কৌশলে তার নাম ও মোবাইল নম্বর নেয়। বিষয়টি তারা কোম্পানির ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে জানায়। পরে কর্র্তৃপক্ষ বিষয়টি সরজমিন সত্যতা যাচাইয়ের জন্য তাদের প্রতিনিধি মো. মিজানুর রহমানকে দায়িত্ব দেয়। মিজানুর রহমান খিলগাঁওয়ের ওই ফার্মেসির নামে মোছা. শারমিন ওরফে উম্মে খাদিজার মোবাইলে ফোন করে ৫০ বক্স মোনাস-১০ (মন্টিলুকাস্ট ১০ এম.জি) ওষুধ অর্ডার দেবে বলে জানায়। সে অনুযায়ী উম্মে খাদিজা ১৫ই জুন রাত ৮টার দিকে সুমি ফার্মেসিতে আসলে তার সঙ্গে ওষুধ সরবরাহের বিষয়ে কথা হয়। কথাবার্তার একপর্যায়ে ওষুধের দাম ও অন্যান্য বিষয়ে ব্যাপক জিজ্ঞাসাবাদ শুরু করলে অবস্থা বেগতিক দেখে খাদিজা পালানোর চেষ্টা করে। এ সময় একমি প্রতিনিধি, স্থানীয় লোকজন ও থানা পুলিশের সহায়তায় তাকে আটক করা হয়। এ সময় তার কাছ থেকে এক বক্স মোনাস-১০ (মন্টিলুকাস্ট ১০ এম.জি), তিন পাতা সর্বমোট ৩০টি ট্যাবলেট জব্দ করা হয়। উদ্ধারকৃত ওষুধ দেখতে একমি কোম্পানির ওষুধের মতো হলেও মোনাস-১০ লেখায় ইংরেজি ‘ও’ বর্ণটির ওপরের অংশে কালো রঙ দেয়া। মূল ওষুধে যেটা লাল রং। এতে তারা প্রাথমিকভাবে ওষুধটি নকল করে খাঁটি বলে চালিয়ে দেয়ার প্রমাণ পান।
এ ঘটনায় দি একমি লিমিটেডের লিগ্যাল অফিসার মো. শফিক হাসান বাদী হয়ে পরদিন খিলগাঁও থানায় একটি মামলা করেন। মামলাটি থানা পুলিশ তদন্তকালে বাদী পিবিআইয়ের ডিআইজি বরাবর আরেকটি আবেদন করে। ঢাকা মহানগর পিবিআইয়ের সাব-ইন্সপেক্টর (এসআই) মো. হুমায়ূন কবির মোল্লা মামলাটির তদন্ত করেন। এরই ধারাবাহিকতায় পিবিআইয়ের একটি দল গোপন সংবাদের ভিত্তিতে মঙ্গলবার তাদের গ্রেপ্তার করে। গ্রেপ্তারকৃত অপরজন ফারুক মিয়ার বাড়ি গাইবান্ধা জেলার পলাশবাড়ি থানার জালাগাড় গ্রামে।
পিবিআই সূত্র জানায়, আটককৃতরা সংঘবদ্ধ নকল ওষুধ প্রস্তুতকারী চক্রের সদস্য। জয়নুল আবেদীন দীর্ঘদিন ধরে দি একমি ল্যাব লিঃ-এ চাকরি করতেন। সে সুবাদে আসল ওষুধ বিক্রি করার পাশাপাশি নকল ওষুধ বিভিন্ন দোকানে বিক্রি করে। এছাড়া মো. ফারুক মিয়া দীর্ঘদিন সেনাবাহিনীতে চাকরি করে স্বেচ্ছায় চাকরি ছেড়ে এসে অধিক মুনাফা লাভের আশায় এইসব নকল ওষুধ তৈরির কাজ করে।
ঢাকা মহানগর পিবিআইয়ের বিশেষ পুলিশ সুপার মো. আবুল কালাম আজাদ জানান, ইতিপূর্বে আটক খাদিজা ফারুকের স্ত্রী। তিনি বলেন, এই চক্রের মূল হোতা জয়নুল আবেদীন মূলত দি একমি ওষুধ কোম্পানির জুনিয়র ফিল্ড অফিসার হিসেবে ময়মনসিংহের ভালুকা এলাকায় কাজ করছিলেন। কিন্তু এই চাকরির আড়ালে তার প্রধান পেশা নকল ওষুধ বাজারজাত করা। তিনি বলেন, সে অসংখ্য মোবাইল সিমকার্ড ব্যবহার করে। সেই সব নাম্বার দিয়ে ফোনে অন্যের সঙ্গে সম্পর্ক গড়ে তোলে, বিশেষ করে মেয়েদের সঙ্গে। এরপর সুযোগ বুঝে নকল এই ওষুধ বিক্রির প্রস্তাব দেয়। খাদিজার সঙ্গেও তার এভাবেই পরিচয় বলে জানান তিনি। আবুল কালাম আজাদ আরো বলেন, জয়নুল আবেদীন বিভিন্ন এলাকায় এই নকল ওষুধের ব্যবসা করে। এ ব্যাপারে বিস্তারিত অনুসন্ধান চালানো হচ্ছে। নকল ওষুধ তৈরির কারখানা, প্রস্তুতকারীসহ এ চক্রের অন্যান্য সদস্যদের ধরতে অভিযান অব্যাহত রয়েছে।