থামছে না রোহিঙ্গা স্রোত। প্রতিদিন আসছে হাজার হাজার রোহিঙ্গা। তবে এবার নির্যাতনের শিকার হয়ে নয়, রোহিঙ্গা আত্মীয়দের ডাকে আসছেন তারা। নিরাপদ আশ্রয় ও খাবারের আশ্বাস পেয়ে রাখাইন থেকে পালিয়ে আসছেন অনেক রোহিঙ্গা। বাংলাদেশে আশ্রয় নেয়া রোহিঙ্গাদের পর্যাপ্ত ত্রাণ ও খাবার দেয়া হচ্ছে নিশ্চিত হয়ে তারা বাংলাদেশমুখী হচ্ছেন।
গতকাল সকালে উখিয়ার বালুখালী ও সাবরাং নায়াপাড়া সীমান্ত দিয়ে শ’ শ’ রোহিঙ্গা পালিয়ে এসেছেন।এছাড়া উখিয়ার আন্জমানপাড়া, টেকনাফের জাদিমুড়া, নাইট্যংপাড়া লম্বাবিল ও খারাংখালী পয়েন্ট দিয়েও রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশ বেড়েছে। পালিয়ে আসা রোহিঙ্গাদের অধিকাংশ মিয়ানমার বুচিডং (বুথেডং) টাউনশিপ এলাকার। শাহ্পরীর দ্বীপের ওপারে মিয়ানমারের ডংখালি নামক চর এলাকায় হাজারো রোহিঙ্গা তাবু টানিয়ে আশ্রয় নিয়েছেন। এপারে আসা লোকজনের সেখানে অনেকের আত্মীস্বজন রয়েছে। এপার থেকে ডংখালিতে আশ্রয় নেয়া লোকজনকে মোবাইলের মাধ্যমে ত্রাণ ও খাবারের বিষয়ে আশ্বস্ত করে নিয়ে আসা হচ্ছে।
গতকাল বিকালে বালুখালী বাজার এলাকায় সদ্য আসা একজনের সঙ্গে কথা হয়। তার নাম বশির আহম্মদ (৬৫)। বাড়ি মিয়ানমার বুচিডং টাউনশিপ ঘোদামপাড়া।
তিনি বলেন, ২০ দিন আগে তার চাচাতো ভাই আলম পরিবারকে নিয়ে আনজুমানপাড়া সীমান্তে আশ্রয় নিয়ে বালুখালী রোহিঙ্গা ক্যাম্পে আশ্রয় নিয়েছেন। তিনি বলেন, এ পর্যন্ত বাংলাদেশে যারা পালিয়ে এসেছে তাদের খাবারের কোনো অভাব নেই। এই কথাটি আমার জেঠাত ভাই হামিদ, কাসেমকে শুনালে তারা বললো বাংলাদেশ যেভাবে হওক আমাদের নিয়ে যেতে বল। পরের দিন তার সঙ্গে কথা বলে আমাদের তিন পবিারের ২৮ জন রবিবার সন্ধ্যায় রওনা দেই। সারা রাত হেঁটে ও পৌঁছতে না পেরে পাহাড়ের গুহায় অবস্থান করি। পরের দিন পৌছি। সেখানে এসে দেখি ছোট ছোট তাঁবুতে প্রায় ১০ হাজারে বেশি মানুষ বসবাস করছে।
হারিয়া খালী সেনা ক্যাম্পে দেখা হয় বশির আহম্মদের সঙ্গে, স্ত্রীসহ ৪ সন্তান নিয়ে এপারে পালিয়ে আসেন গত রাতে।
তিনি বলেন, এক মাস আগে পরিবার নিয়ে বাংলাদেশে পালিয়ে এসেছিল তার ছোট ভাই নূর মোহাম্মদ। সে এপারে আসার পর থেকে মিয়ানমার পরিস্থিত জানতে তার সঙ্গে যোগাযোগ করতো। তখন তারা গ্রাম ফেলে ডংখালী চরের অবস্থান করছিল। সেখানে তাদের খাবারের খুব বেশি অভাব ছিল। তখন তার ছোটভাই তাদের চলে আসতে বলেন। কেননা বাংলাদেশে আসার পর থেকে খুব বেশি ভাল ছিল। এপারে কিছু কাজ করতে হয় না, প্রতি দিন চাল, ডাল, তেল ও মাঝে নগদ টাকাও পাচ্ছে। এখানে শুধু একটু কষ্ট করে লাইনে দাঁড়াতে হয়। তার কথা শুনার পরে ভেবেছিলাম সেখানে কষ্ট করে থাকার চেয়ে চলে আসা ভাল। তাই চলে এসেছি।
রাখাইনের মংডু হাসসুরাতার নাজমা খাতুন জানান, এক সপ্তাহ আগে রাতের অন্ধকারে গ্রামের কয়েকশ’ লোককে একসঙ্গে অবরুদ্ধ করে রাখে, ফলে আমাদের খাবারের খুব অভাব হয়ে পড়ে। বাংলাদেশে পালিয়ে যাওয়া আত্মীয়স্বজন ফোন করে বলেছিল সেখানে না খেয়ে মরে এপারে চলে আসতে। তাই রোহিঙ্গাদের একটি দলের সঙ্গে পালিয়ে হাঁটা শুরু করি। পাঁচ দিন হাঁটার পর সীমান্ত দিয়ে ঢুকে বালুখালী এসে আশ্রয় নিই।
লম্বাবিল এলাকার মো. আলম পরিবারের ১০ সদস্য নিয়ে পালিয়ে এসেছেন। নয়াপাড়া ক্যাম্পে আশ্রয় নেন। তিনি জানান, কয়েক সপ্তাহ ধরে অবরুদ্ধ তাদের গ্রাম। বাড়িতে কোনো খাবার মজুত ছিল না। খেয়ে না-খেয়ে দিন কাটছিল। মাঝে-মধ্যে তাদের ডেকে নিয়ে ত্রাণ দেয়া হয়। ত্রাণ দেয়ার দৃশ্য ভিডিও ধারণ করে পরে আবার সে ত্রাণ কেড়ে নেয় সেনা ও তাদের সঙ্গে থাকা রাখাইনরা। শেষে ক্ষুধার জ্বালায় পালিয়ে বাংলাদেশের পথ ধরেন তারা। এখন এখানে এসে ভালো হয়েছে, কেননা জনপ্রতি ত্রাণ ও খাবার পাচ্ছি। ওপারে আমার আরও কয়েকজন আত্মীয়স্বজন রয়েছে। তাদেরও বাংলাদেশে চলে আসতে বলেছি। এখানে যে ত্রাণ দিচ্ছে তা খাওয়ার পর বাকিগুলো বাইরেও বিক্রি করে অনেক টাকা আয় করে টাকা জমা করা সম্ভব।
মংডু বড়গজবিল এলাকার আজগর আলী বলেন, পরিবারের ৮ সদস্য নিয়ে পালিয়ে এসেছেন তিনি। তিন দিন আগে রাতের অন্ধকারে গ্রাম ছেড়েছিলেন তারা। তিন দিন হেঁটে রাখাইনের রাইম্ম্যাবিল পৌঁছেন। পথে খাবারের অভাবে খুব কষ্ট পেয়েছেন তারা। পথিমধ্যে জনশূন্য এমন গ্রাম পেয়েছেন। এখানে পৌঁছার সঙ্গে সঙ্গে কিছু মাওলানা তাদের দেড় হাজার টাকা ও খাবার দেন। এপারে এসে বেশ ভালো হয়েছে, কেননা ত্রাণ, খাবার ও নগদ টাকাও পাওয়া যাচ্ছে।
সাবরাং ইউনিয়ন ১নং ওয়ার্ডের মেম্বার নূরুল আবছার চৌধুরী বলেন, এখন যেসব রোহিঙ্গা আসছেন তারা সবাই খাবারের অভাবে চলে আসছেন। তাছাড়া এপার থাকা ওদের আত্মীয়স্বজন তাদেরকে ফোনের মাধ্যমে উৎসাহিত করছে।