হামিম রাফি, নিউজ ডেস্কঃ ছোট ছোট গলি। তার থেকেও ছোট দোকানগুলো। চারদিকে কম্পিউটার মাউসের ক্লিক আর কি-বোর্ডের শব্দের সঙ্গে ছাপাখানার মেশিনের শব্দ মিলেমিশে একাকার হয়ে গেছে। সদ্য প্রিন্ট হওয়া নতুন বই কিংবা সাময়িকীর গন্ধও নাকে আসে ওইসব গলিতে। গলি ধরে হাটলেই দোকানির আওয়াজ, ‘মামা, কি করাবেন’, ‘কি কাজ মামা?’ অন্য যেকোনো জায়গা থেকে কম মূল্যে প্রিন্ট, ফটোকপি, লেমেনেটিং, বই বাঁধাইসহ নানা কাজ করানো যায় এখানে। আর যেকোনো বই মিলে এই মার্কেটে। তাই প্রতিটি মুহূর্ত শিক্ষার্থীসহ সব বয়সের মানুষের আনাগোনায় মুখর থাকে রাজধানী ঢাকার নীলক্ষেতে। এখানে বাকুশাহ, সিটি করপোরেশন ও গাউসুল আজম নামে তিন মার্কেট অবস্থিত।
পরিচিত এই চিত্রের বাইরেও একটি ভিন্ন এক পরিচয় আছে নীলক্ষেতের। বিশ্ববিদ্যালয়ের চৌকাঠ না মাড়িয়েও এই মার্কেটগুলোর কল্যাণে হওয়া যায় দেশ-বিদেশের নামকরা যেকোনো বিশ্ববিদ্যালয়ের গ্রাজুয়েট! নিয়োগ পাওয়া দূরে থাক, আবেদন না করেও হওয়া যায় যেকোনো প্রতিষ্ঠানের কর্মী। যেকোনো প্রতিষ্ঠানের পরিচয়পত্র, প্রেসকার্ড, জাতীয় পরিচয়পত্র, অভিজ্ঞতার সনদসহ যা দরকার সবই টাকার বিনিময়ে মিলবে নীলক্ষেত মার্কেটে। তবে তা সবই নকল।
তবে এখন সতর্কতা অবলম্বন করছেন ব্যবসায়ীরা। আগে অর্ডারের কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই সার্টিফিকেট হাতে পাওয়া গেলেও এখন অসাধু ব্যবসায়ীরা মার্কেট থেকে কেবল অর্ডার সংগ্রহ করে থাকেন। পরে গোপন স্থানে বানানো হয় সার্টিফিকেট। আর তা হাতে পাওয়া যায় আরও দেরিতে।
সদ্য অনার্স ফাইনাল পরীক্ষার ফল পেয়েছেন রুবেল হোসেন (ছদ্ম নাম)। এবার সনদপত্র হাতে পাওয়ার অপেক্ষা। কিন্তু কবে পাওয়া যাবে তার কোনো ঠিক-ঠিকানা নেই। তাই বলে তো আর সময় বসে থাকবে না! এরই মধ্যে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের অসংখ্য নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি শুধু দেখতেই হচ্ছে রুবেলের। তাই নীলক্ষেত থেকে নকল সনদপত্র বানানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছেন তিনি। তিন হাজার টাকার বিনিময়ে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অনার্সের সার্টিফিকেট বানাতে এক দোকানির সঙ্গে চুক্তি করেছেন বলে জানান রুবেল।
রুবেলের মতো অনেকেই আসেন নীলক্ষেতে। পরিচয় গোপন রেখে কথা হয় নকল সার্টিফিকেট বানায় এমন একটি দোকানের কর্মচারী সঙ্গে। তিনি দাবি করলেন, বিশ্বের যেকোনো বিশ্ববিদ্যালয়ের সনদ বানিয়ে দিতে পারবেন তিনি। এর দাম বিশ্ববিদ্যালয় ভেদে ভিন্ন হয়ে থাকে। কারণ জানতে চাইলে তিনি জানান, একেক বিশ্ববিদ্যালয়ের সার্টিফিকেটের কাগজ একেক রকম। তাই বিভিন্ন উপায়ে কাগজ সংগ্রহ হয় তাদের। তবে কাগজের মধ্যেও ভিন্নতা রয়েছে বলে জানান ওই কর্মচারী। আসল কাগজে জলছাপ থেকে শুরু করে সব ধরনের প্রতীক থাকে। তাই সার্টিফিকেট দেখতে একেবারে আসলের মতো হয়।
আরেক ব্যবসায়ী জানান, কম টাকার বিনিময়ে আমদানি করা কাগজেও সার্টিফিকেট বানিয়ে দেন তিনি। সেক্ষেত্রে আসল সার্টিফিকেটের মতো হয় না। তবে ক্রেতাদের চাহিদা অনুযায়ী সব ধরনের কাজ করেন বলে জানান তিনি। কীভাবে সার্টিফিকেট বানানো হয় জানতে চাইলে ওই ব্যবসায়ী বলেন, প্রথমে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর আসল সার্টিফিকেট স্ক্যান করে সংগ্রহে রাখা হয়। ফলে ক্রেতার নাম, রোল, ফলাফল ইত্যাদি ফটোশপের মাধ্যমে এডিট করে বসানো হয়। এরপর বিশেষ ধরনের প্রিন্টারের মাধ্যমে তা প্রিন্ট নেওয়া হয়।
এখন সার্টিফিকেট ব্যবসার ক্ষেত্রে কিছুটা কৌশলী হয়েছেন ব্যবসায়ীরা। আগে নীলক্ষেতেই সব হতো, কিন্তু এখন নীলক্ষেতে কেবল ফরমায়েশ (অর্ডার) নেওয়া হয় আর সার্টিফিকেট তৈরি হয় গোপনস্থানে। বিভিন্ন সময় নীলক্ষেতে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর অভিযান আর তদারকির কারণেই তাদের এই কৌশল।
একাধিক ক্রেতা ও ব্যবসায়ী সূত্রে জানা যায়, নীলক্ষেতে দুই থেকে পাঁচ হাজার টাকায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অনার্সের সার্টিফিকেট, দুই থেকে তিন হাজার টাকায় জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের সার্টিফিকেট, দুই থেকে তিনশত টাকায় জাতীয় পরিচয়পত্র, এক থেকে তিনশত টাকায় প্রেসকার্ডসহ যেকোনো পরিচয়পত্র পাওয়া যায়।
নীলক্ষেতের নকল সার্টিফিকেটের বিষয়ে জানতে চাইলে নিউমার্কেট থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মো. আতিকুর রহমান প্রিয়.কমকে বলেন, ‘গোপন সংবাদের ভিত্তিতে প্রায়ই মার্কেটে অভিযান চালানো হয়। সর্বশেষ দুই মাস আগেও অভিযান চালানো হয়েছে। তবে মার্কেটের ওপর সবসময়ই গোয়েন্দা নজরদারি থাকে।
আগে যারা জাল সার্টিফিকেট তৈরি করতেন, তারা এখন আর এসব করেন না দাবি করে ওসি বলেন, ‘তবে নতুন করে অনেকই এর সঙ্গে জড়াচ্ছেন। আমাদের সোর্স নিয়মিত এদের সম্পর্কে খোঁজ নিচ্ছে।’
জাল সার্টিফিকেট তৈরিতে অসাধু ব্যবসায়ীরা দোকানের পরিবর্তে নিজেদের বাসা কিংবা গোপন স্থান ব্যবহার করছে বলেও জানান আতিকুর রহমান।