মৃত রোগীর স্বজনরা চিকিৎসককে মারধর করায় লঙ্কাকাণ্ড ঘটেছে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে। গতকাল এ ঘটনায় প্রায় তিন ঘণ্টা সেবা কার্যক্রম বন্ধ ছিল দেশের সবচেয়ে বড় এ হাসপাতালে। এতে সারা দেশ থেকে আসা রোগীরা সেবা না পেয়ে ফিরে যান অন্য হাসপাতালে। কেউ কেউ রোগীকে নিয়ে হাসপাতালের বাইরে ঘণ্টার পর ঘণ্টা অপেক্ষায় ছিলেন। হঠাৎ সেবা কার্যক্রম বন্ধ করে হাসপাতালের ফটকে তালা দেয়ায় সীমাহীন দুর্ভোগে পড়েছিলেন হাসপাতালে চিকিৎসাধীন রোগীরা। বেলা ২টা থেকে বিকাল ৫টা পর্যন্ত এ পরিস্থিতি চলে।পরে চিকিৎসকদের সঙ্গে কর্তৃপক্ষের বৈঠকে সমঝোতার পর বিকাল ৫টায় আবার সেবা কার্যক্রম শুরু হয়। শনিবার রাতে হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে ঢামেক হাসপাতালের সিসিইউ-২ তে ভর্তি হন নওশাদ আহমেদ (৫০) নামের এক রোগী। গতকাল সকাল সাড়ে ১১টার দিকে তিনি মারা যান। তার মৃত্যুকে কেন্দ্র করে রোগীর স্বজনদের সঙ্গে চিকিৎসকদের কথা কাটাকাটি হয়। একপর্যায়ে রোগীর স্বজনরা ডাক্তারদের ওপর চড়াও হন। এ সময় তাদের আঘাতে একজন ডাক্তার ও দুই আনসার সদস্য আহত হন। পরে হাসপাতালের ডাক্তার, স্টাফ ও আনসার সদস্যরা মিলে রোগীর স্বজনদেরও মারধর করেছে বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে। ঢামেক হাসপাতালের ২ নম্বর ভবনের তৃতীয় তলায় এ ভাঙচুর ও মারধরের ঘটনা ঘটে। আহত ডাক্তারের নাম শামীমুর রহমান ও আনসার সদস্যরা হলেন বাদল হালদার ও শাহ আলম। তারা ঢামেকের অর্থপেডিক্স বিভাগের ১০২ নম্বর ওয়ার্ডে ভর্তি আছেন। আর রোগীর স্বজনদের মধ্যে একজনকে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে। তাদের অন্য দুই জনকে শাহবাগ থানায় পুলিশের হাতে তুলে দেয়া হয়েছে। তারা হলেন মাকসুদ ও রিয়াদ। বিকাল ৫টার দিকে চিকিৎসকদের সঙ্গে বৈঠক শেষে হাসপাতালের পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল একেএম নাসির উদ্দিন বলেন, যে রোগীকে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে তিনি তিনদিন আগে হার্ট অ্যাটাক করেছেন। একেবারে মুমূর্ষু অবস্থায় তাকে সারারাত চিকিৎসা দেয়া হয়। গতকাল সকালে কার্ডিওলোজি বিভাগের প্রধান নিজে রাউন্ড দিয়ে স্বজনদের জানিয়েছেন রোগীর অবস্থা খারাপ। তারপরও রোগীকে বাঁচানের আপ্রাণ চেষ্টা করা হয়েছে। এক পর্যায়ে রোগী মারা যান। কিন্তু রোগীর স্বজনরা চিকিৎসকদের ওপর চড়াও হয়ে যান। এমনকি যে চিকিৎসক রোগীর চিকিৎসা করেছেন তাকেও মারধর করা হয়েছে। অন্য চিকিৎসক নার্স ও আনসাররা সামলাতে আসলে তাদেরও মারধর করা হয়েছে। তিনি বলেন, ঢামেকের সিসিইউতে তাকে যে দক্ষ চিকিৎসক দিয়ে সেবা দেয়া হয়েছে দেশের আর কোথাও এমন সেবা দেয়া সম্ভব নয়। তারপরও এরকম একটা অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনার মুখোমুখি হতে হলো। তাই এখানে যারা কাজ করেন তাদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে। যারা এখানে কাজ করছেন তাদের যদি এভাবে হেনস্থা করা হয় তার বহিঃপ্রকাশ হিসেবে একটু উত্তেজনা বিরাজ করা স্বাভাবিক। তবে এটা খুব সাময়িক সময়ের জন্য। কিন্তু আমরা সবার সঙ্গে বসে আলোচনা করে বিষয়টি মিটমাট করেছি।
এদিকে, চিকিৎসক ও নার্সদের মারধরের ঘটনার প্রতিবাদে ঢামেক হাসপাতালের জরুরি বিভাগ বন্ধ করে দেয়া হয়। বেলা ২টা থেকে বিকাল ৫টা পর্যন্ত জরুরি বিভাগ বন্ধ থাকায় রোগীদের ভোগান্তি ছিল চরমে। বিশেষ করে মুমূর্ষু, বয়স্ক ও শিশু রোগীদের দুর্ভোগ ছিল সবচেয়ে বেশি। এ ছাড়া দূর-দূরান্ত থেকে অনেক রোগীদের অ্যাম্বুলেন্সে করে নিয়ে আসা হলেও তাদের চলে যেতে হয়েছে অন্য হাসপাতালে। তিন ঘণ্টায় অন্তত ৭০ থেকে ৮০ জন রোগী চিকিৎসা না নিয়ে চলে যান। জরুরি বিভাগের সামনে পুলিশ ও আনসার সদস্যরা সারিবদ্ধভাবে অবস্থান নিয়েছিলেন। কলাপসিবল গেট ট্রলি দিয়ে আটকে রাখা হয়। এ নিয়ে রোগী ও তাদের স্বজনরা ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া জানিয়েছেন। কুমিল্লার মুরাদনগরের জরুল মোল্লা (৮৫) গতকাল রাতে ব্রেন স্টোক করায় ভালো চিকিৎসার জন্য স্বজনরা নিয়ে এসেছিলেন ঢামেকে। দেড় ঘণ্টা ধরে তাকে বহনকারী গাড়িতেই তিনি অবস্থান করেন। রোগীর ছোট বোন পারভিন আক্তার অভিযোগ করে বলেন, ঝামেলা হয়েছে তাদের মধ্যে কিন্তু আমরা সাধারণ মানুষেরা মুমূর্ষু রোগী নিয়ে ভোগান্তি পোহাচ্ছি। কিছুক্ষণের মধ্যে যদি তাকে চিকিৎসা দেয়া না যায় তবে রোগীকে আর বাঁচানো যাবে না। ঢামেক জরুরি বিভাগের সামনে প্রসব ব্যথায় চিৎকার করছিলেন পটুয়াখালীর ঝুমুর রানী। একদিকে প্রসব ব্যথা অন্যদিকে কিডনি ও ডায়েবেটিকসের সমস্যা। সব মিলিয়ে খারাপ অবস্থায় এসেছেন ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে। দুপুর দেড়টা থেকে বিকাল ৫টা পর্যন্ত তিনি জরুরি বিভাগের ভবনের বাইরের এক কোনায় বসে কাতরাছিলেন। ঝুমুরের মা হাসি রানী জানান, একটু ভালো চিকিৎসার জন্য সেই পটুয়াখালী থেকে এখানে আসলাম । প্রায় তিন ঘণ্টা ধরে এখানেই বসে আছি। মেয়ের শরীর এত খারাপ কিন্তু এখন পর্যন্ত কোনো চিকিৎসাই দিতে পারলাম না। বার্ন ইউনিটের বাইরের ফাঁকা স্থানে শরীরের ব্যথায় কাতরাচ্ছিলেন মাসুমা আক্তার (২৫)। ব্যথার যন্ত্রণায় কখনো শুয়ে কখনো বসে। পাশেই বসে আছেন তার মা কুলসুম বেগম। অনেকটা কাতর কণ্ঠে বলছিলেন আমার মেয়েটাকে মনে হয় আর বাঁচাতে পারবো না। কিডনির রোগী ছোট বোন তানিয়া রহমানকে (১৪) কুমিল্লা থেকে নিয়ে এসেছেন ওহিদুর রহমান। বোনের অবস্থা বেগতিক হওয়ার কারণে উন্নত চিকিৎসার জন্য কুমিল্লার চিকিৎসকরা ঢাকা পাঠিয়েছে। দুুপুর ২টা থেকে বিকাল চারটা পর্যন্ত অপেক্ষা করে কোনো সুবিধা করতে পারেননি। ওহিদুর রহমান বলেন, ৫ হাজার টাকা দিয়ে একটা অ্যাম্বুলেন্স ভাড়া করে নিয়ে আসলাম। কিন্তু কোনো চিকিৎসাতো দিতে পারিনি বরং আরো ভোগান্তির শিকার হয়েছি। এখন আবার নিয়ে যেতে হবে মহাখালী কিডনি হাসপাতালে। একইভাবে হয়রানির শিকার হন নুরজাহান বেগম (৫০)। সিএনজি দুর্ঘটনায় আঘাত পেয়ে ঘাড়ের রগ কেটেছে সঙ্গে মাথার অনেকটা ফেটে রক্ত বের হচ্ছে। এলাকায় প্রাথমিক চিকিৎসা নিয়ে এসেছেন। জরুরি ভিত্তিতে ভর্তি করা প্রয়োজন। ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি না করে তাকে পাঠানো হয় মিটফোর্ড হাসপাতালে। কিন্তু সেখানেও তাকে ভর্তি না করে আবার পাঠানো হয় ঢামেকে। তার মেয়ে জেসমিন বেগম কেঁদে কেঁদে বলছিলেন, এখন আমরা কি করবো। আমার মায়ের অবস্থা খুব খারাপ। শরীর থেকে অনেক রক্ত ঝরেছে। এখন পর্যন্ত কোনো চিকিৎসা দেয়া হয়নি। ট্রলিতে শুয়ে পেটের ব্যথায় কাতরাচ্ছিলেন রোগী আব্দুস সোবান। তাকে নিয়ে জরুরি বিভাগে অপেক্ষা করছিলেন হাসান। কিন্তু জরুরি বিভাগে রোগীর দীর্ঘ লাইন। কার আগে কে ডাক্তারের রুমে রোগী নিয়ে যাবেন তা নিয়ে স্বজনদের মধ্যে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি চোখে পড়ে। তিন ঘণ্টা অপেক্ষার পর একসঙ্গে রোগীর চাপ সামাল দিতে গিয়েও হিমশিম খাচ্ছিলেন জরুরি বিভাগের কর্তব্যরত চিকিৎসকরা। সরকারি এই হাসপাতালের জরুরি বিভাগে অন্য সময়ে মিনিটে একজন করে রোগী আসে। তার ওপর আবার তিন ঘণ্টা জরুরি বিভাগের কাউন্টার বন্ধ। ফলে পরিস্থিতি কিছু সময়ের জন্য নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে গেলেও পরে আস্তে আস্তে শান্ত হয় বলে কর্তব্যরত আনসার সদস্যরা জানিয়েছেন।