কমনওয়েলথভুক্ত দেশগুলোকে রোহিঙ্গা নাগরিকদের ওপর নির্যাতন বন্ধ করতে এবং বল প্রয়োগের মাধ্যমে বাস্তুচ্যুত হয়ে বাংলাদেশে আসা রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে নিতে মিয়ানমার সরকারের ওপর চাপ প্রয়োগের আহ্বান জানিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তিনি বলেন, মিয়ানমারকে তার নাগরিকদের ওপর নির্যাতন বন্ধ করতে এবং বাংলাদেশে আসা রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে নিতে চাপ প্রয়োগ করুন। প্রধানমন্ত্রী এবং সিপিএ ভাইস
পেট্রন শেখ হাসিনা গতকাল জাতীয় সংসদ ভবনের দক্ষিণ প্লাজায় ৬৩তম কমনওয়েলথ পার্লামেন্টারি কনফারেন্স (সিপিসি)-এর উদ্বোধনকালে প্রধান অতিথির ভাষণে একথা বলেন। তিনি বলেন, মানবিক দৃষ্টিকোণ থেকে সাময়িকভাবে আমরা এই বিপুলসংখ্যক রোহিঙ্গা নাগরিককে আশ্রয় দিয়েছি। ‘সকলের সঙ্গে বন্ধুত্ব, কারও সঙ্গে বৈরিতা নয়’- এই নীতির ভিত্তিতে প্রতিবেশী দেশসমূহের সঙ্গে আমরা সব সময়ই সুসম্পর্ক জোরদার করার লক্ষ্যে কাজ করে যাচ্ছি। এর ফলে আমরা ভারতের সঙ্গে গঙ্গা নদীর পানিচুক্তি এবং স্থল সীমানা চুক্তি সম্পাদনের মাধ্যমে দীর্ঘদিনের বিরোধের শান্তিপূর্ণ নিষ্পত্তি করতে পেরেছি।একইভাবে মিয়ানমার এবং ভারতের সঙ্গে সমুদ্রসীমা নির্ধারণ করা সম্ভব হয়েছে। শেখ হাসিনা বলেন, মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর ওপর অমানবিক নির্যাতন এবং তাদের জোরপূর্বক বিতাড়িত করে দেয়া শুধু এ অঞ্চলে নয়, এর বাইরেও অস্থিরতা তৈরি করছে। সাম্প্রতিককালে মিয়ানমার সরকারের প্রতিহিংসার শিকার হয়ে সেখান থেকে ৬ লাখ ২২ হাজারেরও বেশি সে দেশের নাগরিক বাংলাদেশে প্রবেশ করেছে। ১৯৭৮ সাল থেকে বিভিন্ন সময়ে আরো প্রায় ৫ লাখ রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠী সীমান্ত অতিক্রম করে বাংলাদেশে পালিয়ে এসে আশ্রয় নিয়েছে। তিনি বলেন, ‘আপনাদের অনুরোধ জানাবো রোহিঙ্গা ইস্যুটি বিশেষ গুরুত্বের সঙ্গে আলোচনা করুন। মিয়ানমারকে তার নাগরিকদের ওপর নির্যাতন বন্ধ করতে এবং বাংলাদেশে আসা রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে নিতে চাপ প্রয়োগ করুন। জঙ্গিবাদ ও সন্ত্রাস নির্মূলে একযোগে কাজ করার জন্য প্রধানমন্ত্রী কমনওয়েলথভুক্ত দেশগুলোর প্রতি তার সরকারের অঙ্গীকার পুনর্ব্যক্ত করে বলেন, ‘কিছু মানুষের অপরিণামদর্শী কর্মকাণ্ডের ফলে নিরীহ মানুষের প্রাণ যাচ্ছে। জঙ্গিবাদ আজ আর কোনো নির্দিষ্ট দেশের সমস্যা নয়, এটি বৈশ্বিক সমস্যায় পরিণত হয়েছে। শেখ হাসিনা বলেন, কয়েকদিন আগেই নিউ ইয়র্কের রাস্তায় ট্রাক উঠিয়ে ৮ জন নিরীহ মানুষকে হত্যা করা হয়েছে। আমাদের সকলকে ঐক্যবদ্ধভাবে জঙ্গিবাদ সমস্যার মোকাবিলা করতে হবে। জলবায়ুর বিরূপ প্রভাব মোকাবিলার জন্য উন্নত দেশগুলোর পক্ষ থেকে যেসব সহায়তার প্রতিশ্রুতি দেয়া হয়েছে সেগুলোর দ্রুত বাস্তবায়ন প্রত্যাশা করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, জলবায়ুর বিরূপ প্রভাবের ফলে আমরাই সবচেয়ে বেশি ক্ষতির সম্মুখীন হচ্ছি। এ বছর অতিবৃষ্টিসহ কয়েক দফা বন্যার ফলে আমাদের বিশাল জনপদ ভেসে গেছে। ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে ফসলের। জলবায়ুর বিরূপ প্রভাব মোকাবিলার জন্য যেসব সহায়তার প্রতিশ্রুতি দেয়া হয়েছে, সেগুলোর দ্রুত বাস্তবায়ন প্রত্যাশা করছি। তিনি বলেন, জনপ্রতিনিধি হিসেবে আমাদের প্রথম ও প্রধান নৈতিক দায়িত্ব হচ্ছে গণতন্ত্র এবং সংসদীয় গণতান্ত্রিক রীতিনীতি ও প্রতিষ্ঠানকে আরো শক্তিশালী করা এবং এসব রীতিনীতি ও প্রতিষ্ঠানের প্রতি জনগণের পূর্ণ আস্থা তৈরি করা। শেখ হাসিনা বলেন, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের বিচক্ষণ ও দূরদৃষ্টিসম্পন্ন সিদ্ধান্তের মাধ্যমে ১৯৭৩ সালে সিপিএ’র সদস্য হিসেবে অন্তর্ভুক্ত হয় বাংলাদেশ। এরই ধারাবাহিকতায় ২০১৪ সালে বাংলাদেশ জাতীয় সংসদের স্পিকার ড. শিরীন শারমিন চৌধুরী সিপিএ’র নির্বাহী কমিটির চেয়ারপারসন নির্বাচিত হন। তিনি বলেন, ‘বিশ্বব্যাপী কমনওয়েলথভুক্ত দেশগুলোর সংসদ সদস্যগণের প্রদত্ত এই স্বীকৃতি বাংলাদেশে গণতান্ত্রিক চর্চা ও মূল্যবোধের স্বীকৃতির একটি প্রামাণিক দলিল। প্রবাসে থাকাবস্থাতেই তিনি গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারের সংগ্রামে লিপ্ত হন উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ৬ বছর নির্বাসিত জীবন কাটিয়ে ১৯৮১ সালে দেশে ফিরে আসি। জনগণের শাসন ফিরিয়ে আনার সংগ্রামে আমাকেও কম নির্যাতন সহ্য করতে হয়নি। গৃহবন্দি, জেলখানায় আটক থেকে শুরু করে জীবননাশের প্রচেষ্টা করা হয়েছে বার বার। গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারে তার দলের হাজার হাজার নেতাকর্মী নির্যাতনের শিকার হওয়া সত্ত্বেও গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার সংগ্রাম থেকে বিচ্যুত হননি উল্লেখ করে শেখ হাসিনা বলেন, আমরা মনে করি একমাত্র গণতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থাই মানুষের মৌলিক অধিকারসমূহ ভালোভাবে পূরণ করে উন্নত জীবন নিশ্চিত করতে পারে। প্রধানমন্ত্রী বলেন, দীর্ঘ ২১ বছর পর বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ ১৯৯৬ সালে রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্ব পায়। আমরা শাসক নই, জনগণের সেবক হিসেবে সাধারণ মানুষের মৌলিক চাহিদা পূরণে আত্মনিয়োগ করি। তিনি বলেন, মাঝখানে ৮ বছর বিরতির পর আমার দল আওয়ামী লীগ ২০০৯ সালে আবারো রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্ব পায়। শেখ হাসিনা বলেন, গণতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থার অতন্দ্র প্রহরী স্বাধীন এবং শক্তিশালী গণমাধ্যম। বিগত বছরগুলোতে বাংলাদেশের গণমাধ্যম ব্যাপকভাবে বিকশিত হয়েছে। নিশ্চিত করা হয়েছে তাদের অবাধ স্বাধীনতা। মানুষের তথ্যপ্রাপ্তির অধিকার নিশ্চিত করা হয়েছে। তিনি বলেন, বাংলাদেশ শান্তি, গণতন্ত্র, উন্নয়ন ও সমৃদ্ধির পথ ধরে এগিয়ে চলেছে। ইতিমধ্যে আমরা নিম্ন মধ্যম আয়ের দেশের মর্যাদা লাভ করেছি। আমাদের প্রত্যাশা স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীতে ২০২১ সালে বাংলাদেশ ‘‘মধ্যম আয়ের দেশ’’ এবং ২০৪১ সালে ‘উন্নত সমৃদ্ধ দেশ’ হিসেবে বিশ্ব মানচিত্রে মাথা উঁচু করে দাঁড়াবে। বক্তব্য শেষে প্রধানমন্ত্রী স্মারক ডাক টিকিট উন্মোচন করেন।
জাঁকজমকপূর্ণ উদ্বোধন: সম্মেলনের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে স্বাগত বক্তব্য রাখেন সিপিএ চেয়ারপারসন ও জাতীয় সংসদের স্পিকার ড. শিরীন শারমিন চৌধুরী। এছাড়া বক্তব্য রাখেন সিপিএ সেক্রেটারি আকবর খান। অনুষ্ঠানের শুরুতে বাংলাদেশের জাতীয় সংগীত গাওয়া হয়। এরপর কোরিওগ্রাফির মাধ্যমে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ঐতিহাসিক ৭ই মার্চের ভাষণ, বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রাম, মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস, আবহমান বাংলার পরিবেশ, প্রকৃতি, ঐতিহ্য ও সংস্কৃতি তুলে ধরা হয়। এর ফাঁকে সিপিএ’র গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিরা বক্তব্য দেন। সবশেষে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তার বক্তব্যের মাধ্যমে সম্মেলনের উদ্বোধন ঘোষণা করেন। প্রধানমন্ত্রী সম্মেলনে অংশ নেয়া প্রতিনিধিদের বাংলাদেশে স্বাগত জানিয়ে বলেন, এ ধরনের আন্তর্জাতিক সম্মেলন গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ ও চর্চার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে। উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে ইংল্যান্ডের রানী ও সিপিএ’র প্যাটার্ন দ্বিতীয় এলিজাবেথ শুভেচ্ছা বার্তা পাঠান। তার লিখিত বার্তাটি পাঠ করে শোনান সিপিএ চেয়ারপারসন ড. শিরীন শারমিন চৌধুরী। এর আগে গত ১লা নভেম্বর থেকে সিপিএ সম্মেলনের কার্যক্রম শুরু হয়। রাজধানীর একটি হোটেলে চার দিনব্যাপী ওই সম্মেলনে সদস্য রাষ্ট্রের প্রতিনিধিরা বিভিন্ন ইস্যুতে আলোচনা করেন এবং সেখান থেকে কিছু সুপারিশ সিপিএ’র নির্বাহী কমিটির কাছে পাঠান। এরইমধ্যে সিপিএভুক্ত ৫২ দেশের মধ্যে ৪৪টি দেশের ১১০টি ব্রাঞ্চের জনপ্রতিনিধি অংশগ্রহণ করেছেন। এর মধ্যে ভারতের লোকসভার স্পিকার মীরা কুমারসহ অন্যান্য দেশের সংসদের স্পিকার, ডেপুটি স্পিকারসহ সংসদ সদস্যরা অংশগ্রহণ করেছেন। গতকাল বিকাল থেকে বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রে বিভিন্ন সেশনে প্রতিনিধিরা আলোচনায় অংশগ্রহণ করছেন। সেখানে বাংলাদেশ ডেলিগেটস টিমের প্রধান হিসেবে ডেপুটি স্পিকার মো. ফজলে রাব্বী মিয়া ও জাতীয় সংসদের সদস্যরা অংশ নেন। ড. শিরীন শারমিন চৌধুরী স্বাগত বক্তব্যে বলেন, সিপিএ সবসময় সংসদীয় কূটনীতিকে উৎসাহিত করে। এক দেশের সংসদের সঙ্গে অন্য দেশের সংসদের রীতিনীতির অভিজ্ঞতা বিনিময় করে সংসদকে আরো সমৃদ্ধশালী করতে সিপিএ ভূমিকা রাখে। এসময় তিনি রোহিঙ্গাদের নিজ ভূমিতে প্রত্যাবাসনের জন্য মিয়ানমারের ওপর চাপ সৃষ্টি করতে সিপিএ প্রতিনিধিদের প্রতি আহ্বান জানান। অনুষ্ঠানে শিল্পকলা একাডেমি এবং নৃত্যাঞ্চল শিল্পীগোষ্ঠীর সৌজন্যে বাংলাদেশের ইতিহাস ও কৃষ্টি, ঐতিহ্য, সংস্কৃতি, পরিবেশ এবং সাধারণ মানুষের জীবনযাত্রার উপর ভিত্তি করে বাংলাদেশকে তুলে ধরে বেশকিছু বর্ণাঢ্য প্রামাণ্য চিত্র প্রদর্শন করা হয়। সিপিএ এবং বাংলাদেশ জাতীয় সংসদ যৌথভাবে ‘কনটিনিউয়িং টু এনহান্স দ্যা হাই স্ট্যান্ডার্ডস অব পারফরমেন্স অব পার্লামেন্টারিয়ানস’ এই প্রতিপাদ্যকে সামনে রেখে এই কনফারেন্সের আয়োজন করেছে। সম্মেলনটি ৮ই নভেম্বর শেষ হবে।