সান্দাকানের বল মুমিনুল হকের ব্যাটের আঘাতে এক্সট্রা কভার দিয়ে ছুঁয়ে ফেললো বাউন্ডারির সীমানা। বাউন্ডারি হাঁকিয়েই সেঞ্চুরি পূর্ণ করলেন মুমিনুল হক। সেইসঙ্গে তিনি গড়লেন টেস্টে বাংলাদেশের দ্রুততম সেঞ্চুরির রেকর্ড। গতকাল মুমিনুল সেঞ্চুরি পূর্ণ করেন ৯৬ বলে। এরপরই মুমিনুল বাতাসে দু’হাতে তুলে ধরলেন উচ্ছ্বাসে। ব্যাট-হেলমেট উঁচিয়ে সেঞ্চুরি উদযাপন করলেন তিনি। এরই মধ্যে হঠাৎ ছুটে গেলেন ড্রেসিং রুমের দিকে। সেই সময় বাতাসে ছুড়লেন ব্যাটও। কিন্তু মুখে নেই একটুও হাসি। এমন খেপাটে সেঞ্চুরি উদযাপন করতে তাকে কখনো দেখা যায়নি। তাহলে কি প্রায় চার বছর পর ক্যারিয়ারের পঞ্চম টেস্ট সেঞ্চুরি পাওয়ায় আবেগ তাড়িত হয়ে তার এমন অচেনা রূপ! না, ক্রিকেট নিয়ে যারা খোঁজ-খবর রাখেন তারা ভালো করেই জানেন হাথুরুসিংহে দলের প্রধান কোচ হওয়ার পর কতটা অবহেলিত হয়েছেন মুমিনুল হক। এই ঘরানার ক্রিকেটে দেশের সেরা ব্যাটসম্যান হলেও তাকে খেলতে দেয়া হয়নি শততম টেস্টে। এমনকি ওয়ানডে ও টি-টোয়েন্টিতেও তাকে রাখা হতো দলের বাইরে। সেই হাথুরুসিংহে বাংলাদেশ ছেড়ে, দায়িত্ব নিয়েছেন শ্রীলঙ্কা দলের। জহুর আহমেদ চৌধুরী স্টেডিয়ামে টাইগারদের সঙ্গে লাগোয়া ড্রেসিং রুমে বসেই পেয়েছেন মুমিনুলকে অবহেলা করার জবাব। গতকাল দিন শেষে মুমিনুল অপরাজিত থাকেন ১৭৫ রানে। এতে মুমিনুল হক স্পর্শ করেন টেস্টে ২০০০ রানের মাইলফলক। বাংলাদেশের ব্যাট হাতে টেস্টে দ্রুততম ২০০০ রানের রেকর্ড গড়লেন মুমিনুল হক। এতে তিনি ছাড়িয়ে গেলেন তামিম ইকবালকে। ক্যারিয়ারের ৪৭ ইনিংসে ২০০০ রান পূর্ণ হলো মুমিনুলের। তামিম এ ল্যান্ডমার্ক স্পর্শ করেন ক্যারিয়ারের ৫৩তম ইনিংসে। টেস্ট বাংলাদেশের দ্রুততম ১০০০ রানের রেকর্ডটিও মুমিনুল হকের। এতে সাবেক ব্যাটসম্যান হাবিবুল বাশারের রেকর্ড ভেঙেছিলেন তিনি। চট্টগ্রামে শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে প্রথম ইনিংসে মুমিনুল হকের ব্যাটে চড়ে দলও দেখেছে বড় সংগ্রহের পথ। চট্টগ্রাম টেস্টের প্রথমদিন শেষে শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে ৯০ ওভারে ৪ উইকেট হারিয়ে বাংলাদেশের সংগ্রহ ৩৭৪ রান।
ত্রিদেশীয় সিরিজে শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে হার নিয়ে টাইগারদের গুঁড়িয়ে যায় প্রথমবার কোনো টুর্নামেন্টে শিরোপা জয়ের স্বপ্ন। দলের বাজে ব্যাটিংয়ের সঙ্গে সেদিন যোগ হয় সাকিব আল হাসানের না খেলতে পারার হতাশাটা। ফাইনালে ইনজুরি নিয়ে শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে প্রথম টেস্ট থেকেও ছিটকে পড়েন অধিনায়ক সাকিব আল হাসান। এ কারণে সিরিজের প্রথম টেস্টে মাঠে নামার আগে দলের উপর চাপ ছিল আকাশসম। গতকাল চট্টগ্রামের জহুর আহমেদ স্টেডিয়ামে টস জিতে ব্যাটিং বেছে নেন বাংলাদেশ দলের ভারপ্রাপ্ত অধিনায়ক মাহমুদুল্লাহ রিয়াদ। তামিম ইকবাল ও ইমরুল কায়েসের নৈপুণ্যে ইনিংসের শুরুটাও ছিল দারুণ। কিন্তু দ্রুত ফিফটি হাঁকিয়ে আউট হন চট্টগ্রামের ঘরের ছেলে তামিম। তবে তামিম নিজ মাঠের দশর্কদের হতাশ করলেও মুমিনুল সেই হতাশা ভুলিয়ে দেন। সকালের কুয়াশা কাটার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে সূর্যের তেজ বাড়তে থাকে। আর বাড়তে থাকে মুমিনুলের ব্যটের আলোও। তার প্রিয় পজিশন তিনে ফিরে ব্যাটে চার-ছ’য়ের ফুলঝুরি ছোটান কক্সবাজারের এ ‘লোকাল বয়’। ১৩ চারের মারে ছুঁয়ে ফেলেন সেঞ্চুরি। তার আগে ৯৪ বলে দেশের দ্রুততম সেঞ্চুরির মালিক ছিলেন তামিম। শুধু তাই নয়, মুমিনুলের আরো একটি সেঞ্চুরি আছে ৯৮ বলে।
নিজের মাঠে তামিম টেস্টে মাত্র একটি সেঞ্চুরি হাঁকিয়েছেন। তবে এখানে মুমিনুলের এটি চতুর্থ সেঞ্চুরি। ২০১৩তে শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে অভিষেক ম্যাচে ফিফটি হাঁকিয়ে ক্যারিয়ার শুরু করেন মুমিনুল হক। এরপর সে বছর নিজের পঞ্চম ম্যাচে নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে নিজের টেস্ট ক্যারিয়ারের প্রথম সেঞ্চুরি তুলে নেন। ১৮১ রানের সর্বোচ্চ ইনিংসটি এখনো তার সেরা। ৪ সেঞ্চুরি হয়ে গিয়েছিল প্রথম ১২ টেস্টেই। পরের ১৩ টেস্টে সেঞ্চুরি নেই। পঞ্চাশ ছুঁয়েছেন মাত্র ৫ বার। এই সময়ে ব্যাটিং গড় ছিল ২৭.৯১। এই ধাক্কায় ক্যারিয়ার গড়ও অতিমানবীয় থেকে নেমে এসেছে সাধারণের কাতারে। অবশেষে কাটল সেই খরা। সর্বশেষ ২০১৪ সালে সেঞ্চুরি করেছিলেন জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে। এবার ২৬তম ম্যাচে দাঁড়িয়ে প্রথম ডবল সেঞ্চুরির অপেক্ষায়।
সাবেক কোচ চন্ডিকা হাথুরুসিংহের সঙ্গে বাংলাদেশের ক্রিকেটারের দ্বন্দ্ব ছিল ‘ওপেন সিক্রেট’। তিনি কোচ হওয়ার কিছুদিন পরই শর্ট বলে মুমিনুলের দুর্বলতার কথা বলে আলোচনার জন্ম দিয়েছিলেন। গত বছর শ্রীলঙ্কা সফরে গল টেস্টে দিলরুয়ান পেরেরার অফ স্পিনে আউট হওয়ার পর সেই সময়ের কোচ বলেছিলেন অফ স্পিনে মুমিনুলের দুর্বলতার কথাও। সেই অজুহাতে দেশের শততম টেস্টে তাকে বসিয়ে রেখেছিলেন মাঠের বাইরে। সেই মুমিনুল এবার বলের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে সেঞ্চুরি করলেন হাথুরুসিংহের দলের বিপক্ষেই।
মুমিনুল শুরুতে সঙ্গী হিসেবে পেয়েছিলেন কোচ হাথুরুর পরীক্ষা-নিরীক্ষার শিকার ওপেনার ইমরুল কায়েসকেও। ওপেনিং থেকে সরিয়ে মুমিনুলের জায়গা দখলের জন্য ইমরুলকে ব্যবহার করেছিলেন বাংলাদেশের সাবেক কোচ। গতকাল ইমরুলকে নিয়ে দ্বিতীয় উইকেটে মুমিনুল গড়েন ৪৮ রানের জুটি। এরপর মুমিনুল সঙ্গী হিসেবে পান হাথুরুসিংহের কারণে বোর্ডের সঙ্গে প্রকাশ্যে দ্বন্দ্বে জড়ানো সাবেক অধিনায়ক মুশফিকুর রহীমকে। তৃতীয় উইকেটে এ দু’জন গড়েন ২৩৬ রানের জুটি। টেস্টে বাংলাদেশের তৃতীয় উইকেটে সর্বোচ্চ রানের রেকর্ড এটি। এর আগে তৃতীয় উইকেট জুটিতে ১৫৭ রানের রেকর্ড গড়েন মুমিনুল ও তামিম ইকবাল। গতকাল ৯২ রান করে মুশফিক হাল ছাড়লেও শেষ পর্যন্ত ২০৩ বল খেলে মুমিনুল অপরাজিত থাকেন ১৬ চার ও একটি ছক্কা হাঁকিয়ে। এর আগে চট্টগ্রামের ভেন্যুতে শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে নিজের দ্বিতীয় সেঞ্চুরি হাঁকিয়েছিলেন মুমিনুল।