চট্টগ্রাম বন্দরের জাহাজজট নিয়ে প্রতিদিনই ভোগান্তিতে পড়ছেন ব্যবসায়ীরা। জটের কারণে বন্দরের জলসীমায় জাহাজ আসার পর থেকে জেটিতে কনটেইনার নামাতে তিন দিন বাড়তি সময় লাগছে। এমন ভোগান্তির পরও ব্যবসায়ীরা চট্টগ্রামমুখী।
অন্যদিকে জট না থাকায় মোংলা বন্দরে জাহাজ থেকে কনটেইনার নামাতে এক দিনও দেরি করতে হচ্ছে না। তারপরও ব্যবসায়ীদের অনাগ্রহের কারণে সেখানে কনটেইনারে পণ্য আমদানি-রপ্তানি কমছে। ফলে বন্দরের জেটিতে সব সময় দেখা মিলছে না কনটেইনার জাহাজের।
মোংলা বন্দরের হিসাবে, গত পাঁচ অর্থবছরে বন্দরটি দিয়ে ধারাবাহিকভাবে কনটেইনার পরিবহন কমছে। ২০১২-১৩ অর্থবছরে বন্দর দিয়ে ৪৩ হাজার ৮৭৩ কনটেইনার পণ্য পরিবহন হয়। এরপর শুধু কমছেই। সর্বশেষ ২০১৬-১৭ অর্থবছরে ২৬ হাজার ৯৫২ কনটেইনার পণ্য পরিবহন হয়। বছরে ১ লাখ কনটেইনার ওঠানো-নামানোর ক্ষমতা থাকলেও তার মাত্র ২৭ শতাংশ ব্যবহৃত হচ্ছে মোংলায়। মানে সক্ষমতার ৭৩ শতাংশই অব্যবহৃত থাকছে।
দেশে সমুদ্রপথে কনটেইনার পরিবহন হয় শুধু চট্টগ্রাম ও মোংলা বন্দর দিয়ে। কনটেইনার পরিবহনে সংখ্যার হিসাবে দুই বন্দরের তুলনা করে দেখা যায়, সমুদ্রপথে বিদেশ থেকে এখন যত কনটেইনার আনা-নেওয়া হয়, তার প্রায় ৯৯ শতাংশই পরিবহন হচ্ছে চট্টগ্রামের মাধ্যমে। আর মোংলা বন্দরে হচ্ছে মাত্র ১ শতাংশ। তবে দুই বছর আগেও তা ছিল ২ শতাংশ।
চট্টগ্রাম বন্দরের হিসাবে, চট্টগ্রাম দিয়ে আমদানি-রপ্তানি হওয়া পণ্যের ৭০ শতাংশই চট্টগ্রামের বাইরে ঢাকা ও আশপাশের অঞ্চলের ব্যবসায়ীদের। ঢাকার ব্যবসায়ীরা পণ্য আমদানি-রপ্তানিতে চট্টগ্রামমুখী হলেও মোংলামুখী হচ্ছেন না। ফলে মোংলা বন্দর ব্যবহার করছেন মূলত খুলনা অঞ্চলের ব্যবসায়ীরা। তা ছাড়া সরকারি খাদ্যশস্য ও সার আমদানির ৪০ শতাংশ এই বন্দরে খালাসের বাধ্যবাধকতা আছে। সে জন্য সাধারণ পণ্যবাহী জাহাজ (বাল্ক জাহাজ) বাড়ছে মোংলায়।
জানতে চাইলে নিট পোশাকশিল্পের মালিকদের সংগঠন বিকেএমইএর সহসভাপতি মোহাম্মদ হাতেম স্বদেশ নিউজ২৪ ডটকম , মোংলার সঙ্গে ঢাকার যোগাযোগব্যবস্থা ভালো না হওয়ায় ঢাকা অঞ্চলের ব্যবসায়ীদের এই বন্দর ব্যবহারে আগ্রহ কম। তবে পদ্মা সেতু হয়ে গেলে মোংলার সঙ্গে ঢাকার যোগাযোগব্যবস্থা উন্নত হয়ে যাবে। তখন ব্যবসায়ীরাও মোংলামুখী হবেন। এ জন্য আগে থেকেই মোংলা বন্দরে খননকাজ করে চট্টগ্রামের মতো জাহাজ ভেড়ানোর উপযোগী করতে হবে। নাব্যতার সংকটসহ বিদ্যমান সমস্যাগুলো নিরসন করতে হবে।
কয়েকজন বন্দর ব্যবহারকারী জানালেন, চট্টগ্রামে যেখানে সাড়ে নয় মিটারের ড্রাফটের (জাহাজের নিচের অংশের গভীরতার দৈর্ঘ্য) কনটেইনারবাহী জাহাজ ভেড়ানো যায়, সেখানে মোংলায় ভেড়ানো যায় সাত মিটার ড্রাফটের জাহাজ। আবার এসব জাহাজ সর্বোচ্চ ধারণক্ষমতা অনুযায়ী মোংলায় কনটেইনার পণ্য নিয়ে জেটিতে ভেড়ানো যায় না।
বাগেরহাটের মোংলা উপজেলায় পশুর ও মোংলা নদীর সংযোগস্থলে ১৯৫০ সালে চালনা বন্দর প্রতিষ্ঠা করা হয়। ১৯৮৭ সালের ৮ মার্চ এটি মোংলা বন্দর হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে। বর্তমানে বন্দরটিতে জেটি আছে পাঁচটি। মোংলা দিয়ে বছরে ১ লাখ কনটেইনার এবং কার্গোতে ১ কোটি মেট্রিক টন পণ্য পরিবহন ও ২ হাজার গাড়ি আনা সম্ভব।
মোংলা বন্দর দিয়ে মাসে বর্তমানে দুটি বিদেশি জাহাজ কোম্পানির চার-পাঁচটি জাহাজ কনটেইনার নিয়ে আসা-যাওয়া করছে। তার মধ্যে একটি পিআইএল বাংলাদেশ লিমিটেড। প্রতিষ্ঠানটির মহাব্যবস্থাপক মো. আবদুল্লাহ জহির স্বদেশ নিউজ২৪ ডটকমকে, একই ধরনের জাহাজ চট্টগ্রামে ৮৫০ একক কনটেইনার নিয়ে জেটিতে ভেড়ানো গেলেও মোংলায় নেওয়া যায় ৬০০ কনটেইনার। তাই মোংলায় জাহাজ পরিচালনা করে বিদেশি কোম্পানিগুলো প্রত্যাশা অনুযায়ী ব্যবসা করতে পারে না। চট্টগ্রামে সবাই ঝাঁপিয়ে পড়লেও মোংলায় সবাই জাহাজ পরিচালনা করছে না।
এদিকে নাব্যতা ও যোগাযোগব্যবস্থার পাশাপাশি মোংলা বন্দর চত্বর থেকে পণ্য খালাসের জন্য এক জায়গায় সব সুযোগ-সুবিধা নেই। ১৯৫০ সালে দেশের দ্বিতীয় সামুদ্রিক বন্দর হিসেবে কার্যক্রম শুরুর পর থেকেই মোংলা কাস্টমস হাউসের অবস্থান খুলনার খালিশপুরে। মোংলা বন্দর থেকে খালিশপুরের দূরত্ব ৫৮ কিলোমিটার। একজন ব্যবসায়ীকে শুল্কায়নসহ পণ্য খালাসের জন্য দুই থেকে তিন দফায় খুলনা-মোংলা যাতায়াত করতে হয়। এ জন্য জাহাজ থেকে পণ্য খালাসে বিলম্ব হয়।
বাংলাদেশ শিপিং এজেন্ট অ্যাসোসিয়েশনের এক নেতা বলেন, কাস্টম হাউস মোংলায় নিয়ে এলেই সমস্যার সমাধান হবে না। শুল্কায়ন কার্যক্রমের সঙ্গে বেশ কিছু কার্যক্রম জড়িত। ব্যাংকিং সেবা, ক্লিয়ারিং অ্যান্ড ফরোয়ার্ডিং (সিঅ্যান্ডএফ), শিপিং এজেন্সির কার্যক্রমসহ বেশ কিছু সরকারি-বেসরকারি কার্যালয়ও মোংলায় স্থানান্তর করতে হবে।
অন্যদিকে মোংলা কাস্টমস সিঅ্যান্ডএফ অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি সুলতান হোসেন খান স্বদেশ নিউজ২৪ ডটকমকে বলেন, মোংলায় শুল্কায়ন ,পণ্যের কায়িক পরীক্ষা ইত্যাদি কার্যক্রমে সময় লাগে বেশি। জাহাজ থেকে পণ্য নামানোর পর এসব কাজ শেষ করে পণ্য খালাস করতে সময় লাগে।
বন্দরটির সঙ্গে ঢাকার যোগাযোগ কঠিন, নাব্যতার সংকট, জেটিতে কনটেইনার ওঠানো-নামানোর জন্য ক্রেন না থাকা এবং পণ্য হ্যান্ডেলিংয়ের যন্ত্রপাতির অভাবকে দায়ী করলেন মোংলা বন্দর কর্তৃপক্ষের চেয়ারম্যান কমোডর এ কে এম ফারুক হাসান।
এ কে এম ফারুক হাসান সম্প্রতি স্বদেশ নিউজ২৪ ডটকমকে বলেন, বন্দরের নাব্যতার সংকট দূর করতে বহির্নোঙরে খনন কাজের জন্য দরপত্র আহ্বান করা হয়েছে। বন্দর জেটির কাছাকাছি ফুড সাইলো ও জয়মনির ঘোল এলাকায় খননকাজের জন্যও মন্ত্রণালয়ে প্রকল্প পাঠানো হয়েছে। পাঁচটি জেটির পাশাপাশি আরও আটটি জেটি নির্মাণের প্রকল্প হাতে নেওয়া হয়েছে। কনটেইনার ওঠানো-নামানোর যন্ত্রপাতি, কনটেইনার রাখার চত্বর নির্মাণসহ বেশ কিছু প্রকল্পও হাতে নেওয়া হয়েছে। প্রকল্পগুলো বাস্তবায়িত হলে মোংলার ব্যবহার বাড়বে বলে আশা প্রকাশ করেন তিনি।