১৬ কোটি মানুষের স্বপ্ন ৬ দশমিক ১৫ কিলোমিটার দৈর্ঘের পদ্মা বহুমুখী সেতু এখন স্বপ্নের খোলস থেকে বেরিয়ে রূপ নিয়েছে দৃশ্যমান বাস্তবতায়। ২০১৯ সালেই পুরো পদ্মা সেতুর নির্মাণকাজ শেষ করা যাবে।আওয়ামী লীগ সরকার এসে বহুল আলোচিত পদ্মা সেতু প্রকল্প পাস করেছিল। পদ্মা সেতুর ব্যয় ধরা হয় সব মিলিয়ে ২৮ হাজার ৭৯৩ কোটি টাকা। শুরু হয় পদ্মা বহুমুখী সেতুর কাজ।
পদ্মা সেতু প্রকল্পের পিলার সমস্যা দেখা দিলেও বর্তমানে তা পুরোপুরি সমাধান হয়ে গেছে। নদীর মধ্যে থাকা ৪০টি পিলারের মধ্যে ২২টির নকশা পরিবর্তন করা হয়েছে। পরিবর্তিত নকশা অনুযায়ী বেশ কয়েকটি পিলারের কাজ এরই মধ্যে শুরু হয়ে গেছে। নির্মাণকাজের সঙ্গে জড়িত প্রকৌশলীরা বলছেন, তাদের এখন টেনশনই নেই। আর প্রকল্পের বিশেষজ্ঞরা জানান, ২০১৯ সালেই পুরো পদ্মা সেতুর নির্মাণকাজ শেষ করা যাবে।
প্রকৌশলীরা জানান, সেতুর ১৪টি পিলারের নকশা অনুযায়ী কাজ করা যাচ্ছিল না। এর সঙ্গে আটটি পিলারের সাতটি করে পাইল বসানোর সিদ্ধান্ত আগেই নেওয়া হয়েছিল। সব মিলিয়ে ২২টি পিলারের নকশা পরিবর্তন করা হয়েছে। বাকি ১৮টি পিলারে আগের নকশা অনুসারে ছয়টি করে পাইল বসানোর কাজ শেষ হয়েছে। নকশার সব সমস্যার সমাধান হওয়ায় ২০১৯ সালে পদ্মা সেতুর নির্মাণকাজ শেষ করা সম্ভব হবে। ২০১৮ সালের মার্চ মাস পর্যন্ত পদ্মা সেতু প্রকল্পের ৫৩ শতাংশ কাজ সম্পন্ন হয়েছে বলে জানান সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রণালয়ের জ্যেষ্ঠ সচিব খন্দকার আনোয়ারুল ইসলাম।
৩ এপ্রিল রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ পদ্মা সেতুর নির্মাণকাজ পরিদর্শনের সময় সচিব এ তথ্য জানান। তবে পদ্মা সেতু নির্মাণ প্রকল্পের ওয়েবসাইটের তথ্য অনুসারে, এ বছরের জানুয়ারি মাস পর্যন্ত মূল সেতুর ৫৭ শতাংশ কাজ শেষ হয়েছে। পদ্মা সেতু প্রকল্পের বিশেষজ্ঞ দলের প্রধান অধ্যাপক জামিলুর রেজা চৌধুরী বলেন, ২২টি পিলারের মধ্যে বেশির ভাগ পিলারের নতুন নকশা গত ১৯ মার্চ মূল সেতুর ঠিকাদার চায়না মেজর ব্রিজ ইঞ্জিনিয়ারিং কনস্ট্রাকশন কোম্পানির কাছে পাঠানো হয়েছে। বাকি নকশা চূড়ান্ত হয়ে গেছে। সেগুলো দ্রুতই তাদের কাছে পাঠানো হবে।
এখন আর কোনো বাধা নেই। ২০১৯ সালের মধ্যে পদ্মা সেতুর নির্মাণ হয়ে যাবে। তবে নদীশাসন সম্পন্ন হতে আরো কিছুটা দেরি হতে পারে। নদীর তলদেশের গভীরে নরম মাটির স্তর থাকায় হ্যামার দিয়ে পাইল বসাতে গিয়ে ৬, ৭, ৮, ৯, ১০, ১১, ১২, ২৬, ২৭, ২৯, ৩০, ৩১, ৩২ ও ৩৫ নম্বর পিলারের কাজে সমস্যা দেখা যায়। তাই এই ১৪টি পিলারের নকশা চূড়ান্ত করা যাচ্ছিল না।
সমস্যা সমাধানে কাজ শুরু করে ব্রিটিশ পরামর্শক প্রতিষ্ঠান কাউই (COWI) ইউকে লিমিটেড। কাউই ইউকের বিশেষজ্ঞরা মাটি পরীক্ষার প্রতিবেদনসহ বিভিন্ন তথ্য যাচাই করেন। তাদের সঙ্গে যোগ দেয় আরো কয়েকটি বিদেশি পরামর্শক প্রতিষ্ঠান। এসব প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে পদ্মা সেতু প্রকল্পের বিশেষজ্ঞ দলের কয়েক দফা বৈঠক হয়। কাদামাটির পরই শক্ত মাটি না পাওয়ায় পদ্মা সেতুর ২২টি পিলারে একটি করে পাইলের সংখ্যা বাড়ানো হচ্ছে। এসব খুঁটিতে ছয়টি পাইল অন্যান্য পিলারের মতোই রেকিং বা কিছুটা বাঁকা করে বসানো হবে।
এই ছয়টি পাইলের মধ্যে ৭ নম্বর পিলার ভার্টিক্যাল বা সরাসরি সোজাভাবে বসানো হবে। এ জন্য পদ্মা সেতুতে মোট পিলারের সংখ্যা ২৪০ থেকে বেড়ে হবে ২৬২টি। পদ্মা সেতুর প্রকল্পের এক ঊর্ধ্বতন প্রকৌশলী জানান, ২২টি পিলারের মধ্যে ১৫, ১৯, ২৪, ২৫, ২৮, ৩৩, ৩৪, ৩৫ ও ৩৬ নম্বর পিলারের নকশা মার্চ মাসের মাঝামাঝি সময়ে চায়না মেজর ব্রিজ ইঞ্জিনিয়ারিং কনস্ট্রাকশন কোম্পানির কাছ পাঠানো হয়েছে।
আগের ১৮টিসহ এ পর্যন্ত এই প্রতিষ্ঠানের কাছে ২৭টি পিলারের চূড়ান্ত নকশা দেওয়া হয়েছে। নতুন নকশায় নয়টি পিলারের পাইল বসানোর কাজ চায়না মেজর ব্রিজ ইঞ্জিনিয়ারিং কনস্ট্রাকশন শুরু করে দিয়েছে। বাকি ১৩টি পিলারের নকশা দ্রুত তাদের দেওয়া হবে। দ্বিতলবিশিষ্ট পদ্মা সেতু হচ্ছে মুন্সিগঞ্জের মাওয়া ও শরীয়তপুরের জাজিরার মধ্যে। মূল সেতুর দৈর্ঘ্য (পানির অংশের) ৬ দশমিক ১৫ কিলোমিটার। ডাঙার অংশ ধরলে সেতুটি প্রায় নয় কিলোমিটার দীর্ঘ হবে।
পিলারের ওপর ইস্পাতের যে স্প্যান বসানো হবে, এর ভেতর দিয়ে চলবে ট্রেন। আর ওপর দিয়ে চলবে যানবাহন। পুরো সেতুতে মোট পিলার হবে ৪২টি। এর মধ্যে নদীতে থাকবে ৪০টি পিলার। এক পিলার থেকে আরেক পিলারের দূরত্ব ১৫০ মিটার। এর মধ্যে ৩৭, ৩৮, ৩৯ ও ৪০ নম্বর পিলারে তিনটি স্প্যান বসানোর মধ্য দিয়ে পদ্মা সেতুর ৪৫০ মিটার এখন দৃশ্যমান হয়েছে। এ ছাড়া ২৬২টি পাইলের মধ্যে মার্চের তৃতীয় সপ্তাহ পর্যন্ত ১৬২টি পাইল বসানোর কাজ শেষ হয়েছে। ৪০ ও ৪১ নম্বর পিলারের ওপর আরো একটি স্প্যান এপ্রিল মাসের শেষ দিকে বসানোর আশা করছেন প্রকল্প-সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা।
জাজিরায় একেবারে শেষ ৪২ নম্বর পিলারের নির্মাণকাজও শেষের পথে। এ ছাড়া মাওয়া প্রান্তে ২ নম্বর পিলারও দৃশ্যমান হয়েছে। বর্তমান সরকারের অবদানেই ২০১৯সালেই বাংলাদেশ পেতে যাচ্ছে বহু কাঙ্খিত পদ্মা বহুমুখী সেতু।