গতকাল দিবাগত রাতে, বঙ্গবন্ধু-১ স্যাটেলাইট ছুটে গেছে অনন্ত নক্ষত্র বীথির পানে। বাংলাদেশ প্রবেশ করেছে স্যাটেলাইট যুগে। দিনটা স্মরণীয় হয়ে থাকতে পারত ক্রীড়াঙ্গনেও। যদি বাংলাদেশ ওপেনের শিরোপাটা জিততে পারতেন বাংলাদেশেরই কোনো গলফার। কিন্তু হলো না। চতুর্থ আসরে এসেও বাংলাদেশ ওপেনের শিরোপাটা অধরাই থেকে গেল স্বাগতিক খেলোয়াড়দের কাছে। বিগত আসরগুলোর মতো এবারও তাঁদের চোখের সামনে শিরোপা, প্রাইজমানির সিংহভাগ সবই নিয়ে গেলেন বিদেশি গলফাররাই। শেষ দিনে ৬ আন্ডারপার খেলে জ্যাক হ্যারিসনকে পেছনে ফেলে চ্যাম্পিয়ন হয়েছেন সুইডেনের ম্যালকম কোকোচিনস্কি। ইংল্যান্ডের গলফার জ্যাক হ্যারিসন হয়েছেন দ্বিতীয় আর তৃতীয় নিউজিল্যান্ডের বেন ক্যাম্পবেল। বাংলাদেশের জামাল হোসেন মোল্লা হয়েছেন চতুর্থ।
২০১৫ সালে, বসুন্ধরা গ্রুপের উদ্যোগে যখন বাংলাদেশে টানা তিন বছর এশিয়ান ট্যুর আয়োজনের সুসংবাদ পাওয়া যায়, এর পর থেকেই নানা অনুষ্ঠানে গলফার ও কর্মকর্তারা বলে এসেছেন শিরোপা জয়ের সম্ভাবনার কথা। কুর্মিটোলা গলফ ক্লাবকে ঘিরেই মূলত বাংলাদেশে গলফের মূল পদচারণ, বেশির ভাগ গলফারের কাছেই এই মাঠ হাতের তালুর মতো চেনা। এই যুক্তি দিয়ে স্থানীয় আয়োজকরা দেশের শিরোপা দেশেই রেখে দেওয়ার স্বপ্ন দেখালেও সেই স্বপ্নের বাস্তবায়ন এখনো দেখা যায়নি। এই মাঠেই মাত্র প্রথমবার খেলতে এসে, এক বছরেরও কম সময় আগে পেশাদার সার্কিটে পা রাখা জাপানি তরুণ জিতে কিছুদিন আগেই নিয়েছিলেন বিটিআই ওপেনের শিরোপা। যে টুর্নামেন্টে জামাল হয়েছিলেন দ্বিতীয় আর ম্যালকম তৃতীয়। সেই ম্যালকমই এখানে খেলার অভিজ্ঞতাটা কাজে লাগিয়ে জিতলেন নিজের প্রথম এশিয়ান ট্যুর শিরোপা। ২০১৫ সালে প্রথম আসরেও অংশ নেওয়া ম্যালকম সেবার কাটই পাননি, পরের বছর অংশ নিয়ে হয়েছিলেন ১৪তম। আর এবার তো শিরোপা জিতেই ফিরছেন বাড়ি। আসলে কুর্মিটোলা গলফ ক্লাবের কোর্সটা অনেক গলফারের জন্যই পয়মন্ত, কারণ প্রথম আসরের শিরোপাজয়ী মার্দান মামাত বাদে বাকি তিন চ্যাম্পিয়নই তাঁদের ক্যারিয়ারের প্রথম এশিয়ান ট্যুর জিতেছেন এখানে। শুধু আক্ষেপ এই যে তাঁদের মধ্যে বাংলাদেশের কেউ নেই।
তবু বাংলাদেশের পেশাদার গলফের সর্বোচ্চ সংস্থা বিপিজিএর মহাসচিব ব্রিগেডিয়ার জেনারেল কামরুল ইসলাম মনে করছেন এই ফল সন্তোষজনক, ‘আসলে আমরা সারা বছর যেসব গলফারদের নিয়ে স্থানীয় টুর্নামেন্টগুলো আয়োজন করি, তাদের যেসব সুযোগ-সুবিধা দিই, তার থেকে এই টুর্নামেন্টের মান অনেক ওপরে। বাংলাদেশের গলফাররা যে এতটুকু এসেছে, সেটাও আমি বলব অনেকটাই নিজেদের প্রতিভার জোরেই এসেছে। ২৬টি দেশের প্রতিযোগীরা এসেছে এখানে, অত্যন্ত উঁচু মানের প্রতিদ্বন্দ্বিতা হয়েছে। সেখানে বাংলাদেশের গলফাররা একেবারে খারাপ করেননি।’
এই কুর্মিটোলার সবুজে খেলেই সিদ্দিকুর রহমান অতি সাধারণ একজন থেকে হয়ে উঠেছেন অসাধারণ। গলফের দুনিয়ায় লাল-সবুজের নিশানটা ওড়েই তাঁর জন্য। সেই সিদ্দিক যেন ইদানীং নিজের চেনা জায়গায় এলেই হয়ে পড়েন অচেনা! গত আসরে রানার-আপ হওয়াটা বাদ দিলে বাংলাদেশ ওপেনের বাকি তিন আসরেই তাঁর পারফরম্যান্স সাদামাটা। যেখানে দেশের বাইরে অনেক প্রতিযোগিতাতেই তিনি রেখেছেন প্রতিভার স্বাক্ষর। সমস্যাটা যে কোথায়, জানেন না তিনি নিজেও, ‘একটা রাউন্ডও ভালো খেলতে পারিনি। যে পরিমাণ আশা ছিল, সেই অনুযায়ী খেলতে পারিনি। লং গেম, শর্ট গেম; সবই খারাপ হয়েছে। আমিও জানি না আমার সমস্যাটা কোথায়। কোনো একটা সমস্যা হয়তো হচ্ছে, যেটা আমি বুঝে উঠতে পারছি না।’
জামালের এটাই এশিয়ান ট্যুরে সেরা পারফরম্যান্স। কিছুদিন আগেই বিটিআই ওপেনে রানার-আপ হয়ে জিতেছেন প্রায় সাত হাজার ডলার। এশিয়ান ট্যুরে চতুর্থ হয়ে পাচ্ছেন প্রায় দ্বিগুণ, সাড়ে ১৩ হাজার ডলার। তাই তো বলছেন, ‘ঠিক আছে, খুশি, অখুশি বলা যাবে না। তবে তৃতীয় রাউন্ডটায় অনেকটা বেশি চাপ নিয়ে নিয়েছি। আমাদের সাধ্যের মধ্যেই ছিল, ১৪/১৫ আন্ডার আমরাও খেলি এখানে। সেদিনও শেষ দুটি হোলে বোগি হয়ে গেল। আজকেও (গতকাল) তাই।’ জামাল অবশ্য সিদ্দিকের মতো ধাঁধায় নেই, বুঝতে পারছেন নিজের দুর্বলতা, ‘আমি ড্রাইভ খুব খারাপ মেরেছি। ডাবল বোগি হয়েছে, ভাগ্যও খারাপ ছিল।’ প্রত্যাশার চাপে কেউ নুয়ে পড়েছেন, কেউ দোষ দিচ্ছেন ভাগ্যকে। অন্যদিকে সব প্রতিকূলতা জয় করে অনেকটা নীরবেই ১৪ নম্বরে উঠে এসেছেন বাদল হোসেইন। সিদ্দিকের সঙ্গে একই গ্রুপে খেললেও অন্তত এই আসরে পেছনে ফেলেছেন বাংলাদেশের সেরা গলফারকে। সিদ্দিকের কণ্ঠে প্রশংসা তাঁর জন্য, ‘আমার সঙ্গে খেলেছে বাদল, সে -২তে শেষ করেছে। আমাদের পরেও অনেকে উঠে আসছে।’
এই উন্নতির পথে যাত্রায় এশিয়ান ট্যুরের এবারের আয়োজন ব্যর্থ, এমনটা ভাবতে রাজি নন অনেকেই। প্রাপ্তির খাতা একেবারে শূন্য নয়, তবে অপূর্ণতার খাঁ খাঁ অংশটুকুই যে বেশি!