সারা দেশে কোটা সংস্কারের দাবিতে আন্দোলন করা শিক্ষার্থীদের ওপর হামলা, গ্রেফতার ও নির্যাতনের প্রতিবাদে আয়োজিত সমাবেশে ৭ দফা দাবি জানিয়েছে উদ্বিগ্ন অভিভাবক ও নাগরিক সমাজ।
৬ জুলাই, শুক্রবার বিকেলে জাতীয় প্রেসক্লাবের সামনে এই প্রতিবাদ সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়।
উদ্বিগ্ন অভিভাবক ও নাগরিক সমাজ-এর পক্ষে প্রতিবাদ সমাবেশে অ্যাডভোকেট হাসনাত কাইয়ুম বলেন, ‘এই সমাবেশ গত ৩ জুলাই হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু আপনারা জানেন, সেই সমাবেশটি সরকার আমাদের করতে দেয়নি এবং সমাবেশস্থল থেকে বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন অধ্যাপক ও একজন সাবেক ছাত্র নেতাকে আটকের পর তাদের ছেড়ে দেওয়া হয়। এর অর্থ আমাদের বুঝে নিতে হবে, আমাদের সন্তানেরা এ দেশে কোনো ন্যায্য দাবি করলে প্রথমে সরকার ও রাষ্ট্র তার বাহিনী দিয়ে নৃশংসভাবে পেটাব, আটক করবে, মিথ্যা মামলা দেবে, রিমান্ডে নেবে, জেলে দেবে এবং তার জন্য আমরা অভিভাবকেরা প্রতিবাদও করতে পারব না। করলে সেখানেও হামলা করা হবে, জেলে নেওয়া হবে। আমরা বলতে চাই, একাত্তরে তিরিশ লাখ প্রাণ আমরা এমন একটি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার জন্য দিইনি।’
তিনি আরও বলেন, ‘আমাদের সন্তানেরা বর্তমানে তাদের ন্যায্য দাবি- কোটা ব্যবস্থার সংস্কার, যেটা মাননীয় প্রধানমন্ত্রী একাধিকবার মেনে নেওয়ার ঘোষণা দিয়েছেন; তার প্রজ্ঞাপন জারির দাবিতে সংবাদ সম্মেলন আয়োজনের সময় সরকারি দলের ছাত্রসংগঠন যে বীভৎস ও অমানবিক হামলা পরিচালনা করেছে এবং সারাদেশে শিক্ষার্থীদের উপর যে পৈচাশিক নির্যাতন-নিপীড়ন অব্যাহত রেখেছে, তা বাংলাদেশের ইতিহাসে নজিরবিহীন।’
প্রতিবাদ সমাবেশে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ফাহমিদুল হক বলেন, ‘কোটা বাতিল করার সিদ্ধান্ত জানানোর এতদিন পরও কোনো প্রজ্ঞাপন বা সুস্পষ্ট কোনো বক্তব্য জারি হয়নি। তাই শিক্ষার্থীদের এ বিষয়ে মাঠে নেমে আন্দোলন একটি যৌক্তিক অধিকার। কিন্ত সব কিছু এখন উল্টো হচ্ছে। আমরা কোন রাষ্ট্রে বসবাস করছি, যাদের ওপরে আক্রমণ করা হচ্ছে তাদেকেই আবার গ্রেফতার করা হচ্ছে। কিন্ত যারা আক্রমণকারী তাদের কোনো বিচার হচ্ছে না। এ এই প্রতিবাদ সমাবেশ থেকে আমরা আমাদের নাগরিক অধিকার আদায়ের দাবি জানাতে এসেছি। আমাদের সন্তানদের ওপরে প্রক্যাশে ও গোপনে এসব হামলার ঘটনা বন্ধ করতে হবে। আমাদের সন্তানদের কোনোভাবেই যেন আর হয়রানি না করা হয়। আমরা এইটুকু চাই ওই সকল হামলাকারীদের যেন দ্রুত গ্রেফতার করা হয়।’
সমাবেশে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক শিক্ষার্থী জাকির হোসেন বলেন, ‘আমাদের সন্তানদের একটা ন্যায্য আন্দোলনে বাধা দেওয়া হচ্ছে। আমরা কোনো রাজনৈতিক আন্দোলন করছি না। একটা ন্যায্য দাবিতে আন্দোলন করছি। কিন্ত আমাদের দেশে এখন কেউ কোনো আন্দোলন করলেই তাকে বিএনপি-জামাত বানিয়ে দেওয়া হচ্ছে। সেটাকে সরকারবিরোধী আন্দোলন বলা হচ্ছে। আমরা শুধু মাত্র কোটার সংস্কারে যে আন্দোলন হচ্ছে তাতে যেন আর কেউ হামলা, গ্রেফতারের শিকার না হয় সেই আহব্বান জানাচ্ছি।’
সমাবেশে জ্যোতির্ময় বড়ুয়া বলেন, ‘আপনারা জানেন ইতোমধ্যে বিভিন্নভাবে এই আন্দোলনের গতিপ্রকৃতি পাল্টে গেছে। ছাত্রলীগ কখনো এই আন্দোলনের সাথে আছে, কখনো নাই। কখনো তারা হাতুড়ি নিয়ে আবার কখনো তারা বিজয় উল্লাসে। তারা নিজেরাও এখনো নিশ্চিত না যে, এই আন্দোলনের সাথে তারা আছে; না নাই। ছাত্রলীগের বন্ধুদের বলছি, পেশাগত দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে দেখেছি শুধু মাত্র হাতুড়ি হাতে নিয়ে ছাত্রলীগ করলেই যে তারা চাকুরি পাবেন না। এসব কোনো কিছুই কাজ করবে না, টাকা না দিলে চাকরি পাবেন না। যাদের আজ আপানারা হাতুড়িপেটা করছেন, মনে করছেন যে হাতুড়ি পেটা করে চাকরি পাবেন, এটা ভুল করছেন। আমি আইনজীবী হিসেবে আইনের কথা বলতে চাই, যে সকল ঘটনা ঘটছে সবগুলোই ফৌজদারী অপরাধ। কাজেই ছাত্রলীগ বা আইনের লোকেরা যদি মনে করেন অপরাধ করে পার পেয়ে যাবেন, সেটা ভুল। এই ধারণাটাই আসলে ভুল।’
এই প্রতিবাদ সমাবেশ থেকে বেশ কিছু দাবি জানানো হয়েছে। দাবিগুলো হলো- ১. অবিলম্বে আমাদের সন্তানদের উপর সরকার ও রাষ্ট্রের প্রশ্রয়ে, নির্দেশে বা অনুমোদনে যে হামলা ও নির্যাতন পরিচালিত হচ্ছে, তা যে মহল থেকেই করা হোক; তার বিচার বিভাগীয় তদন্ত করে দোষীদের শাস্তি দেওয়া হোক।
২. যাদের নামে মিথ্যে মামলা দেওয়া হয়েছে ও গ্রেফতার করা হয়েছে সেসব মামলা প্রত্যাহার করে তাদের মুক্তি দেওয়া হোক এবং যাদেরকে তুলে নেওয়া হয়েছে ও যারা নিখোঁজ রয়েছে তাদের অবিলম্বে তাদের অভিভাবকদের কাছে ফেরত দেওয়া হোক।
৩. আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীদের পরিবার ও অভিভাবকের ওপর যারা হামলা করেছে, হুমকি দিয়েছে এবং হয়রানি করেছে সেগুলোর তদন্ত করে দোষীদের শাস্তি দেওয়া হোক।
৪. আহতদের রাষ্ট্রীয় দায়িত্বে চিকিৎসার ব্যবস্থা করা হোক।
৫. হল-হোস্টেল-ক্যাম্পাসে যে দলীয় সন্ত্রাস ও ভীতির রাজত্ব প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে তার চিরতরে অবসান ঘটানো হোক।
৬. আন্দোলনকারীদের দাবি এবং প্রধানমন্ত্রীর অঙ্গীকার অনুযায়ী কোটা ব্যবস্থার ন্যায্য সংস্কার করে দ্রুততম সময়ের মধ্যে প্রজ্ঞাপন জারি করা হোক।
৭. আমাদের সন্তানের শিক্ষাজীবন ও নিরাপত্তার কাজে নিয়োজিত ভিসি, প্রোভিসি, প্রক্টরসহ অন্যরা, যাদের বেতন, গাড়ি-বাড়ির সুবিধা আমরা আমাদের ট্যাক্সের টাকায় দিয়ে থাকি, তাদের দায়িত্বে অবহেলার বিচার বিভাগীয় তদন্ত করা হোক এবং দোষীদের শাস্তি দেওয়া হোক। আমাদের সন্তানদের স্বাভাবিক শিক্ষাজীবন ফিরিয়ে দেওয়া হোক।
সরকারি চাকরিতে কোটা সংস্কারের দাবিতে চলমান আন্দোলনের সময় চলতি বছরের ৯ এপ্রিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের বাসভবনে হামলা চালানো হয়েছিল। ঘরের জিনিসপত্র ভাঙচুরসহ অগ্নিসংযোগ করা হয়েছিল। ওই ঘটনায় শাহবাগ থানায় মামলা করা হয়েছিল। আর সেই মামলাতেই মঙ্গলবার ফারুকসহ তিনজনকে গ্রেফতার দেখিয়ে আদালতে পাঠায় পুলিশ। এরপর ঢাকা মহানগর হাকিম আদালতের বিচারক সুব্রত ঘোষ শুভ শুনানি শেষে তাদের কারাগারে পাঠানোর আদেশ দিয়েছেন।