আসন্ন ঈদুল আজহা উপলক্ষে রাজধানীর বিভিন্ন স্থানে শুরু হচ্ছে কোরবানির পশুর হাট। ইতোমধ্যে রাজধানীর সবচেয়ে বড় পশুর হাট গাবতলীর সব প্রস্তুতি প্রায় শেষ পর্যায়ে। যদিও কিছু কিছু জায়গায় মাটি ভরাট, বাঁশের মাচা বানানো, সামিয়ানা ও ত্রিপল বিছানোর কাজ চলছে। কিন্তু হাটের অধিকাংশ কাজ প্রায় শেষ। হাট আনুষ্ঠানিকভাবে শুরু না হলেও নিয়মিতভাবে হাটে আসা গরু-ছাগল কোরবানির উদ্দেশ্যে কেনাবেচাও শুরু হয়েছে এই হাটে।
এদিকে পশুর হাটে যেকোনো ধরনের অপ্রীতিকর ঘটনা ঠেকাতে র্যাব ও পুলিশ হাটের নিরাপত্তাব্যবস্থা বাড়িয়েছে। কোরবানির পশুর খাদ্য, পশুকে সাজানোর জন্য নানা রঙের মালা ও বাহারি রঙের দড়িও চলে এসেছে গাবতলীর এই পশুর হাটে।
১৪ আগস্ট, মঙ্গলবার সরেজমিন গাবতলীর পশুর হাট ঘুরে এসব দৃশ দেখা গেছে।
গাবতলীর বাস টার্মিনাল পার হয়ে সামনে ১০০ গজ যাওয়ার পরেই দূর থেকে চোখে পড়ে একটি সুসজ্জিত গেট। কোরবানির হাটে প্রবেশের জন্য এটিও মূল গেট। তাই গেটটি সাজানো হয়েছে কয়েক রঙের কাপড় দিয়ে। করা হয়েছে মনোমুগ্ধকর নকশা। যদিও গেটের চারদিকে নানা রকমের ঝাড়বাতি জ্বালানোর জন্য এখনো কাজ করা হচ্ছে।
গেটের ওপরের দিকে ছোট করে লেখা ঈদ মোবারক। আর তার নিচেই বড় করে লেখা ‘এই সেই ঐতিহ্যবাহী গাবতলীর গবাদী পশুর হাট’।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, গেটটি বানাতে খরচ হয়েছে লাখ টাকার ওপরে। আর গেটটি ঈদের দিন ভোরবেলা পর্যন্ত অক্ষত থাকবে। বিশাল এই গেটের খরচ বহন করছে মিনিস্টার ফ্রিজ নামের প্রতিষ্ঠান। আর এতে সহায়তা করেছে মেসার্স এন এইচ ব্রিকস নামের অপর একটি প্রতিষ্ঠান।
প্রতি বছরই গাবতলীর এই হাটে দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে কোরবানির হাজার হাজার পশু আসে। সে কারণে প্রতি বছরই হাটের ইজারাদাররা পুরো এলাকায় মাটি উঁচু করে, ওপরে বাঁশের মাচা ও ট্রিপল বিছিয়ে বিশেষভাবে পশু রাখার জন্য শেড তৈরি করেন।
এবারও তেমনি কয়েকশ শেড বানানো হচ্ছে। ইতোমধ্যে বেশি ভাগ শেডের কাজ শেষ হয়েছে। পশু রাখার এই শেডগুলোতে হাজার হাজার পশু রাখার ব্যবস্থা আছে বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা।
হাটের এলাকার নিচু জায়গাগুলোতে বাইরে থেকে মাটি এনে ভরাট করে উঁচু করার কাজ করছেন কয়েকশ শ্রমিক। তারা কোদাল হাতে নিয়ে ও কাঁধে ঝুড়ি নিয়ে মাটি টানার কাজ করছেন। কেউ কেউ আবার দা দিয়ে বাঁশ টুকরো টুকরো করে কেটে ছাউনি বানাতে ব্যস্ত।
গাবতলীর এই হাটে কোটি কোটি টাকার পশু কেনাবেচা হয়। তাই এখানে প্রতি বছরই অতিরিক্ত নিরাপত্তাব্যবস্থা চালু করে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। এবারও হাটের পাশে র্যাব ও পুলিশ পুরো হাট পর্যবেক্ষণের জন্য বিশেষভাবে ওয়াচ টাওয়ার বসিয়েছে। আর গেটের পাশে তাদের আলাদা করে অস্থায়ী ক্যাম্প স্থাপনেরও কাজ চলছে।
এ ছাড়াও হাট আনুষ্ঠানিকভাবে শুরুর আগে থেকেই র্যাব ও পুলিশের বিশেষ টিম হাটের নজরদারি এবং টহল বাড়িয়েছে। হাটের গেটের প্রবেশমুখে র্যাব-৪-এর একটি টহল টিম ও দারুস সালাম থানার একটি টহল টিমকে দায়িত্ব পালন করতে দেখা গেছে।
হাট শুরুর আগেই গাবতলীর পশুর হাটে মৌসুমি ব্যবসায়ীরা পশুর বাড়তি খাদ্য নিয়ে হাজির হয়েছেন। অনেকে আগের বরাদ্দ করা দোকানে অনেকে আবার ফুটপাতের ওপরে রাস্তাতেই বসে পড়েছেন তা বিক্রি করতে।
একইসঙ্গে কোরবানির পশুকে হাট থেকে মালা পরিয়ে, রঙিন দড়ি দিয়ে বেঁধে নিয়ে যাওয়ার জন্য প্রয়োজনীয় জিনিসপত্রও এসেছে হাজির হয়েছে হাটে। শুধু মৌসুমি ব্যবসায়ীই নন, ওই হাটের আশপাশের চায়ের দোকানিরাও তাদের দোকানে গরু -ছাগলের রঙিন মালা ও রঙিন দড়ি ঝুলিয়ে বিক্রি করছেন।
গাবতলীর এই পশুর হাটটি একটি নিয়মিত পশুর হাট। তাই সারা বছরই এখানে পশু কেনাবেচা হয়। তবে আজ হাটে গিয়ে দেখা গেছে, কোরবানির জন্য অনেকে গরু-ছাগল কিনতে হাজির হয়েছেন হাটে।
কেউ এসেছেন পশুর দরদাম দেখতে, কেউ আবার পছন্দের পশু মিলে যাওয়ায় কিনে নিয়ে যাচ্ছেন বাড়িতে। হাটে আগে থেকেই অনেক ব্যবসায়ীও কোরবানির পশু নিয়ে হাজির হয়েছেন।
হাটে পশু কিনতে আসা আবুল হাসান নামের এক ব্যক্তি প্রিয়.কমকে বলেন, ‘এসেছিলাম গরুর দরদাম যাচাই করতে। কিন্তু হাটে এসে একটা গরু পছন্দ হয়ে গেল, আর দামের দিকে থেকেও বাজেটের মধ্যেই, তাই গরুটি কিনে ফেললাম। যদিও এত আগে কেনার ফলে কয়েক দিন গরুটা পালতে হবে। তবে সেটা আমার সন্তানরা বেশ আনন্দের সঙ্গেই করবে।’
হালিম নামের ওই হাটের এক ছাগল বিক্রেতা জানান, ১০টি ছাগল নিয়ে এসেছিলেন দুই দিন আগে। তার মধ্যে আর মাত্র তিনটা আছে। আর বাকিগুলো বিক্রি হয়ে গেছে। এই তিনটি ছাগল বিক্রি হয়ে গেলে আবারও তিনি কুষ্টিয়া থেকে ঈদের হাটের ছাগল আনবেন বলে জানান।
মানিক মিয়া নামের এক গরু বিক্রেতা জানান, তিনি ৪টি গরু নিয়ে আজ সকালেই হাটে এসেছেন। দুপুরে তার একটা গরু বিক্রিও হয়েছে। তাই বাকি তিনটা গরু দুই-তিন দিনের মধ্যে যদি বিক্রি হয়ে যায় তাহলে আবারও গ্রামের হাট থেকে গরু নিয়ে আসতে পারবেন বলে জানান তিনি।
গরুর পাশেই খাওয়া-ঘুম
এই হাটে দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে ব্যবসায়ীরা গরু নিয়ে হাজির হন। আর গরু ব্যবসার সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিরা কখনো এককভাবে পার্টনার ছাড়া এই ব্যবসা করতে পারেন না। তাই কয়েকজন মিলে একসঙ্গে পাঁচ থেকে ২০টি পর্যন্ত গরু নিয়ে আসেন হাটে।
গ্রাম থেকে ঢাকায় আসা এসব ব্যবসায়ীদের নিজেদের থাকা-খাওয়ার ব্যবস্থা তাদের নিজেদেরই করতে হয়। সে কারণে তারা হাঁড়ি-পাতিল সঙ্গে করেই নিয়ে আসেন হাটে। গরু রাখার শেডের পাশেই তারা রান্নাবান্নার কাজ করেন। খাওয়া-দাওয়া যেমন গরুর পাশে হয়ে যায়, তেমনি আবার গরুর নিরাপত্তা চিন্তা করে দিনে-রাতে পাশের মাচায় ঘুমিয়ে থাকেন গরু ব্যসায়ীরা।
ঝুঁকির চিন্তায় এখনো জমেনি পশুর হাট
গত বছর গরু ব্যসবায়ীরা শেষ সময়ে বেশ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিলেন বলে অভিযোগ উঠেছিল। কারণ ঈদের আগের দিন থেকে হঠাৎ করে গরুর দাম কমে যায়। সে সময় বিপাকে পড়ে অনেক টাকা লোকসান হয়েছিল কিছু গরু ব্যবসায়ীর। সে কারণে এ বছর এত তাড়াতাড়ি হাটে পশু আসেনি বলে জানিয়েছেন বাছের উদ্দিন নামের ওই হাটের এক দেখাভালকারী।
বাছের উদ্দিন বলেন, ‘গত বছর এই সময়ে অনেক গরু আইছিল হাটে। কিন্তু এইবার দেখেন কয়টা গরু আছে। মানুষ ভয়ে এখনো গরু আনছে না। কারণ গত বছর যে অবস্থা হইছিল, মেলা ব্যবসায়ী কানতে কানতে গেছে এই হাটে।’
চলছে নিয়মিত হাসিল আদায়
গাবতলীর পশুর হাটে এখন যেসব পশু কেনাবেচা হচ্ছে সেগুলো নিয়মিত হাসিলের মাধ্যমেই হচ্ছে। কোরবানি উপলক্ষে আলাদা করে বাড়তি কোনো টাকা নেওয়া হচ্ছে না।
হাটের হাসিল ঘরে জীবন নামের এক ব্যক্তি জানান, তাদের এই হাটটি এক বছরের জন্য ইজারা নেওয়া হয়েছে। তাই এখনো যে পশুগুলো কেনাবেচা হচ্ছে, সেগুলো থেকে নিয়মিত হাসিলই আদায় করা হচ্ছে।
হাসিল ঘরের তথ্য থেকে জানা যায়, আনুপাতিক হারে গরুর হাসিল ১০০ টাকা, মহিষের ১৫০ টাকা এবং ছাগল ও ভেড়ার হাসিল ৩৫ টাকা।