আফগানিস্তানের সঙ্গে উত্তেজনা বিরাজ করছে পাকিস্তানের। যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সম্পর্কের উত্থান-পতন। ভারতের সঙ্গে দীর্ঘদিনের সম্পর্কে নাজুক অবস্থা। এসব দিক থেকে পাকিস্তান বর্তমানে একরকম নিঃসঙ্গ অবস্থায়। তাই পর্যবক্ষেকরা বলছেন, পাকিস্তানের নতুন প্রধানমন্ত্রী ইমরান খানের অপরিহার্য কাজ হওয়া উচিত পাকিস্তানকে এমন অবস্থা থেকে ফিরিয়ে আনা। কিন্তু তিনি কি তা পারবেন? এমন প্রশ্ন বিশ্লেষকদের।তবে ইমরান খান গত মাসে নির্বাচনে বিজয়ী হওয়ার পর বক্তব্যে বলেছেন, ঠিক এই মুহূর্তে আমাদের সামনে অত্যন্ত বড় চ্যালেঞ্জ হলো পররাষ্ট্র নীতি। যদি একটি দেশও থাকে, যেখানে এই মুহূর্তে শান্তি ও স্থিতিশীলতা প্রয়োজন তা হলো পাকিস্তান। প্রথমবারের মতো প্রধানমন্ত্রী হওয়া ক্রিকেটের সাবেক এই ‘প্লেবয়’ কি তা খুব সহজেই পারবেন। সম্ভবত না। কারণ, আঞ্চলিক অস্থিতিশীলতার জন্য পাকিস্তানকে ব্যাপকভাবে দায়ী করা হয়। বলা হয়, তারা সন্ত্রাসীদেরকে মদত দিচ্ছে। তবে বাইরের এমন অভিযোগ ইসলামাবাদ বার বার প্রত্যাখ্যান করে আসছে। জানুয়ারিতে সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধে পাকিস্তানকে মিথ্যাবাদী ও প্রতারণার আশ্রয় গ্রহণকারী হিসেবে অভিযুক্ত করেন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডনাল্ড ট্রাম্প। এর পরই সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধে পাকিস্তানকে কয়েক কোটি ডলারের সামরিক সহায়তা স্থগিত করে যুক্তরাষ্ট্র। তখন থেকেই যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্ক আরো শীতল হতে থাকে। এখানে উল্লেখ্য, গত এক দশক ধরে নিজের দেশে সন্ত্রাসের উত্থানের বিরুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বে সন্ত্রাস বিরোধী প্রচারণা বা অভিযানে অংশগ্রহণের জন্য পাকিস্তানকে বার বার দায়ী করে এসেছেন ইমরান খান। এখন তিনি প্রধানমন্ত্রী। এরই মধ্যে যুক্তরাষ্ট্র বিরোধী তার আগের কণ্ঠ অনেকটা নমনীয় হয়ে গেছে। তিনি বলেছেন, সহায়তার বিনিময়ে তিনি যুক্তরাষ্ট্রের যুদ্ধের পরিবর্তে চান সুষম সম্পর্ক। ইমরান খান বিদ্রোহী বা উগ্রপন্থিদের সঙ্গে সমঝোতার পরামর্শ দিয়ে এসেছেন অনেক দিন ধর। এর ফলে তার সমালোচনা হয়েছে। বলা হয়েছে তিনি উগ্রপন্থিদের বিষয়ে নমনীয়। ফলে তাকে কেউ কেউ ‘তালেবান খান’ নামে অভিহিত করেন।
যুক্তরাষ্ট্র থেকে যদি নাও পান, তবে তিনি কাবুল থেকে কিছু সহানুভূতি পেতে পারেন। কারণ, আফগানিস্তানের প্রেসিডেন্ট আশরাফ গনি দীর্ঘ সময় ধরে তালেবানদের সঙ্গে আলোচনা চালিয়ে যাচ্ছেন। গত রোববার নতুন করে তিনি অস্ত্রবিরতির প্রস্তাব দিয়েছেন। ওয়াশিংটনের উইলসন সেন্টারের বিশ্লেষক হুমা ইউসুফ বলেন, আফগানিস্তারে সঙ্গে আস্থা গড়ে তোলার জন্য খুব ভাল অবস্থানে আছেন ইমরান খান। তাকে বিশ্বাসযোগ্য হিসেবে দেখা হয়। ওয়াশিংটনের সঙ্গে বর্তমানে সম্পর্কে যে বরফ জমে আসে সে বিষয়ে হুমা ইউসুফ বলেন যুক্তরাষ্ট্র থেকে চীন অবধি পাকিস্তানের প্রচেষ্টা অব্যাহত থাকবে।
দীর্ঘদিন ধরে বেইজিং হলো ইসলামাবাদের সব সময়ের বন্ধু। এ সম্পর্ক আরো গতি পেয়েছে ২০১৩ সালে, যখন চায়না-পাকিস্তান ইকোনমিক করিডোর (সিপিইসি) উদ্বোধন করা হয়। এটি হলো বহু কোটি ডলারের একটি অবকাঠামো প্রকল্প। বেইজিংয়ের যে ‘বেল্্ট অ্যান্ড রোড’ প্রকল্প আছে এটা তার অংশ। এই পাকিস্তানের সঙ্গে এখন কার কার জোট হচ্ছে তা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। ইমরান খান এসব সম্পর্ককে আরো শক্তিশালী করার প্রত্যয় ঘোষণা করেছেন। তবে সিপিইসি প্রকল্প নিয়ে যে চুক্তি হয়েছে তা অস্বচ্ছ এবং এ নিয়ে একটি সংশয় রয়ে গেছে। তা হলো, চীন এখাতে যে ঋণ দিচ্ছে তা পরিশোধে পাকিস্তানের সক্ষমতা নিয়ে। তাই ইমরান খানের দল পাকিস্তান তেহরিকে ইনসাফ এই চুক্তির বিষয়টি আরো স্বচ্ছ করার প্রত্যয় ঘোষণা করেছে।
কিন্তু তা অনেক কঠিন হতে পারে। কারণ, বেইজিংয়ের সঙ্গে সম্পর্ক নিয়ে যেকোনো সমালোচনাকে পাকিস্তানে নিষিদ্ধ হিসেবে দেখা হয়। চীন-পাকিস্তান সম্পর্ক বিষয়ক বিশেষজ্ঞ অ্যানড্রু স্মল বলেন, সিডিইসি’র সঙ্গে যেকোনো বিব্রতকর সম্পর্কের বিষয় এড়িয়ে যাওয়ার চেষ্টা করবে পাকিস্তানের নতুন সরকার। ঋণের পাওনা পরিশোধের ক্ষেত্রে ভারসাম্য রক্ষা করতে ইমরান খানের নতুন সরকারকে দ্রুত ব্যবস্থা নিতে হবে। বেশির ভাগ বিশ্লেষক একমত পোষণ করেন যে, এক্ষেত্রে বিদেশ থেকে ঋণ নেয়ার প্রয়োজন হবে পাকিস্তানের। এক্ষেত্রে একটি উপায় হতে পারে আন্তর্জাতিক অর্থ তহবিল আইএমএফ। তবে এই তহবিলের প্রধান অর্থ দাতা ওয়াশিংটন। তারা এরই মধ্যে কড়া ভাষা ব্যবহার করেছে। চীনের ঋণ শোধ করার ক্ষেত্রে পাকিস্তান এই তহবিলের অর্থ ব্যবহার করতে পারবে কিনা সে বিষয়ে ওয়াশিংটনের ওই কড়া বার্তা। এক্ষেত্রে তারা আরো কঠোর হতে পারে। পাকিস্তানের অনেকে মনে করেন, এক্ষেত্রে পাকিস্তানকে উদ্ধারে এগিয়ে আসতে পারে চীন নিজে।
ভারত হলো পাকিস্তানের চিরশত্রু। এটাই পাকিস্তানের পররাষ্ট্রনীতির সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ। দুটি দেশই পারমাণবিক অস্ত্রধর। তারা ১৯৪৭ সালে বৃটিশ শাসনের অবসান হওয়ার পর এ পর্যন্ত তিনটি যুদ্ধে লিপ্ত হয়েছে। এর মধ্যে দুটি যুদ্ধ হয়েছে কাশ্মির নিয়ে। এখন নয়া দিল্লির সঙ্গে পাকিস্তানের বেসামরিক সরকার বা নেতৃত্ব যদি সম্পর্ক গাঢ় করার চেষ্টা করে সেক্ষেত্রে বড় ধরনের ঝুঁকি আছে। কারণ, হলো পাকিস্তানের সেনাবাহিনী। তারা সেখানকার পররাষ্ট্র ও প্রতিরক্ষা বিষয়ক নীতিতে প্রাধান্য বিস্তার করে। অনেক বিশ্লেষক মনে করেন সাবেক প্রধানমন্ত্রী নওয়াজ শরীফ ভারতের সঙ্গে সম্পর্ক শক্তিশালী করার চেষ্টা করেছিলেন। আর তার মূল্য তাকে দিয়ে দিয়েছে শক্তিধর সেনারা। নওয়াজ শরীফের এমন উদ্যোগের কড় সমালোচনা করেছিলেন ইমরান খানও। তিনি বলেছিলেন, পাকিস্তানের স্বার্থকে জলাঞ্জলি দিয়ে ভারতকে খুশি করার চেষ্টা করছিলেন নওয়াজ। এখানেই শেষ নয়। ইমরান খান অনেকবারই ভারত বিরোধী বক্তব্য, বিবৃতি দিয়েছেন। ফলে দুই দেশের অনেকেই মনে করেন, ইমরান খানের নেতৃত্বে তাদের সম্পর্ক আরো খারাপ হতে পারে। নির্বাচনে বিজয়ী হওয়ার পর ভাষণে নতুন প্রধানমন্ত্রী ইমরান খান বলেছিলেন, আমাকে ভারতের মিডিয়া এমনভাবে তুলে ধরছে যেন, আমি বলিউডের একজন ভিলেন। তাদের এমন আচরণে আমি কিছুটা কষ্ট পেয়েছি। কিন্তু পরে তার কণ্ঠস্বর নরম হয়েছে। তিনি গত মঙ্গলবার টুইট করে বলেছেন, কাশ্মির সহ সব রকম বিরোধের সমস্যা অবশ্যই ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে আলোচনার মাধ্যমে সমাধান করতে হবে।
শেষ কথা হলো, অনেক বিশ্লেষক মনে করছেন, ইমরান খান যা-ই বলুন না কেন, তার পররাষ্ট্রনীতি নির্ভর করচে সেনাবাহিনীর ওপর। তারা যেটাকে গ্রহণযোগ্য মনে করবে তেমনই হবে সব।
ইমরান খানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী শাহ মেহমুদ কুরেশি এমন ধারণাকে পাত্তাই দেন না। তিনি বলেন, পররাষ্ট্রনীতি নির্ধারণ করা হবে পররাষ্ট্র বিষয়ক অফিস থেকে।
বিশ্লেষক পারভেজ হুডবয় বলেন, আন্তর্জাতিক সম্পর্কের বিষয়ে ইমরান খানের কাছ থেকে আমি বড় কোন কিছু প্রত্যাশা করি না। এ ক্ষেত্রে সিদ্ধান্ত নেয়ার তিনি কেউ না।