মুক্তিযুদ্ধ শেষে টানা চার বছর খালি পায়ে হেঁটেছেন বীরাঙ্গনা রমা চৌধুরী। এরপর সবার অনুরোধে মাঝেমধ্যে জুতা পায়ে দিতেন। কিন্তু গত ১৫ বছর তাঁর পায়ে আর জুতা দেখা যায়নি। হেঁটেছেন খালি পায়ে।
তিন সন্তানকে হারিয়ে রমা চৌধুরীর একটাই কথা ছিল, তাঁর সন্তানরা যে মাটিতে শুয়ে আছে, সে মাটিতে তিনি জুতা পায়ে হাঁটতে পারবেন না।
এক সাক্ষাৎকারে রমা চৌধুরী বলেছিলেন,‘আমার সন্তানরা শহীদের মর্যাদা পায়নি। কিন্তু তারা আমার কাছে শহীদ। কারণ একাত্তর আমাকে দিয়েছে ‘পোড়া ভিটে, কাঁধের ঝোলা, ছেলের শোক আর খালি পা।’
এতগুলো বছর এভাবে হেঁটেই চট্টগ্রাম শহরে রমা চৌধুরী বিক্রি করে গেছেন নিজের লেখা বই। আর তা দিয়েই কাটিয়েছেন জীবন।
রমা চৌধুরী ১৯৪১ সালে চট্টগ্রামের বোয়ালখালী থানার পোপাদিয়া গ্রামে জন্মগ্রহণ করেছিলেন। তিনি ১৯৬১ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাংলা ভাষা ও সাহিত্যে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর ডিগ্রি অর্জন করেন। এরপর ১৯৬২ সালে কক্সবাজার বালিকা উচ্চবিদ্যালয়ে প্রধান শিক্ষিকার দায়িত্ব পালনের মধ্য দিয়ে তিনি পূর্ণাঙ্গ কর্মজীবন শুরু করেন। পরে দীর্ঘ ১৬ বছর তিনি বিভিন্ন উচ্চবিদ্যালয়ে প্রধান শিক্ষিকা হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন।
স্বাধীনতার পর রমা চৌধুরী লেখালেখিকে পেশা হিসেবে নিয়েছিলেন। প্রথমে তিনি একটি পাক্ষিক পত্রিকায় লিখতেন। বিনিময়ে সম্মানীর বদলে পত্রিকার ৫০টি কপি পেতেন। সেই পত্রিকা বিক্রি করেই চলত তাঁর জীবন-জীবিকা। পরে নিজের লেখা বই প্রকাশ করে বই ফেরি করতে শুরু করেন। প্রবন্ধ, উপন্যাস ও কবিতা মিলিয়ে তিনি নিজের ১৮টি গ্রন্থ প্রকাশ করেছেন।
মুক্তিযুদ্ধের সময়টাতে রমা চৌধুরীর স্বামী তখন ভারতে। তিন ছেলেকে নিয়ে মায়ের সঙ্গে থাকতেন তিনি। ১৯৭১ সালের ১৩ মে সকালে পাকিস্তানি হানাদাররা চড়াও হয় রমা চৌধুরীর ঘরে।
ছেলেদের বাঁচাতে নিজের মাকে বলেন তাদের নিয়ে পালিয়ে যেতে।
সেদিন পাকিস্তানিদের হাতে নির্যাতিত হয়েছিলেন রমা। এরপর পাশের পুকুরে নেমে জীবন বাঁচিয়েছিলেন তিনি। নিজের চোখে দেখেছিলেন গানপাউডার দিয়ে বাড়িঘর পুড়িয়ে দিচ্ছে হানাদাররা।
একে একে তিন ছেলে হারালেন
বিজয়ের মাত্র চারদিন পর ২০ ডিসেম্বর শ্বাসকষ্টে মারা যায় রমা চৌধুরীর ছেলে সাগর। ১৯৭২ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি মারা যায় তাঁর আরেক ছেলে। এর পরই পায়ে জুতা পরা বন্ধ করেন রমা। পায়ে এক পর্যায়ে ঘা হয়ে গিয়েছিল। এ জন্য শুনেছেন অনেক অপবাদও।কিন্তু অনেক অনুরোধের পর মাঝেমধ্যে জুতা পরতেন। কিন্তু ১৯৯৮ সালের ১৬ ডিসেম্বর যখন আরেক ছেলে সড়ক দুর্ঘটনায় মারা যান, আবার শুরু করেন খালি পায়ে হাঁটা। আর পায়ে জুতা পরেননি তিনি।
সাতটি বিড়াল ছানা
রমা চৌধুরীর প্রিয় সাতটি বিড়ালছানা ছিল। বই বিক্রির টাকা দিয়ে নিজে খেতেন। খাওয়াতেন বিড়ালগুলোকেও। রমা চৌধুরী বলতেন,‘ওরাই আমার সন্তান। ওদের মাঝে খুঁজি আমি হারানো ছেলেদের। জানেন তো,মানুষ বেঈমান হয়। ছলনা করে। কিন্তু বিড়ালরা প্রতারণা করে না। ওরা ভালোবাসার প্রতিদানে ভালোবাসাই দেয়।’
উচ্চ রক্তচাপসহ নানারোগে আক্রান্ত হয়ে গত ১৫ জানুয়ারি থেকে হাসপাতালে চিকিৎসাধীন ছিলেন রমা চৌধুরী। পরে আজ সোমবার এই বীরাঙ্গনার জীবনাবসান হয়। মৃত্যুকালে তাঁর বয়স হয়েছিল ৭৭ বছর।পরে সকাল ১০ টায় চট্টগ্রামে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে তাঁর মরদেহ রাখা হয়। সেখানে তাঁর প্রতি সম্মান জানান বিভিন্ন শ্রেণি পেশার মানুষ। পরে বোয়ালখালী পোপাদিয়া গ্রামে তাঁকে সমাহিত করা হয়।