ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিএনপিপন্থি শিক্ষকদের ফোরাম সাদা দলের নেতৃত্ব নিয়ে তৈরি হয়েছে জটিলতা। সাদা দলের বেশিরভাগ সদস্য শিক্ষক এবার সবমহলে গ্রহণযোগ্য সিনিয়র কোন শিক্ষককে ফোরামের আহ্বায়ক পদে দেখতে চাইছেন। কিন্তু বিএনপির শীর্ষ নেতৃত্বের নাম ভাঙিয়ে আহ্বায়ক পদ দখল করতে চাইছেন দলটির শিক্ষাবিষয়ক সম্পাদক প্রফেসর ড. এবিএম ওবাযয়দুল ইসলাম। এ উদ্দেশ্যে তিনি প্রতিনিয়ত দলীয় পদের অপব্যবহার করছেন। ফলে সারা দেশে ঐক্যের বদলে বিশ্ববিদ্যালযয় শিক্ষকদের পেশাজীবী রাজনীতিতে বিভক্তি তৈরি হচ্ছে নতুন করে। এমন পরিস্থিতিতে নতুন আহ্বায়ক কমিটি গঠনে আজ বিকালে একটি বৈঠক ডেকেছে সাদা দল। আজকের বৈঠকেই একতরফাভাবে নতুন কমিটি গঠনের নানামুখী তৎপরতা চালাচ্ছেন প্রফেসর ওবায়দুল ইসলাম ও তার অনুসারিরা। অন্যদিকে একতরফা কমিটি গঠনের উদ্যোগ নেয়া হলে বৈঠকে নোট অব ডিসেন্ট দেয়ার নীতিগত সিদ্ধান্ত নিয়েছেন সাদা দলের সিনিয়র শিক্ষকদের একটি বড অংশ।সাদা দলের বেশ কয়েকজন শিক্ষক এমন তথ্য জানিয়েছেন। তারা বলেছেন, একজন সিনিয়র শিক্ষককে আহ্বাযয়ক করে সমন্বয়ের মাধ্যমে আহ্বায়ক কমিটি গঠন করতে না পারলে নেতিবাচক পরিস্থিতির সৃষ্টি হবে।
অতীতে কিছু শিক্ষক ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের ফোরাম সাদা দলের নেতৃত্বে দিয়েছেন এক দশকের বেশি সমযয়। পরে সংশোধনীসহ পরিবর্তন আনা হযয় ফোরামের গঠনতন্ত্রে। সেখানে পরিস্কার বলা হযয়, আহ্বাযয়ক কমিটির মেয়াদ হবে এক বছরের। কিন্তু নানা জটিলতার কারণে বর্তমান কমিটি এক বছরের সে মেয়াদ অতিক্রম করে। প্রফেসর ড. মোহাম্মদ আকতার হোসেন খানের নেতৃত্বাধীন বর্তমান কমিটি অতিরিক্ত দায়িত্ব পালন করে প্রায় ৬ মাস। প্রফেসর আকতার হোসেন এক বছর পর দায়িত্ব ছেড়ে দেয়ার কথা থাকলেও সেটা করেননি। কিন্তু এ সময়ে সংঘটিত বিশ্ববিদ্যালয়ে জাতীয় বেতন স্কেল, অবৈধ নিয়োগ বা অনিয়ম, বিএনপি চেযয়ারপারসন খালেদা জিয়াকে সাজা দিয়ে কারাগারে পাঠানো এবং অসুস্থতাকে কেন্দ্র করে কোন কর্মসুচি দিতে পারেনি সাদা দল। কোটা আন্দোলনেও দাঁড়াতে পারেনি শিক্ষার্থীদের পাশে। খালেদা জিয়ার সুচিকিৎসার দাবিতে একটি মানববন্ধন কর্মসূচি পালনের সিদ্ধান্ত নিলেও নানা কারণ দেখিয়ে সেটা পালন করা হয়নি। এছাডয়া সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে প্রফেসর আকতার হোসেন খানের কিছু কমেন্টও আপত্তিকর বলে মনে করেন শিক্ষকরা। সম্প্রতি শিক্ষকরা গঠনতন্ত্র মেনে নতুন কমিটি গঠনের চাপ দিলে পরিস্থিতি ঘুঁরে যায়। শুরু হয় বিএনপির শিক্ষাসম্পাদক প্রফেসর ড. ওবায়দুল ইসলাম, সহ প্রশিক্ষণ সম্পাদক প্রফেসর ড. মোরশেদ হাসান খান ও তাদের অনুসারিদের অপতৎপরতা।
সাদা দলের একজন শিক্ষক বলেন, প্রফেসর ড. ওবাযয়দুল ইসলাম ও প্রফেসর ড. মোরশেদ হাসান খান দুইজন বিএনপির কেন্দ্রীয় কমিটির গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বে রযয়েছেন। তারপরও দলের ভারপ্রাপ্ত চেযয়ারম্যান তারেক রহমানের দোহাই দিয়ে এবং মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরকে বিভ্রান্ত করে সভাপতি পদ বাগিয়েছেন বাংলাদেশ বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমন্বয় পরিষদের। অনেক সিনিয়রকে ডিঙিয়ে এ পদে তার অধিষ্ঠান মানসিকভাবে কষ্ট দিয়েছে সিনিয়র শিক্ষকদের। এখন তিনি বিএনপির দলীয় পদকে পুঁজি করে দলের শীর্ষ নেতাদের নাম ভাঙিয়ে সাদা দলের আহ্বায়ক পদটিও দখল করতে চান তিনি। কাউন্সিলে বিএনপি এক নেতা এক পদের যে নীতিটি গ্রহণ করেছিল তার সম্পূর্ণ বিপরীত অবস্থানে রয়েছেন প্রফেসর ওবায়দুল ইসলাম। সাদা দলের আহ্বায়ক পদটি হাসিলের জন্য বিশ্ববিদ্যালয়ের তরুণ শিক্ষকদের কাছে তিনি নিজেকে এমনভাবে উপস্থাপন করেন যেন, শিক্ষক রাজনীতি নিয়ন্ত্রণের দায়িত্বও দলের শীর্ষ নেতৃত্ব তার ওপর অর্পণ করেছেন।
উচ্চাবিলাসী প্রফেসর ওবায়দুল ইসলাম সাদা দলের আহ্বায়ক হতে কিভাবে নিজের দিকে সমর্থন বৃদ্ধি করেছেন তা তুলে ধরেন অন্য একজন প্রফেসর। তিনি জানান, আহ্বায়ক কমিটি গঠনে প্রতিটি ফ্যাকাল্টির ইউনিট কমিটি থেকে নাম প্রস্তাব করতে হয়। বর্তমান আহ্বায়ক কমিটির বড় অংশসহ সাদা দলের সদস্য শিক্ষকরা একজন সিনিয়রকে আহ্বায়ক করে সমন্বয়ের মাধ্যমে কমিটি গঠনের নীতিগত সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন। সমর্থন প্রতিকূলে দেখে নতুন এক কৌশল করেন প্রফেসর ওবায়দুল ইসলাম। তিনি লবিং তদবির করে কিছু ইউনিট কমিটি থেকে নিজেসহ বিএনপির সহ প্রশিক্ষক সম্পাদক মোরশেদ হাসান খানের নাম প্রস্তাব করিয়ে নেন। আহ্বায়ক কমিটির সর্বশেষ বৈঠকে বসে বর্তমান আহ্বায়ক প্রফেসর ড. আকতার হোসেন ও প্রফেসর ড. ওবায়দুল ইসলাম বলেন, কার কার নাম প্রস্তাব এসেছে টালি করেন। যার নাম বেশি এসেছে তাকে আহবায়ক হিসেবে ঘোষণা দেয়া হোক। তাদের এমন মন্তব্যের প্রতিবাদ জানিয়ে অন্যরা বলেন, আমরা কি ইউনিটে প্যানেল পাঠিয়েছিলাম যে নামের টালি করে আহ্বায়ক করতে হবে? এ নিয়ে বৈঠকে হট্টগোল হয়। কমিটির সিনিয়র শিক্ষকরা লিখিতভাবে বিরোধীতা করেন। এদিকে আহ্বায়ক হিসেবে নাম প্রস্তাবের ক্ষেত্রেও অনিয়মের অভিযোগ উঠেছে। সাদা দলের শিক্ষকরা জানান, ফ্যাকাল্টির আহ্বায়কদের মধ্য থেকে একজন মূল কমিটির সদস্য সচিব হন। এতদিন এই পদে ছিলেন প্রফেসর লুৎফর রহমান। একদিকে তার মেয়াদ শেষ হযয়েছে, অন্যদিকে তিনি ফ্যাকাল্টি পরিবর্তন করেছেন।ফলে গঠনতন্ত্র অনুযায়ী তিনি এখন মূল কমিটির সদস্য সচিব বা ফ্যাকাল্টির আহ্বায়কের দায়িত্ব পালন করতে পারেন না। কিন্তু ওবায়দুল ইসলামকে সমর্থন করতে গিযয়ে তিনি বৈঠকে অংশ নেন উপরোক্ত সদস্য সচিব পরিচয়ে। সায়েন্স ফ্যাকাল্টি থেকে ওবায়দুল ইসলামের নাম প্রস্তাব করা হলেও সেখানে অনিয়ম পাওযয়া গেছে। কারন ইউনিট কমিটি থেকে নাম প্রস্তাবের সিদ্ধান্ত নিতে বৈঠকের সাত সদস্যের উপস্থিতি থাকতে হয়। কিন্তু কিছু ইউনিটের বৈঠকে সে পরিমাণ শিক্ষকও উপস্থিত ছিলেন না। অন্যদিকে ব্যবসা প্রশাসন ইউনিটের বৈঠকে ৪৩জন উপস্থিত হলেও সমর্থন হারানোর ভযয়ে সে বৈঠকই করা হয়নি।
সাদা দলের শিক্ষকরা জানান, নানামুখী বিষয়কে বিবেচনায় নিযয়ে একবার একজন সিনিয়র এবং নারী শিক্ষককে আহ্বায়ক করতে বর্তমান আহ্বায়ক কমিটির বেশিরভাগ সদস্য নীতিগতভাবে একমত হয়েছিলেন। সে হিসেবে সাবেক প্রভোস্ট, সাবেক সিনেট ও সিন্ডিকেট মেম্বার এবং শিক্ষক সমিতির একাধিকবারের নির্বাচিত প্রতিনিধি প্রফেসর ড. লায়লা নূর ইসলামের নামটি অনেকেই প্রস্তাব করেছিলেন। তাদের যুক্তি ছিল, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালযয়ে বেশিরভাগ শিক্ষকই নারী। সে হিসেবে একজন নারীকে আহ্বায়ক করা হলে আগামী দিনের আন্দোলন সংগ্রামে নারী শিক্ষকদের সমর্থন পাওয়া যাবে। ব্যক্তিগতভাবে প্রফেসর লায়লা নূরের ইমেজ ভালো এবং তিনি সব মতের শিক্ষকদের কাছে গ্রহণযোগ্য একজন। নারী নেতৃত্বের বিকাশে বিদেশীরা যে তাগিদ দেন তা বাস্তবায়নের একটি উপলক্ষও তৈরি হবে। তার চাকরির মেয়াদও রয়েছে আর মাত্র তিন বছর। সিনিয়র শিক্ষকরাও চাইছেন একজন জেষ্ঠ্য কেউ আসুক এ পদে। সর্বোপরি ৬২ বছর বয়সি এ শিক্ষিকার চেয়ে ১৫ বছরের জুনিয়র প্রফেসর ওবায়দুল ইসলাম। এ ব্যাপারে আলোচনা করতে গিয়ে একজন জুনিয়র শিক্ষকের দুর্ব্যবহারের শিকার হয়ে বৈঠক থেকে চলে যান একজন সিনিয়র শিক্ষক।
সাদা দলের শিক্ষকরা বলেন, বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান যেখানে সারাদেশের মানুষের মধ্যে দল-মত নির্বিশেষে ঐক্যের কথা বলছেন- সেখানে কিছু জুনিয়র শিক্ষককে নিযয়ে প্রফেসর ওবায়দুল ইসলাম সারা দেশের শিক্ষকদের মধ্যে অনৈক্য সৃষ্টি করছেন। এখন আহ্বায়ক কমিটির সভায় যদি একতরফাভাবে নতুন আহ্বায়ক কমিটি পাস করানোর চেষ্টা হলে বর্তমান কমিটির সিনিয়র শিক্ষকরা নোট অব ডিসেন্ট দেবেন। বিএনপির পদধারীরা পেশার রাজনীতিতেও পদ দখল করলে সাধারণ শিক্ষকরা, বিশেষ করে ইতিবাচক ইমেজের শিক্ষকরা রাজনীতিতে আসতে চাইবে না। কিছু জুনিয়রের দৌরাত্মে ইতিমধ্যে সিনিয়র শিক্ষকরা রাজনীতিতে ভীতশ্রদ্ধ হয়ে পড়েছেন। এখন জোর করে একতরফা কমিটি গঠন হলে পেশার রাজনীতিতে বটেই, বিএনপির রাজনীতিও ক্ষতিগ্রস্ত হবে।