ম্যাচের প্রথমভাগে সাহসী তামিম আর যোদ্ধা মুশফিক দেখালেন স্মরণীয় লড়াই। শেষে টাইগার বোলারদের বিধ্বংসী রূপ দেখলো শ্রীলঙ্কা। দাপুটে জয়ে এবারের এশিয়া কাপ মিশন শুরু করলো মাশরাফি বাহিনী। গতকাল দুবাইয়ে শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে ১৩৭ রানে জয় কুড়ায় বাংলাদেশ। দুবাই ইন্টারন্যাশনাল স্টেডিয়ামে আগে ব্যাটিংয়ে ২৬১ রানে থামে বাংলাদেশের ইনিংস। জবাবে মাত্র ১২৪ রানে গুঁড়িয়ে যায় শ্রীলঙ্কা। শ্রীলঙ্কার ইনিংসের আয়ু ছিল মাত্রই ৩৫.২ ওভার। দুবাইয়ে বল হাতে টাইগাররা দেখান সুশৃঙ্খল নৈপুণ্য।ম্যাচে উইকেট সাফল্য দেখেন ছয় বোলারের প্রত্যেকেই। আর ৩৫.২ ওভারে বাংলাদেশের বোলাররা অতিরিক্ত খাতে দেন মাত্র ১ রান। তাও ছিল লেগ বাই থেকে। শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে বলেই হয়তো খেলার আগে ভিন্ন মাত্রা পেয়েছিল ম্যাচটি। তবে আরো একবার সাবেক শিষ্যদের বিপক্ষে মলিন মুখে খেলা শেষ করলেন লঙ্কান কোচ চন্ডিকা হাথুরুসিংহে।
২৬২ রানের টার্গেটে ব্যাট হাতে শুরুতে শ্রীলঙ্কার পরিকল্পনা ছিল ভিন্ন। শুরু থেকেই বড় শট খেলে ম্যাচের নিয়ন্ত্রণ নিতে চাইছিল লঙ্কানরা। শুরুর ১.৫ ওভারে শ্রীলঙ্কার স্কোর বোর্ডে জমা পড়ে ২২ রান। তবে পরের মাত্র ১৬ রানে চার উইকেট তুলে নিয়ে লঙ্কানদের ব্যাকফুটে ঠেলে দেয় মাশরাফি বাহিনী। লঙ্কানদের পতনের শুরুটা মোস্তাফিজুর রহমানের ভেলকিতে। নিজের প্রথম ওভারের শেষ বলে লঙ্কান ওপেনার কুসাল মেন্ডিসকে এলবিডব্লিউর ফাঁদে ফেলেন বাঁ-হাতি পেসার মোস্তাফিজ। মাঠের আম্পায়ার এরাসমাস আঙুল না তুললেও সফল রিভিউ শেষে গ্যালারি ঠাসা সমর্থকদের উল্লাসে মাতায় টাইগাররা। ওপেনার উপুল থারাঙ্গা (২৭) ও ধনাঞ্জয়া ডি সিলভাকে সাজঘরে ফেরান অধিনায়ক মাশরাফি। আর দলীয় ৩৮ রানে লঙ্কান মারকুটে ব্যাটসম্যান কুসাল পেরেরাকে এলবিডব্লিউর ফাঁদে ফেলেন টাইগার অফস্পিনার মেহেদী হাসান মিরাজ। সেখান থেকে লঙ্কানদের ঘুরে দাঁড়ানোর চেষ্টা ভেস্তে যায় টাইগারদের এক ধারালো ফিল্ডিংয়ে। দলীয় ৬০ রানে সাকিব ও মিরাজের ক্ষুরধার ফিল্ডিংয়ে রানআউটে কাটা পড়ে দাসুন শানাকার উইকেট।
এতে মাত্র ৬ রানের ব্যবধানে আরো তিন উইকেট তুলে নিয়ে লঙ্কানদের ম্যাচ থেকে ছিটকে দেয় টাইগাররা। বল হাতে নিজের প্রথম বলেই শ্রীলঙ্কার অধিনায়ক অ্যাঞ্জেলো ম্যাথিউসকে এলবিডব্লিউর ফাঁদে ফেলেন পেস তারকা রুবেল হোসেন। এতে ১৭.২তম ওভার শেষে ৬৩/৬ সংগ্রহ নিয়ে ক্রিজে ধুকছিল লঙ্কানরা। তখন ক্রিজের এক প্রান্তে থিসারা পেরেরার দিকে তাকিয়ে লঙ্কান শিবির। তবে ব্যক্তিগত ৬ রানে মিরাজের ডেলিভারিতে রুবেলের হাতে ক্যাচ দিয়ে সাজঘরে ফেরেন থিসারা। নিজের প্রথম স্পেলে তিন ওভারে ১৭ রান দেন মোস্তাফিজ। তবে দ্বিতীয় স্পেলের প্রথম ওভারেই ফের সাফল্য দেখেন বাংলাদেশের এই ‘কাটার মাস্টার’। মোস্তাফিজের স্লো লেংথ বলে ‘থ্রো দ্য গেট’ বোল্ডআউট হন সুরাঙ্গা লাকমাল। এতে ২৫.২তম ওভার শেষে শ্রীলঙ্কার সংগ্রহ দাঁড়ায় ৯৮/৮-এ। পরে দিলরুয়ান পেরেরাকে (২৯) সাজঘরে ফেরান অকেশনাল স্পিনার মোসাদ্দেক হোসেন। আর আমিলা আপোনসোর উইকেট তুলে নিয়ে লঙ্কানদের লড়াই সাঙ্গ করেন সাকিব আল হাসান। ওয়ানডেতে এটি বাংলাদেশের ষষ্ঠ সর্বোচ্চ রানের ব্যবধানে জয়। নিজেদের এমন শীর্ষ রেকর্ডে চলতি বছরের জানুয়ারিতে ঢাকায় শ্রীলঙ্কারই বিপক্ষে ৩২০ রানের পুঁজি নিয়ে ১৬৩ রানের জয় দেখে বাংলাদেশ।
ইনিংসের শুরুতে মাত্র ২ রানেই হাতে আঘাত পেয়ে সাজঘরে ফিরেছিলেন তামিম ইকবাল। তার এশিয়া কাপ থেকে ছিটকে পড়ার খবর তখন আন্তর্জাতিক সংবাদ মাধ্যমে। দলীয় ২২৯ রানে নবম উইকেটের পতন। এর মানে তামিম মাঠে না নামতে পারলে শেষ হয়ে যাবে বাংলাদেশের ইনিংস। কিন্তু এক হাতে ব্যান্ডেজ নিয়ে মাঠে নামলেন দেশ সেরা এ ওপেনার। আগের তিন বলে ২ রান করে মাঠে ছেড়েছিলেন। এবার মাঠে নেমে একটি বল খেললেন, তাও এক হাতে। এর আগে দলের ১৩৪ রানে মিঠুন আউট হওয়ার পর প্রায় একাই লড়াই করছিলেন মুশফিকুর রহীম। তুলে নিয়েছিলেন ক্যারিয়ারের ৬ষ্ঠ ও এশিয়া কাপে দ্বিতীয় সেঞ্চুরি। তামিমকে পেয়ে যেন দ্বিগুণ আত্মবিশ্বাসী হয়ে ওঠেন ‘মিস্টার ডিপেন্ডেবল’। গড়ে তোলেন ৩২ রানের জুটি। যেখানে তামিমের অবদান মাত্র ১ রানের। তবে তাতেই দলের স্কোর বোর্ডে জমা হয় ২৬১ রানের লড়াইয়ের পুঁজি। মুশফিকের ব্যাট থেকে আসে ১৫০ বলে ১৪৪ রানের ক্যারিয়ার সেরা ইনিংস। হাঁকান ১১টি চারের সঙ্গে ৪টি ছক্কা। যেখানে তিনটি করে চার ও ছয় হাঁকান তামিমের সঙ্গে জুটিতে। এর আগে এই এশিয়া কাপ আসরেই ২০১৪তে ফতুল্লায় তার ১১৭ রানের ইনিংসটি ছিল এতদিন সর্বোচ্চ। অথচ মুশফিকের খেলা নিয়ে গতকাল দুপুর পর্যন্ত ছিল শঙ্কা।
৭.৬তম ওভারে প্রথম বাউন্ডারি হাঁকান মুশফিকুর রহীম। তখন দলের স্কোর বোর্ডে ৮ ওভার শেষে ২০ রান। এর আগে ছোট একটি ঝড় বয়ে গেছে। সংযুক্ত আরব আমিরাতে এশিয়া কাপ শুরু দুঃস্বপ্ন দিয়ে। প্রথম ওভারে লাথিস মালিঙ্গার শেষ দুই বলে আউট লিটন কুমার দাস ও সহ-অধিনায়ক সাকিব আল হাসান। রানের খাতা না খুলেই ফিরেছেন দু’জন। এরপরের ওভারে লাকমলের শেষ বলে তামিম হাতে আঘাত পান। ব্যথা নিয়ে মাঠ ছাড়তে হয় তাকে। তবে মোহাম্মদ মিঠুনকে নিয়ে তৃতীয় উইকেটে ১৩১ রানের জুটিতে আশা দেখান মুশফিকুর রহীম। কিন্তু ব্যক্তিগত ৬৩ রানে মিঠুন আউট হলে বাকি সময়টা একাই লড়েছেন মুশফিক। ইনিংসের শুরুতে লিটন কুমার দাসের বাজে শটে আউটের পর সাকিবও যেন ছিলেন বেশ হেয়ালি। গোল্ডেন ডাকের লজ্জা নিয়ে তিনিও দলকে বিপদেই ফেলে যান। এরপর তামিম ইনজুরিতে মাঠ ছাড়লে বিপদ আরো বাড়ে। তবে এমনটি হতে পারে সেটিও ছিল অনুমেয়। সাকিব এশিয়া কাপের আগে থেকেই ছিলেন ইনজুরিতে। তাকে অনেকটা বিসিবি সভাপতির অনুরোধেই খেলতে হচ্ছে এশিয়া কাপে। চিকিৎকরাই নয় সাকিব নিজেও বলেছিলেন তিনি মাত্র ২০ থেকে ৩০ ভাগ ফিট আছেন। অন্যদিকে এশিয়া কাপের অনুশীলনের সময় হাতের আঙুলে চোট পাওয়া তামিম ইকবালও ফিট ছিলেন না। গতকাল ম্যাচের আগে দুপুর পর্যন্ত তাকে নিয়ে ছিল অনিশ্চয়তা। মুমিনুলের খেলার কথা শোনা যাচ্ছিল। কিন্তু অদৃশ্য কারণে শেষ পর্যন্ত তামিম মাঠে নামেন আর যা হওয়ার তাই হয়েছে। ঝুঁকি নিয়ে খেলতে গিয়ে ছিটকে গেছেন এশিয়া কাপ থেকেই।
তাদের এমন বিদায়ে দলের হাল ধরেন মুশফিক ও মিঠুন। গড়েন এশিয়া কাপে দলের পঞ্চম সর্বোচ্চ রানের জুটি। কিন্তু বিধিবাম ৩ ম্যাচের ক্যারিয়ারে প্রথম ফিফটি হাঁকানো মিঠুনÑ ৫ চার ও ২ ছয়ে ৬৮ বলে ইনিংস শেষ করেন বাজে এক শট খেলে। মাহমুদুল্লাহ রিয়াদ ও মোসাদ্দেক হোসেন ১ রান করে আউট। এরপর মুশফিক হাল ছাড়েননি তরুণ মেহেদী হাসান মিরাজকে নিয়ে গড়ে তোলেন ৩৩ রানের জুটি। মিরাজ ১৫ রানের অবদান রেখে আউট হলে মুশফিকের সঙ্গী হন অধিনায়ক মাশরাফি বিন মুর্তজা। মাশরাফির ১১ রানে বিদায়ে তাদের ২০ রানের জুটি ভাঙে। এরপর মোস্তাফিজুর রহমানকে নিয়ে ২৬ রানের জুটি গড়েন মুশফিক। এখানে ১১ বলে ১০ রান করেন পেসার মোস্তাফিজ। তবে তার বিদায়ে ২৫০ এর আগে শেষ হয়ে যাচ্ছিল টাইগারদের ইনিংস। সেখান থেকে মুশফিক ও তামিম অনন্য নজির স্থাপন করেন দেশের ক্রিকেট ইতিহাসে। তাদের দারুণ সাহসিকতায় শেষ পর্যন্ত শ্রীলঙ্কাকে প্রথম ওয়ানডেতে ২৬২ রানের লক্ষ্য ছুড়ে দেয়। অথচ দিন শুরু হয়েছিল ৩ রানে দুই উইকেট হারিয়ে।