রাজশাহী মহানগরীর পার্শ্ববর্তী পবা ও মোহনপুর উপজেলা নিয়ে গঠিত রাজশাহী-৩ আসন। এখানে তৎপর দু’দলের হেভিওয়েট প্রার্থীরা। এই আসনে নিজস্ব বলয় তৈরি করে প্রচারণা চালাচ্ছে বিএনপি ও আওয়ামী লীগ। বিএনপির দুর্গখ্যাত রাজশাহী অঞ্চলে আধিপত্য ধরে রাখতে রাজশাহী জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আসাদুজ্জামান আসাদ এই আসন থেকে ভোটের লড়াইয়ে নামতে চান। আওয়ামী লীগে সাংগঠনিক রাজনীতিতে শক্ত দখল রাখা এই নেতা তার পরিচিত ও অনুসারীদের নিয়ে তৎপর ভোটের ময়দানে। ঠিক তেমনি বিএনপি’র মহানগর সাধারণ সম্পাদক অ্যাডভোকেট শফিকুল হক মিলন ধানের শীষ প্রতীকের প্রার্থী হতে মাঠে আছেন। তবে দুদলেই রয়েছে প্রার্থী পরিবর্তনের সুর।
জাতীয় পার্টি ও জামায়াতের প্রার্থীরাও তাদের অবস্থান জানান দিচ্ছেন।
২০১৪ সালের ৫ই জানুয়ারির নির্বাচনে মহাজোট প্রার্থী হিসেবে জাতীয় পার্টির শাহাবুদ্দিন বাচ্চুকে মনোনয়ন দেয়ার প্রাথমিক প্রস্তুতি থাকায় আওয়ামী লীগের হেভিওয়েট প্রার্থীরা মনোনয়ন তোলেননি। কিন্তু নির্বাচনে অংশ নেয়া না নেয়ার দোলাচলে জাতীয় পার্টি ছিটকে পড়ে। আওয়ামী লীগ প্রার্থী হিসেবে মনোনয়ন পান রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক আয়েন উদ্দিন। সে হিসাব মাথায় রেখে আবারো মাঠে নেমেছেন মহানগর জাতীয় পার্টির সভাপতি শাহাবুদ্দিন বাচ্চু।
মহানগর জাতীয় পার্টির সভাপতি শাহাবুদ্দিন বাচ্চু বলেন, লাঙল প্রতীকে নির্বাচন করতে দীর্ঘদিন থেকে এলাকায় কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছি। জাতীয় পার্টির যে ভোট ব্যাংক রয়েছে তাতে একাই ফাইট করার মতো সামর্থ্য আমাদের আছে। সেভাবে প্রস্তুতি রেখেছি।
আসনটিতে জামায়াত নেতা কাটাখালী পৌরসভার সাবেক মেয়র মাজেদুর রহমান মাঠ গোছাচ্ছেন। ভোটব্যাংক হিসেবে জামায়াত রাজশাহী-৩ আসনে প্রার্থী চাইবেন জোটের কাছে। অপর গুরুত্বপূর্ণ রাজশাহী-১ (তানোর-গোদাগাড়ী) আসনে জামায়াতের কেন্দ্রীয় ভারপ্রাপ্ত আমীর অধ্যাপক মজিবুর রহমান লড়বেন বলে চাউর হয়েছে। এই দুটি আসন নিয়েই মূলত জামায়াত জোটের সঙ্গে দর কষাকষি করবে বলে জানা গেছে।
ধানের শীষের দুর্গখ্যাত পবা-মোহনপুর থেকে মনোনয়ন পেতে কেন্দ্রীয়-স্থানীয় নেতার নাম এসেছে। কেন্দ্রীয় নেতৃবৃন্দের মধ্যে আছেন বিএনপি চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা বর্ষীয়ান নেতা কবীর হোসেন, সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী আহমেদ ও সহ-সাংগঠনিক সম্পাদক অ্যাডভোকেট সৈয়দ শাহীন শওকত। রাকসুর সাবেক ভিপি রুহুল কবির রিজভীকে এই আসনে প্রার্থী হিসেবে দেখতে চান তার অনুসারীরা। সিনিয়র নেতা কবীর হোসেনের বিকল্প হিসেবে তারা রুহুল কবির রিজভীর নাম সামনে আনছেন।
অপরদিকে শক্ত অবস্থান নিয়ে মাঠ ধরে আছেন মহানগর বিএনপির সাধারণ সম্পাদক অ্যাডভোকেট শফিকুল হক মিলন। মাঠে আছেন জেলা সাধারণ সম্পাদক মতিউর রহমান মন্টু ও যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক রায়হানুল আলম রায়হান। এদের মধ্যে শাহীন শওকত এই আসনের পাশাপাশি চাঁপাইনবাবগঞ্জ শিবগঞ্জ আসনের মনোনয়ন প্রার্থী।
মহানগর বিএনপির সাধারণ সম্পাদক অ্যাডভোকেট শফিকুল হক মিলন জানিয়েছেন, তারা প্রথমত চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়াকে মুক্ত করা এবং পরবর্তীকালে বেগম জিয়াকে নিয়ে নির্বাচনে অংশ নেয়ার কথা ভাবছেন। প্রার্থিতা প্রসঙ্গে বলেন, ’১৩ সালের সিটি করপোরেশন নির্বাচনে খালেদা জিয়ার নির্দেশনায় আমি মেয়র প্রার্থিতা প্রত্যাহার করে নিই। সে সময় হাইকমান্ড রাজশাহী-৩ আসনে নির্বাচনের প্রস্তুতি নিতে বলেন। এরপর থেকেই পবা-মোহনপুরের মানুষের সুখে-দুঃখে পাশে আছি।’
আওয়ামী লীগের প্রার্থিতা দৌড়ে বর্তমান সংসদ সদস্য আয়েন উদ্দিন, জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আসাদুজ্জামান আসাদ, সাবেক সংসদ সদস্য মেরাজ উদ্দিন মোল্লা, সাবেক মহিলা ও শিশুবিষয়ক প্রতিমন্ত্রী জিনাতুন নেসা তালুকদার, জেলা মহিলা আওয়ামী লীগের সভাপতি মর্জিনা পারভীন, জেলা কৃষক লীগের সভাপতি রবিউল আলম বাবু, সংরক্ষিত মহিলা আসনের এমপি ও জেলা আওয়ামী লীগের সহসভাপতি বেগম আকতার জাহানের নাম শোনা যাচ্ছে।
রাজশাহী জেলা কৃষক লীগ সভাপতি রবিউল আলম বাবু জানান, নব্বই দশকে পবা উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে চেয়ারম্যান পদে নির্বাচন করেছিলেন। দুই উপজেলার সংসদীয় আসনের এই উপজেলাতেই দুই-তৃতীয়াংশ ভোট রয়েছে। এলাকার মানুষের সঙ্গে দীর্ঘদিনের সম্পর্ক তাকে অন্যদের চেয়ে এগিয়ে রাখবে।
জেলা মহিলা আওয়ামী লীগ সভাপতি মর্জিনা পারভীন বলেন, শেখ হাসিনা সরকার দুর্নীতির বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স। নেত্রী পরিচ্ছন্ন দুর্নীতিমুক্ত তৃণমূল থেকে উঠে আসা নারী নেতৃত্বকে মূল্যায়ন করবেন বলে দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি।
রাজশাহী-৩ আসনের সংসদ সদস্য আয়েন উদ্দিন ২০১৪ সালের ৫ই জানুয়ারির নির্বাচনে নৌকা প্রতীক নিয়ে আওয়ামী লীগের বিদ্রোহী প্রার্থী মেরাজ উদ্দিন মোল্লাকে প্রায় ৫৫ হাজার ভোটের ব্যবধানে হারিয়ে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়েছিলেন। তৃণমূল থেকে উঠে আসা সাবেক এমপি আওয়ামী লীগ নেতা মেরাজ মোল্লা তার ছেলেদের বিতর্কিত কর্মকাণ্ডের কারণে জনপ্রিয়তা হারান। ’১৩ সালের ১লা নভেম্বর তৎকালীন এমপি মেরাজ উদ্দিন মোল্লার ছেলে মোস্তাক আহমেদ টুলু ইয়াবাসহ গ্রেপ্তার হয়। যে কারণে পরবর্তী নির্বাচনে মনোনয়ন হারাতে হয় এই প্রবীণ নেতাকে। সেবার আওয়ামী লীগের মনোনয়ন পান তরুণ নেতা আয়েন উদ্দিন। তত্ত্বাবাবধায়ক সরকারের আমলে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার মুক্তির দাবিতে আন্দোলন করতে গিয়ে কারাবরণ করেন তিনি। সে সময় তিনি রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক ছিলেন। তবে ২০১৪ সালের নির্বাচনে সংসদ সদস্য হওয়ার পর তিনিও শক্ত অবস্থান ধরে রাখতে ব্যর্থ হয়েছেন।
ঘাষিগ্রাম ইউনিয়নে আওয়ামী লীগের জনপ্রিয় ইউপি চেয়ারম্যান আফজাল হোসেন বকুলকে পরাজিত করে নিজ বড়ভাইকে বিজয়ী করাসহ ধুরই ইউপিতে বিএনপির চেয়ারম্যানকে বিজয়ী করার অভিযোগ আছে তার বিরুদ্ধে। আসনটিতে আবারো প্রার্থী পরিবর্তনের সুর উঠেছে আওয়ামী লীগ শিবিরে।
একইভাবে দীর্ঘদিন বিএনপির ডাকডাইটে নেতা সাবেক ভূমি প্রতিমন্ত্রী কবির হোসেনের দখলে থাকা রাজশাহী-৩ আসনে প্রার্থী পরিবর্তনের সুর আছে বিএনপিতেও। সর্বশেষ ২০০৮ সালের নির্বাচনে ধানের শীষ প্রতীকে নির্বাচনে অংশ নেন কবীর হোসেন। ২০০১ সালের নির্বাচনে বাঘা-চারঘাট আসন থেকে তিনি নির্বাচনে অংশ নিয়ে বিজয়ী হন। তবে বার্ধক্যজটিত কারণে এবার মনোনয়ন দৌড়ে ছিটকে পড়তে পারেন। আরেক প্রার্থী জেলা বিএনপির সাধারণ সম্পাদক মতিউর রহমান মন্টু সিটি নির্বাচনে ফাঁসকৃত একটি অডিও ক্লিপের কারণে দলের ভেতরে সমালোচিত।