প্রশাসনে রদবদল, গণগ্রেপ্তার বন্ধ, ভোটগ্রহণ কর্মকর্তাদের তালিকা বাতিল সহ বেশকিছু দাবি জানিয়েছে বিএনপি। এসব দাবি নিয়ে গতকাল বিএনপির একটি প্রতিনিধিদল নির্বাচন কমিশনের সঙ্গে বৈঠক করে। প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) কেএম নূরুল হুদা বরাবর পৃথক ৫টি চিঠিতে সুনির্দিষ্ট অভিযোগ উত্থাপনের পাশাপাশি বেশকিছু দাবি করে দলটি।
ভোটগ্রহণ কর্মকর্তাদের তালিকা বাতিলের দাবি: আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর মাধ্যমে ভোটগ্রহণ কর্মকর্তাদের প্রশিক্ষণ দেয়া হচ্ছে অভিযোগ করে এ কার্যক্রম বাতিলের দাবি জানিয়েছে বিএনপি। প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) বরাবর দাখিল করা লিখিত অভিযোগে বিএনপি বলেছে, তারা বিশ্বস্ত সূত্রে জানতে পেরেছে, মাঠ পর্যায়ে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী দ্বারা ভেটিংয়ের মাধ্যমে প্রস্তুতকৃত প্যানেল থেকে ভোটগ্রহণ কর্মকর্তাদের নিয়োগ ও প্রশিক্ষণ
দেয়ার উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। এমনকি এখনো ভেটিং কার্যক্রম চলমান রয়েছে। এতে করে সরকারি কর্মকর্তা ও তাদের পরিবার-পরিজন উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েছে। চিঠিতে বলা হয়, নির্বাচন কমিশন প্রণীত ‘কর্মপরিকল্পনা চেকলিস্টে’ ভোটগ্রহণ কর্মকর্তাদের প্যানেল পাঠানোর তারিখ নির্ধারণ করা হয়েছে ২রা ডিসেম্বর। নির্বাচন কমিশনের উল্লিখিত এ তারিখ ও কর্মকর্তা নীতিমালার সঙ্গে সামঞ্জস্যহীন ও নিয়ম-নীতির পরিপন্থি।এ বিষয়ে সিইসি গত ২২শে নভেম্বর তারিখ ভেটিং ও হয়রানি না করার যে নির্দেশনা দিয়েছেন তার কার্যকারিতা এখন আর বিদ্যমান নাই। কারণ ইতিমধ্যেই আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ভেটিংয়ের মাধ্যমে প্রস্তুতকৃত প্যানেল সহকারী রিটার্নিং কর্মকর্তার মাধ্যমে রিটার্নিং অফিসারদের কাছে জমা দেয়া হয়েছে।
চিঠিতে বিএনপি অবিলম্বে ভেটিংয়ের মাধ্যমে সংগৃহীত প্যানেল বাতিল এবং ভেটিংকৃত তালিকা থেকে নিয়োগ ও প্রশিক্ষণ কার্যক্রম বাতিলের দাবি জানিয়েছে। এ অবস্থায় জেলা প্রশাসক ও জেলা নির্র্বাচন অফিসারদের প্রত্যক্ষ তত্ত্বাবধানে নিয়মানুসারে নতুনভাবে খসড়া প্যানেল প্রস্তুতের দাবি জানিয়েছে দলটি।
গণগ্রেপ্তার বন্ধ, পুলিশ-প্রশাসনে প্রত্যহার, বদলি ও রদবদল: বিএনপির চিঠিতে বলা হয়েছে, জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের সঙ্গে প্রধানমন্ত্রীর দুই দফা আলোচনা বৈঠকে তিনি সুস্পষ্টভাবে প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন যে, কোনো রাজনৈতিক দলের নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে হয়রানিমূলক মামলা দায়ের ও গ্রেপ্তার করা হবে না এবং গ্রেপ্তারকৃতদের মুক্তি দেয়া হবে। কিন্তু দেখা যাচ্ছে যে, রাজনৈতিক মামলা ও গ্রেপ্তার অব্যাহত রয়েছে। সিইসির উদ্দেশ্যে বিএনপির ওই চিঠিতে বলা হয়, আপনি গণমাধ্যমে বলেছেন, পুলিশ বাহিনী আপনার নির্দেশেই কাজ করছে। সিইসির এ বক্তব্যের প্রতিবাদ জানিয়ে বিএনপি সিভিল ও পুলিশ প্রশাসনে পুনর্বিন্যাসসহ কয়েকটি সুনির্দিষ্ট দাবি জানানো হয়।
এসব দাবির মধ্যে বিতর্কিত কর্মকর্তাদের প্রত্যাহার, পুলিশ ও প্রশাসনের যেসব কমকর্তা যাদের বিরুদ্ধে ইতিমধ্যে অভিযোগ আনা হয়েছে তাদের প্রত্যাহার, পুলিশ ও প্রশাসনের কর্মকর্তাদের মধ্যে যারা এক বা একাধিক স্টেশনে দুই বছরের বেশি দায়িত্ব পালন করেছে তাদের প্রত্যাহার, সকল উপজেলা নির্বাহী অফিসার ও থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তাদের বর্তমান কর্মস্থল জেলার বাইরে বদলি, প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে কর্মরত ছিলেন বা আছেন এবং মন্ত্রী, প্রতিমন্ত্রী, উপমন্ত্রী, উপদেষ্টা বা সমমর্যাদাসম্পন্ন ব্যক্তিদের পিএস-এপিএস হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন তাদের নির্বাচন সংশ্লিষ্ট পদে পদায়ন রোধ এবং অতীতে নির্বাচনকালীন সময়ের ন্যায় সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ব্যবস্থাপনা কমিটি বাতিল করে স্থানীয় প্রশাসনের নিয়ন্ত্রণে আনার কথা বলেছে বিএনপি।
নৈর্ব্যক্তিকভাবে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী মোতায়েন: শান্তিপূর্ণ ও প্রভাবমুক্ত পরিবেশে ভোট প্রদান নিশ্চিতের জন্য প্রতিটি ভোটকেন্দ্রে নৈর্ব্যক্তিকভাবে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী মোতায়েনের দাবি জানিয়েছে বিএনপি। বিএনপির এ দাবিতে বলা হয়েছে, প্রতিটি নির্বাচনী আসনে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যদের দৃশ্যমানভাবে নাম ও র্যাংক ব্যাজসহ ইউনিফর্ম পরে দায়িত্ব পালন করতে হবে। কোনো সদস্য সাদা পোশাকে দায়িত্ব পালন করতে পারবে না। নির্বাচনের দিন ভোটকেন্দ্রে আনসার ও ভিডিপি সদস্যদের মোতায়েনের ক্ষেত্রে তাদের নিজস্ব ওয়ার্ড বা নিজে যে ভোটকেন্দ্রের ভোটার সেখানে মোতায়েন করা যাবে না।
তাদের নিয়োগের সময় নিশ্চিত হতে হবে যে, তিনি বা তারা কোনো রাজনৈতিক দলের বা প্রার্থীর সঙ্গে সম্পৃক্ত নন বা ছিলেন না। চিঠিতে বিএনপি অভিযোগ করেছে, দেশে কমিউনিটি পুলিশের আবরণে শাসক দলের কর্মীদের দিয়ে একটি দলীয় ক্যাডার বাহিনী গড়ে তোলা হয়েছে। এই কমিউনিটি পুলিশ সদস্যদের কোনো ধরনের নির্বাচনী দায়িত্বে নিয়োজিত করা যাবে না। তা ছাড়া ‘নিরাপত্তা কর্মী’ লিখিত কোনো পোশাক পরিধান করে কোনো ব্যক্তিকে ভোটকেন্দ্রে দায়িত্ব পালনে নিয়োজিত করা যাবে না। নির্বাচনে গ্রাম পুলিশের সদস্যদের দায়িত্ব প্রদানের সিদ্ধান্ত হলে তাদের নিজ ইউনিয়নের কোনো ভোটকেন্দ্রে নিয়োজিত করা যাবে না।
জানিপপ এবং বেরোবি’র ভিসিকে ভোট পর্যবেক্ষণ থেকে বিরত রাখা: নির্বাচন পর্যবেক্ষণ সংস্থা জানিপপ এবং এর চেয়ারম্যান ড. নাজমুল আহসান কলিমুল্লাহকে নির্বাচন পর্যবেক্ষণের দায়িত্ব থেকে বিরত রাখার দাবি জানানো হয়েছে। বিএনপি অভিযোগ করেছে, জানিপপ চেয়ারম্যান ড. নাজমুল আহসান কলিমুল্লাহ বর্তমানে বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের (বেরোবি) ভিসি। তিনি রংপুর সিটি করপোরেশন নির্বাচনের সময় আওয়ামী লীগের সম্ভাব্য প্রার্থী এবং আওয়ামী লীগের নেতা রাশেক রহমানের পক্ষে প্রচারণা চালান। এ ছাড়া তিনি সরকারি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে প্রশিক্ষণ কোর্সে বিশেষ করে পুলিশ ও র্যাবের কর্মকর্তাদের উদ্দেশে আওয়ামী লীগের পক্ষে বক্তব্য প্রদান করে থাকেন।
বিভিন্ন টকশো ও অনুষ্ঠানে দেয়া বক্তব্যে আওয়ামী লীগের দলীয় প্রচারণা চালিয়ে একজন আওয়ামী বুদ্ধিজীবী হিসেবেই উপস্থাপন করেন নিজেকে। প্রফেসর কলিমুল্লাহ আওয়ামী লীগ নেতা মহীউদ্দীন খান আলমগীরের ভাগিনা। চিঠিতে আরো অভিযোগ করা হয়, একটি রাজনৈতিক দলের মেয়র প্রার্থীর পক্ষে প্রচারণা চালিয়ে একজন পর্যবেক্ষক হিসেবে তিনি তার নিরপেক্ষতা ভঙ্গ করেছেন। একটি সুনির্দিষ্ট রাজনৈতিক দলের সমর্থন ও অ্যাক্টিভিস্ট হওয়ার কারণে জাতীয় সংসদ নির্বাচন পর্যবেক্ষণ সংস্থা ‘জানিপপ’ এবং এর চেয়ারম্যান ড. নাজমুল আহসান কলিমুল্লাহকে নির্বাচন পর্যবেক্ষকের দায়িত্ব প্রদান না করার জোর দাবি জানানো হয় বিএনপির পক্ষ থেকে।