রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন শুরুর কথা ছিল গত ১৫ নভেম্বর
রোহিঙ্গাদের রাখাইনে পাঠানোর প্রক্রিয়া শুরু করা যায়নি
এখন বাংলাদেশের উচ্চকণ্ঠ হওয়ার সময় হয়েছে
জাতিসংঘের বিশেষ দূত ইয়াংহি লি বাংলাদেশে এসেছেন
প্রত্যাবাসনের জন্য মিয়ানমার সহায়ক পরিবেশ তৈরি না করায় গত বছরের নভেম্বরে নির্ধারিত সময় অনুযায়ী রোহিঙ্গাদের রাখাইনে পাঠানোর প্রক্রিয়া শুরু করা যায়নি। বাংলাদেশের নির্বাচনের পর নতুন সরকার ক্ষমতায় এসে এ নিয়ে যখন মনোযোগী হবে, এমন সময়টাতে রাখাইনে আরাকান আর্মির সঙ্গে সংঘাতে জড়িয়ে পড়েছে মিয়ানমারের নিরাপত্তা বাহিনী। এতে রাখাইনের নিরাপত্তা পরিস্থিতি খারাপ হয়েছে। এমন পরিস্থিতিতে রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে নিতে অনিচ্ছুক মিয়ানমার যে কিছু করবে না, সেই আশঙ্কাটা আবার জোরালো হচ্ছে।
প্রত্যাবাসনের শুরু নিয়ে অনিশ্চয়তার এ সময়টাতে ভারত থেকে অন্তত দেড় হাজার রোহিঙ্গা এসেছে বাংলাদেশে। আবার সৌদি আরবে অবৈধ হয়ে পড়া আড়াই শ রোহিঙ্গা বাংলাদেশে আসার প্রহর গুনছে। এ অবস্থায় বাংলাদেশকে মিয়ানমারের বিরুদ্ধে উচ্চকণ্ঠ হওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশ্লেষকেরা।
এদিকে মিয়ানমারের মানবাধিকারবিষয়ক জাতিসংঘের বিশেষ দূত ইয়াংহি লি বাংলাদেশে এসেছেন। গত শনিবার ঢাকায় এসে পরদিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ কে আব্দুল মোমেনের সঙ্গে বৈঠকের পর তিনি রোহিঙ্গা পরিস্থিতি দেখতে কক্সবাজার গেছেন। মূলত রোহিঙ্গারা কেমন আছে, তা নিয়ে জাতিসংঘের মানবাধিকার পরিষদের অধিবেশনে প্রতিবেদন দেবেন ইয়াংহি লি। ওই প্রতিবেদন তৈরির প্রস্তুতির জন্য তিনি থাইল্যান্ড সফর শেষ করে বাংলাদেশে এসেছেন। ইয়াংহি লি নিরপেক্ষ নন, এই অভিযোগ তুলে ২০১৭ সালের ডিসেম্বর থেকে তাঁর সফরের ওপর নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে মিয়ানমার। তাই বাংলাদেশ, থাইল্যান্ড ঘুরে রোহিঙ্গাদের সর্বশেষ অবস্থা নিয়ে প্রতিবেদন তৈরি করবেন তিনি।
গত কয়েক দিনে ঢাকা ও ইয়াঙ্গুনের কূটনৈতিক সূত্রগুলোতে যোগাযোগ করে জানা গেছে, রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনের ক্ষেত্রে এখন মূল ভূমিকাটা মিয়ানমারকেই নিতে হবে। কারণ, সহায়ক পরিবেশ তৈরি হয়েছে এটা নিশ্চিত না হলে রোহিঙ্গাদের স্বেচ্ছায় পাঠানোর সুযোগ নেই।
রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনে মিয়ানমারের ভূমিকাই যে জরুরি, সেটা কোনো রকম রাখঢাক না রেখেই স্বীকার করেছেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী আব্দুল মোমেন। গত রোববার ইয়াংহি লির সঙ্গে বৈঠকের পর সাংবাদিকদের প্রশ্নের উত্তরে আব্দুল মোমেন বলেন, ‘আমরা চাই তাদের (মিয়ানমার) সঙ্গে সম্পর্ক আরও ভালো হোক। কিন্তু একটা ঘটনা আমাদের অত্যন্ত কষ্টে রেখেছে। আমরা মানবিক কারণে এদের নিয়েছি। এ সমস্যার সমাধান করা আমাদের একার দায়িত্ব নয়। এটা পৃথিবীর বড় বড় সব দেশের দায়িত্ব।’
রোহিঙ্গাদের ওপর নৃশংসতার অভিযোগে মিয়ানমারের সেনাবাহিনীর বিচারের বিষয়ে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের কণ্ঠও সাম্প্রতিক মাসগুলোতে জোরালো নয়। এ পরিস্থিতিতে সাবেক কূটনীতিক ও আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিষয়ের বিশ্লেষকেরা মনে করেন, এত দিন চুপচাপ থেকে রোহিঙ্গা সংকটের সমাধান গতি পায়নি। তাই বাংলাদেশের উচ্চকণ্ঠ হওয়ার সময় হয়েছে। তা ছাড়া ভারত ও সৌদি আরবের সঙ্গে সম্পর্ক যেহেতু সাম্প্রতিক বছরগুলোতে যথেষ্ট ভালো, তাদের সঙ্গে ‘নীরব কূটনীতির’ পথ ধরে রোহিঙ্গাদের বাংলাদেশে আসা বন্ধ করতে হবে।
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বশীল কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, আব্দুল মোমেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব নেওয়ার পর অন্যান্য বিষয়ের মতো অগ্রাধিকার বিষয় হিসেবে রোহিঙ্গা পরিস্থিতি সম্পর্কে শুনছেন। তা বোঝার চেষ্টা করছেন। তবে এ সংকট সমাধানে বাংলাদেশ এখন পর্যন্ত যেখানে রয়েছে, তা দিয়ে সমস্যার সমাধান না-ও হতে পারে। তাই বাংলাদেশের কৌশলে পরিবর্তন আনা উচিত বলে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কারও কারও মত।
জানতে চাইলে সাবেক পররাষ্ট্রসচিব মো. তৌহিদ হোসেন গতকাল বলেন, ‘রোহিঙ্গা সংকট সমাধানের জন্য এত দিন তো আমরা চুপ থেকেছি। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় এ সমস্যা সমাধানে যতটা সোচ্চার ছিল, প্রতিবেশী মিয়ানমারের বিষয়ে আমরা গলাটা উঁচু করিনি। এতে তো কোনো ফল আসেনি। কাজেই আমাদের উচ্চকণ্ঠ হওয়ার সময় হয়েছে।’
তৌহিদ হোসেন মনে করেন, রোহিঙ্গা সংকটে ভারত শুধু মানবিক সহযোগিতায় নিজেদের সীমিত রেখেছে। কাজেই রোহিঙ্গাদের ভারত থেকে আসা বন্ধে সরকার কী করবে, সেটার সিদ্ধান্ত কূটনৈতিক পর্যায়ে হবে না। এ সিদ্ধান্ত হবে সর্বোচ্চ রাজনৈতিক পর্যায় থেকে। তবে সৌদি আরবের ক্ষেত্রে সরকারকে বলতে হবে তাদের সব সংকটে বাংলাদেশ পাশে থেকেছে। এবার তাদের বাংলাদেশের পাশে থাকার পালা। কারণ, সম্পর্ক কখনো একপেশে হতে পারে না। পারস্পরিক দেওয়া-নেওয়ার মধ্যেই সম্পর্ক এগিয়ে চলে।
বাংলাদেশের কূটনীতিকদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ভারত থেকে রোহিঙ্গাদের বাংলাদেশে চলে আসা বন্ধ করতে দিল্লির সঙ্গে ‘নীরব কূটনীতি’র কথা ভাবছে ঢাকা। এমনকি সীমান্ত পেরিয়ে রোহিঙ্গারা যাতে ভারত থেকে বাংলাদেশে আসতে না পারে, তা নিয়ে বিধিনিষেধ আরোপের কথাও ঢাকা বিবেচনা করছে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক সি আর আবরার গতকাল বলেন, ‘রোহিঙ্গাদের সীমান্ত পেরিয়ে বাংলাদেশে চলে আসার ব্যাপারে ভারতকে এখন পর্যন্ত কোনো মন্তব্য করতে শুনিনি। যেহেতু রোহিঙ্গারা বাংলাদেশের নাগরিক নয়, কাজেই তাদের এ দেশে পাঠিয়ে দেওয়াটা ভারতের “সুপ্রতিবেশীসুলভ” মনোভাবের পরিচায়ক নয়। আর সৌদি আরব থেকে রোহিঙ্গাদের ফেরত পাঠানোর বিষয়ে সরকারকে সোচ্চার হতে হবে। সৌদি সরকারকে স্পষ্ট করেই বলা উচিত, ইয়েমেনের মতো “অন্যায় যুদ্ধে” আমরা সমর্থন দিয়েছি। কাজেই সম্পর্কটা কোনোভাবেই যে একপেশে হতে পারে না, এটা তাদের সরাসরি বলা উচিত।’
ঢাকার কূটনৈতিক সূত্রগুলো বলছে, সাম্প্রতিক বছরগুলোতে সৌদি আরবের সঙ্গে সম্পর্ক যথেষ্ট ভালো। ইয়েমেনে সৌদি নেতৃত্বাধীন অভিযান, আইএসবিরোধী জোটসহ নানা উদ্যোগে মধ্যপ্রাচ্যের দেশটিকে কোনোরকম রাখঢাক না করেই বাংলাদেশ সমর্থন দিয়ে আসছে। এ বিষয়গুলো বিবেচনায় নিয়ে সৌদি আরবকে বলার সময় এসেছে, এমনিতেই রোহিঙ্গাদের নিয়ে সংকটে আছে বাংলাদেশ। অবৈধ হয়ে পড়া রোহিঙ্গাদের বাংলাদেশে পাঠিয়ে আপাতত নতুন সংকট তৈরি করা ঠিক হবে না। তবে সৌদি আরবের সঙ্গেও বিষয়টি ঢাকঢোল না পিটিয়ে করার পক্ষেই মত বাংলাদেশের কূটনীতিকদের।
শূন্যরেখায় চার দিন ৩১ রোহিঙ্গা
ব্রাহ্মণবাড়িয়ার কসবা উপজেলার গোপীনাথপুর ইউনিয়নের কাজিয়াতলী এলাকার বাংলাদেশ-ভারত সীমান্তের ২০২৯ পিলারের কাছ দিয়ে ৩১ জন রোহিঙ্গাকে বাংলাদেশে পুশব্যাক করার চেষ্টা করছে ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনী (বিএসএফ)। চার দিন ধরে সীমান্তের শূন্যরেখায় অবস্থান করছে তারা। গত রোববার দুই দফা অধিনায়ক পর্যায়ে পতাকা বৈঠক হলেও কোনো ফল বের হয়নি। ওই রোহিঙ্গাদের রয়েছে জম্মু-কাশ্মীরের স্বাস্থ্য কার্ড ও শরণার্থী কার্ড।
বিজিবির ২৫ ব্যাটালিয়ন অধিনায়ক গোলাম কবির বলেন, শূন্যরেখায় অবস্থানকারীদের হাতে ভারতীয় শরণার্থী ও রেশন কার্ড আছে। পতাকা বৈঠকে এগুলো উপস্থাপন করা হয়েছে। তবে বিএসএফের দাবি, এরা ভারতের নাগরিক না।