বছর ঘুরে আবারো হাজির প্রাণের মেলা অমর একুশে গ্রন্থমেলা। চেনা দৃশ্যে রঙিন হয়ে উঠছে একাডেমি আর সোহরাওয়ার্দী উদ্যান। আজ থেকে শুরু হচ্ছে অমর একুশে গ্রন্থমেলা। এবারের গ্রন্থমেলার প্রতিপাদ্য ঠিক হয়েছে ‘বিজয়: ১৯৫২ থেকে ১৯৭১ নবপর্যায়’। এ বছরও বিস্তৃত হয়েছে মেলার পরিসর। প্রায় ৫ লাখ বর্গফুট জায়গায় আয়োজন করা হয়েছে এবারের গ্রন্থমেলা। অংশগ্রহণকারী প্রতিষ্ঠানের সংখ্যাও বৃদ্ধি পেয়েছে। এ ছাড়া এক ঘণ্টা সময় বাড়ায় মেলা চলবে রাত ৯টা পর্যন্ত এবং খুলবে দুপুর ৩টায়।
তবে শুক্র ও শনিবার শুরু হবে বেলা ১১টা থেকে। আর ২১শে ফেব্রুয়ারি সকাল ৮টা থেকে শুরু হয়ে রাত ৯টা পর্যন্ত মেলা চলবে বলে জানিয়েছেন বাংলা একাডেমির মহাপরিচালক হাবিবুল্লাহ সিরাজী। আজ বিকাল ৩টায় বাংলা একাডেমি প্রাঙ্গণে অমর একুশে গ্রন্থমেলার উদ্বোধন করবেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। জাতীয় অধ্যাপক আনিসুজ্জামানের সভাপতিত্বে এ অনুষ্ঠানে বিশেষ অতিথি থাকবেন সংস্কৃতি প্রতিমন্ত্রী কে এম খালিদ বাবু, ভারতীয় কবি শঙ্খ ঘোষ, মিশরীয় লেখক-গবেষক মোহসেন আল আরিশি। স্বাগত ভাষণ দেবেন বাংলা একাডেমির মহাপরিচালক হাবিবুল্লাহ সিরাজী।
এর আগে অমর একুশে গ্রন্থমেলা-২০১৮ উপলক্ষে আবদুল করিম সাহিত্যবিশারদ মিলনায়তনে সংবাদ সম্মেলনের আয়োজন করে বাংলা একাডেমি। সেখানে বিস্তারিত তুলে ধরে লিখিত বক্তব্য পাঠ করেন মেলা পরিচালনা কমিটির সদস্য সচিব ও বাংলা একাডেমির পরিচালক ড. জালাল আহমদ। তিনি বলেন, এবারের মেলা অনুষ্ঠিত হচ্ছে বাংলা একাডেমি প্রাঙ্গণ ও সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে। অতীতের যে কোনো সময়ের তুলনায় পরিসরও বেড়েছে। একাডেমি প্রাঙ্গণে ৯২ প্রতিষ্ঠানকে ১৩৬টি, সোহরাওয়ার্দী উদ্যান অংশে ৩৬৩ প্রতিষ্ঠানকে ৫৮৩টি ইউনিট এবং বাংলা একাডেমিসহ ২৪ প্রকাশনা প্রতিষ্ঠানকে ১৫ হাজার ৫৩৬ বর্গফুট আয়তনের ২৫টি প্যাভিলিয়ন বরাদ্দ দেয়া হয়েছে। আর লিটল ম্যাগাজিন কর্নারে স্টল বরাদ্দ দেয়া হয়েছে ১৩৬ ম্যাগাজিনকে।
তিনি আরও বলেন, মেলায় বড় ও দৃষ্টিনন্দন মোড়ক উন্মোচন মঞ্চ থাকছে। শারীরিকভাবে অসুবিধাগ্রস্ত ও প্রবীণ মানুষের চলাচলের সুবিধার্থে হুইলচেয়ারের সংখ্যাও গতবারের চেয়ে এবার বাড়ানো হয়েছে। সোহরাওয়ার্দী উদ্যান অংশে তিনটি ও বাংলা একাডেমি অংশে থাকছে দুটি ক্যান্টিন। প্রাকৃতিক দুর্যোগের কথা মাথায় রেখে উদ্যান ও একাডেমি উভয় অংশের স্টলগুলোতে টিনের ছাউনি দেয়া হয়েছে। সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে পর্যাপ্ত মাটি ফেলে ভরাট করা হয়েছে জমি। প্রায় এক লাখ বর্গফুট এলাকায় ইট ও বালু দিয়ে অস্থায়ী রাস্তা বা উন্মুক্ত প্রান্তর নির্মাণ করা হয়েছে। এক হাজার বর্গফুট জায়গায় টাইলস দিয়ে নারী-পুরুষের জন্য আলাদা অজু ও টয়লেটের ব্যবস্থা করা হয়েছে।
সদস্যসচিব জানান, গ্রন্থমেলায় টিএসসি, দোয়েল চত্বর দিয়ে দুটি মূল প্রবেশপথ, বাংলা একাডেমি প্রাঙ্গণে তিনটি পথ, সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে প্রবেশ ও বাহিরের ছয়টি পথ থাকছে।
বিশেষ দিনগুলোতে লেখক, সাংবাদিক, প্রকাশক, বাংলা একাডেমির ফেলো এবং রাষ্ট্রীয় সম্মাননাপ্রাপ্ত নাগরিকদের জন্য প্রবেশে থাকছে বিশেষ ব্যবস্থা। এ ছাড়া মেলার প্রবেশ ও বাহিরপথে পর্যাপ্ত সংখ্যক আর্চওয়ের ব্যবস্থা করা হয়েছে। সার্বিক নিরাপত্তার দায়িত্ব পালন করবে পুলিশ, র্যাব, আনসার, বিজিবি ও গোয়েন্দা সংস্থার নিরাপত্তাকর্মীরা। নিরাপত্তার জন্য মেলায় এলাকাজুড়ে ২৫০ ক্লোজড সার্কিট ক্যামেরার ব্যবস্থা করা হয়েছে। সম্পূর্ণ পলিথিন ও ধূমপানমুক্ত থাকছে এবারের গ্রন্থমেলা। মেলা ঘিরে সর্বোচ্চ নিরাপত্তা পরিকল্পনা নেয়ার কথা জানিয়েছেন আইনশৃঙ্খলা বাহিনীও। সামাজিক বা ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত হানে এমন বইয়ের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ার কথা জানিয়েছেন ডিএমপি কমিশনার। বই মেলার নিরাপত্তা পরিস্থিতি দেখতে এসে ডিএমপি কমিশনার আছাদুজ্জামান মিয়া বলেন, নিরাপত্তার স্বার্থে মেলা ও আশপাশে সিসিটিভি ক্যামেরা বসানো হয়েছে। বাড়ানো হয়েছে গোয়েন্দা নজরদারি। সব ধরনের অনিয়ম এবং বিশৃঙ্খলা ঠেকাতে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী সব সময় সজাগ দৃষ্টি রাখবে।
বাংলা একাডেমি এবং মেলায় অংশগ্রহণকারী অন্যান্য প্রতিষ্ঠান ২৫ শতাংশ কমিশনে বই বিক্রি করবে। তবে পেমেন্ট বিকাশে করলে অতিরিক্ত আরও ১০ শতাংশ কমিশন পাওয়া যাবে বলে জানান বিকাশের প্রধান নির্বাহী (সিইও) কামাল কাদের। বইমেলার সব স্টলেই বিকাশে পেমেন্ট করা যাবে বলেও নিশ্চিত করেন তিনি। এর মাধ্যমে বই কিনলে সর্বোচ্চ ৩৫ শতাংশ পর্যন্ত ছাড় মিলবে।
বাংলা একাডেমির মহাপরিচালক হাবিবুল্লাহ সিরাজী বলেন, বৃহস্পতিবার বেলা ৩টায় মাসব্যাপী গ্রন্থমেলার উদ্বোধন করবেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। ইতিমধ্যে মেলা সামনে রেখে সব প্রস্তুতি প্রায় সম্পন্ন। গ্রন্থমেলা উপলক্ষে বাংলা একাডেমি একটি ওয়েবসাইট ও একটি মোবাইল অ্যাপও তৈরি করেছে। এতে একসঙ্গে প্রায় দুই লাখ পর্যন্ত হিট করা যাবে। আর মোবাইল অ্যাপটি উদ্বোধন করবেন প্রধানমন্ত্রী। তিনি আরও বলেন, গ্রন্থমেলা উপলক্ষে ২২ ও ২৩শে ফেব্রুয়ারি আন্তর্জাতিক সাহিত্য সম্মেলনের আয়োজন করা হয়েছে। এতে স্বাগতিক বাংলাদেশসহ ফ্রান্স, স্পেন, নেপাল, শ্রীলঙ্কা, ভারতসহ আট দেশের ১৫ কবি-লেখক ও বুদ্ধিজীবী অংশ নেবেন। এ সংবাদ সম্মেলনে আরও উপস্থিত ছিলেন একাডেমির সচিব মোহাম্মদ আনোয়ার হোসেন প্রমুখ।
বাংলাদেশে বইমেলার ইতিহাস খুব বেশি দিনের পুরনো নয়। স্বাধীনতা-পরবর্তী সময়ে ১৯৭২ সালের ঘটনা। সেই বছর ৮ই ফেব্রুয়ারি চিত্তরঞ্জন সাহা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় সংলগ্ন বর্ধমান হাউস প্রাঙ্গণে এক টুকরো চটের ওপর ৩২টি বই নিয়ে অনানুষ্ঠানিকভাবে এক বইমেলার সূচনা করেন। এই ৩২টি বই চিত্তরঞ্জন সাহা প্রতিষ্ঠিত স্বাধীন বাংলা সাহিত্য পরিষদ বর্তমানে মুক্তধারা প্রকাশনী থেকে প্রকাশিত বাংলাদেশি শরণার্থী লেখকদের লেখা। ১৯৭২ থেকে ১৯৭৬ সাল পর্যন্ত তার একার দায়িত্বে এবং উৎসাহে বইমেলা চলতে থাকে। ১৯৭৯ সালে মেলার সঙ্গে যুক্ত হয় বাংলাদেশ পুস্তক প্রকাশক ও বিক্রেতা সমিতি। এ সংস্থাটিও প্রতিষ্ঠা করেছিলেন চিত্তরঞ্জন সাহা। ১৯৮৪ সালে এসে গ্রন্থমেলার জন্য বিধিবদ্ধ নীতিমালা প্রণীত হয় এবং এই গ্রন্থমেলার নাম হয় ‘অমর একুশে গ্রন্থমেলা’। সেই থেকে অমর একুশে গ্রন্থমেলা প্রতি বছর প্রায় একই আঙ্গিকে অনুষ্ঠিত হয়ে আসছে।
আশির দশকের মাঝামাঝি থেকে মেলায় অংশগ্রহণকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর সংখ্যা বাড়তে থাকে। ১৯৮০ সালের গ্রন্থমেলায় সে সংখ্যা ছিল মাত্র ৩০টি; মাত্র পাঁচ বছর পর ১৯৮৫ সালে সে সংখ্যা বেড়ে দাঁড়ায় ৮২-তে। ১৯৯১ সালে এ সংখ্যাটি ১৯০-এ উন্নীত হয়। এর মাত্র এক বছরের ব্যবধানে ১৯৯২ সালে অনুষ্ঠিত অমর একুশে গ্রন্থমেলায় অংশগ্রহণকারী প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা বেড়ে দাঁড়ায় ২৭০। সত্তর দশকের শেষ দিকে মেলার ব্যাপক আয়োজন শুরু হলেও এ আয়োজন পূর্ণতা পায় আশির দশকের মাঝামাঝি এসে। নব্বইয়ের শুরুতে মেলা অভাবনীয় ব্যপ্তি লাভ করে। ও পাঠকের দীর্ঘদিনের দাবির পরিপ্রেক্ষিতে ২০১৪ সাল থেকে অমর একুশে গ্রন্থমেলার মূল আয়োজন বাংলা একাডেমি প্রাঙ্গণ ছাড়িয়ে পাশের সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে সম্প্রসারণ করা হয়েছে।