চলতি মাসেই বাড়ছে গ্যাসের দাম। এ নিয়ে আগামী ১১ই মার্চ থেকে গণশুনানি করবে বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশন (বিইআরসি)। গণশুনানি ১৪ই মার্চ পর্যন্ত চলবে, এরপরই আসবে দাম বৃদ্ধির ঘোষণা। এদিকে গতকাল বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ এক অনুষ্ঠানে বলেছেন, গ্যাসের দাম বাড়তে পারে। এ দফায় বাণিজ্যিক, শিল্প-কারখানা ও বিদ্যুৎ সেক্টরের গ্যাসের দাম বাড়বে। তিনি আরো বলেন, আগামী ২০৩০ সালের মধ্যে ১১০ থেকে ১২০ বিলিয়ন মার্কিন ডলার বিদ্যুৎ ও জ্বালানি সেক্টরে বিনিয়োগ হবে। বিইআরসি সূত্র জানান, মূলত বেশি দামে তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাস (এলএনজি) আমদানির কারণে বিতরণ কোম্পানিগুলো গ্যাসের দাম বাড়ানোর প্রস্তাব করেছে। কোম্পানিগুলো গড়ে ৬৬ শতাংশ দাম বাড়ানোর প্রস্তাব দিয়েছে।
আগামী ১১ই মার্চ গণশুনানি করার উদ্যোগ নিয়েছে। আবাসিক খাতে গ্যাসের দাম বাড়ানোর বিষয়ে বিতরণ কোম্পানিগুলোর প্রস্তাবে বলা হয়, গ্রাহক পর্যায়ে এক বার্নারের গ্যাসের চুলা ৭৫০ টাকা থেকে বাড়িয়ে ১ হাজার টাকা, দুই বার্নারের চুলা ৮০০ টাকা থেকে বাড়িয়ে ১ হাজার ২০০ টাকা এবং মিটারযুক্ত চুলার ক্ষেত্রে প্রতি ঘনমিটার গ্যাসের দাম ৯ টাকা ১০ পয়সা থেকে বাড়িয়ে ১৩ টাকা ৬৫ পয়সা করার কথা বলা হয়েছে।
এ ছাড়া বিদ্যুৎ কেন্দ্রে সরবরাহকৃত গ্যাসের দাম ঘনমিটার প্রতি ৩ টাকা ১৬ পয়সা থেকে বাড়িয়ে ৭ টাকা ৬৬ পয়সা, ক্যাপটিভ পাওয়ার প্ল্যান্টের ক্ষেত্রে ৯ টাকা ৬২ পয়সা থেকে বাড়িয়ে ১৫ টাকা ৭০ পয়সা, সারকারখানার ক্ষেত্রে ২ টাকা ৭১ পয়সা থেকে বাড়িয়ে ৭ টাকা, শিল্প- কারখানার ক্ষেত্রে ৭ টাকা ৭৬ পয়সা থেকে ১৫ টাকা করার প্রস্তাব করা হয়েছে। এ ছাড়া বাণিজ্যিকভাবে ব্যবহৃত গ্যাসের দাম ১৭ দশমিক ৪ টাকা থেকে বাড়িয়ে ২০ টাকা এবং সিএনজির গ্যাসের দাম ৩২ টাকা থেকে বাড়িয়ে ৪০ টাকা করার প্রস্তাব করেছে বিতরণ কোম্পানিগুলো।
এদিকে চার মাসের মাথায় পুনরায় গ্যাস সঞ্চালন চার্জ বাড়ানোর প্রস্তাব দিয়েছে গ্যাস ট্রান্সমিশন কোম্পানি লিমিটেড (জিটিসিএল)। গতবছরের ১৮ই সেপ্টেম্বর সঞ্চালন চার্জ ঘনমিটার প্রতি শূন্য দশমিক ২৬৫৪ টাকা থেকে বাড়িয়ে শূন্য দশমিক ৪২৩৫ টাকা করেছিল কমিশন। গ্যাসের দাম বৃদ্ধির যৌক্তিকতা তুলে ধরে কোম্পানিগুলোর প্রস্তাবে বলা হয়েছে, দেশের জ্বালানি নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে সরকার এলএনজি আমদানি করছে। বর্তমানে জাতীয় গ্রিডে দৈনিক ৪৫০ থেকে ৪৭০ মিলিয়ন ঘনফুট এলএনজি সরবরাহ করা হচ্ছে। চলতি বছরের এপ্রিলে এলএনজি সরবরাহের পরিমাণ দাঁড়াবে ৭০০ মিলিয়ন ঘনফুটে। বেশি দামে এলএনজি কিনে কম দামে বিক্রির কারণে আর্থিক ঘাটতি তৈরি হবে। এই আর্থিক ঘাটতি এড়াতেই গ্যাসের দাম বাড়ানো প্রয়োজন। সংশ্লিষ্টরা জানান, বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশন আইন ২০০৩ অনুযায়ী জিটিসিএল, তিতাস গ্যাস, বাখরাবাদ গ্যাস, জালালাবাদ গ্যাস, পশ্চিমাঞ্চল গ্যাস, কর্ণফুলী গ্যাস, সুন্দরবন গ্যাস তাদের বিতরণ চার্জ ও ভোক্তা পর্যায়ে দাম পুনঃনির্ধারণের জন্য কমিশনে আবেদন জমা দিয়েছে। এর মধ্যে প্রথমদিন ১১ই মার্চ সোমবার সকাল ১০টায় গ্যাসের দামের ওপর একটি প্রস্তাবনা উপস্থাপন করবে বাংলাদেশ তেল, গ্যাস ও খনিজ সম্পদ করপোরেশন (পেট্রোবাংলা)। একইদিন সকাল সাড়ে ১০টা থেকে গ্যাস ট্রান্সমিশন অ্যান্ড ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি লিমিটেডের (জিটিসিএল) প্রস্তাবিত সঞ্চালন চার্জের ওপর শুনানি হবে। ১২ই মার্চ সকালে তিতাস গ্যাস ট্রান্সমিশন অ্যান্ড ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানির প্রস্তাবিত দামের ওপর শুনানি হবে।
দুপুর আড়াইটা থেকে সুন্দরবন গ্যাস কোম্পানি লিমিটেডের প্রস্তাবের ওপর শুনানি হবে। ১৩ই মার্চ সকালে বাখরাবাদ গ্যাস ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি লিমিটেডের আর দুপুরে জালালাবাদ গ্যাস ট্রান্সমিশন অ্যান্ড ডিস্ট্রিবিউশন সিস্টেম লিমিটেডের প্রস্তাবের ওপর শুনানি করা হবে। এ ছাড়া ১৪ই মার্চ সকালে কর্ণফুলী গ্যাস ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি লিমিটেড এবং দুপুরে পশ্চিমাঞ্চল গ্যাস কোম্পানি লিমিটেডের প্রস্তাবিত দামের ওপর শুনানি করবে কমিশন।
গ্যাসের দাম বাড়ানোর পাঁয়তারা বন্ধ করুন: গতকাল জাতীয় প্রেস ক্লাবের সামনে প্রতিবাদী নাগরিক সমাজের উদ্যোগে আয়োজিত অবস্থান সমাবেশ থেকে গণশুনানির নামে গ্যাসের দাম বাড়ানোর চক্রান্ত বন্ধ করার দাবি জানিয়েছেন নেতৃবৃন্দ। পাশাপাশি আবাসিক গ্রাহকদের চুলায় নিয়মমতো গ্যাস সরবরাহ ও সারা দেশে ন্যায্যমূল্যে নিরাপদ গ্যাস সিলিন্ডার দেয়ারও দাবি জানান তারা। সেই সঙ্গে জানতে চাওয়া হয়, গ্যাসের মূল্য বৃদ্ধি কার স্বার্থে? সমাবেশে কলামিস্ট সৈয়দ আবুল মকসুদ বলেন, দেশের জনগণকে গ্যাস থেকে বঞ্চিত করবেন না। যারা রান্না করে তারা জানে গ্যাসের কী সংকট। সরকারের উচিত সংকট দূর করার। কিন্তু তা না করে আবারো গ্যাসের দাম বাড়ানোর পাঁয়তারা করা হচ্ছে।
দাবিগুলোর মধ্যে রয়েছে গণশুনানির নামে গ্যাসের দাম বাড়ানোর পাঁয়তারা বন্ধ করতে হবে; বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশনের সদস্যদের মধ্যে অভিযুক্ত দুর্নীতিবাজ সব সদস্যকে অপসারণ ও দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দিতে হবে; আবাসিক গ্রাহকদের চুলায় নিয়মমতো গ্যাস ও সারা দেশে ন্যায্যমূল্যে নিরাপদ গ্যাস সিলিন্ডার দিতে হবে; গ্যাসখাতে দুর্নীতি ও অপচয় বন্ধ করতে হবে; শতভাগ মালিকানা নিশ্চিত করে স্থলে ও সমুদ্র বক্ষের গ্যাস উত্তোলনের ব্যবস্থা করতে হবে এবং এলএনজি আমদানির নামে সাধারণ মানুষের পকেট কেটে ব্যবসায়ী কমিশনভোগীদের পকেট ভারি করার নীতি বন্ধ করতে হবে। সমাবেশে আরো উপস্থিত ছিলেন বাসদ নেতা রাজেকুজ্জামান রতন, সিপিবির কেন্দ্রীয় নেতা রুহিন হোসেন প্রিন্স, নাগরিক আন্দোলনের নেতা শরিফ উদ্দিন শরীফ, সুপ্রিম কোর্টের অ্যাডভোকেট হাসান তারিক চৌধুরী প্রমুখ।