প্রচারের আর মাত্র চারদিন বাকি। প্রার্থীরা ছুটছেন ভোটারদের কাছে। প্রচারে দৃশ্যমান লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড। কিন্তু প্রার্থী ও কর্মী-সমর্থকরা বলছেন, আদতে এখনও ভয়ের পরিবেশ রয়ে গেছে। শুরু থেকে আচরণবিধি লঙ্ঘনই এর বড় প্রমাণ। ক্ষমতাসীন দলের ছাত্র সংগঠন ছাত্রলীগের বিরুদ্ধে শুরু থেকেই আচরণবিধি লঙ্ঘনের অভিযোগ উঠেছে। অভিযোগ উঠেছে বাম সংগঠনের বিরুদ্ধেও।

এ অবস্থায় এখন পর্যন্ত কারও বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেয়া হয়নি।নির্বাচন সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ কাউকে সতর্কও করেনি। প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীরা বলছেন, আচরণবিধি লঙ্ঘনের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা না নেয়া এক ধরনের পক্ষপাতমূলক আচরণ। এতে যারা আচরণবিধি মেনে প্রচারণা চালাচ্ছে তারা ভয় পাচ্ছে স্বাভাবিক কর্মকাণ্ড চালাতে। এছাড়া ক্যাম্পাসে জমজমাট প্রচার-প্রচারণা চললেও হলগুলোতে এখনও একপক্ষীয় অবস্থানই দেখা যাচ্ছে। বিরোধী প্রার্থীদের অভিযোগ তাদের কর্মী সমর্থক প্রচারণায় নজরদারি করা হচ্ছে।

এতে সাধারণ শিক্ষার্থীদের মধ্যে ভয়ের ছাপ দেখা যাচ্ছে। বেশির ভাগ হলে ছাত্রলীগের নিয়ন্ত্রণ থাকায় প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীরা সেখানে জোরেশোরে প্রচারণা চালাতে পারছেন না। তারা নির্ধারিত সময়ে সুযোগ বুঝে প্রচারণা চালাচ্ছেন। যদিও বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ বলছে অভিযোগ পেলে ব্যবস্থা নেয়া হবে। তবে আচরণবিধি লঙ্ঘনের যেসব অভিযোগ দৃশ্যমান তার বিরুদ্ধে কর্তৃপক্ষ কেন ব্যবস্থা নিচ্ছে না এর কোনো উত্তর মিলেনি। সার্বিক পরিস্থিতিতে এখনও বিরোধী ছাত্র সংগঠনগুলোর প্রার্থীরা ভয় ও শঙ্কার মধ্যে আছেন বলে জানিয়েছে। একই অবস্থা স্বতন্ত্র প্রার্থীদের ক্ষেত্রেও।

ক্যাম্পাসে প্রচারণা চালালেও এখনো পর্যন্ত হলে প্রচারণার ভালো পরিবেশ তৈরি হয়নি বলে মনে করছেন অনেকে। ছাত্রদল গতকাল সন্ধ্যায় প্রচারণার অংশ হিসেবে প্রথমবারের মতো মুক্তিযোদ্ধা জিয়াউর রহমান হলে যায়। অন্যান্য হলে সংগঠনটি এখনো স্বাধীনভাবে প্রচারণা চালাতে পারছে না। ভয়-ভীতি নিয়েই বিক্ষিপ্তভাবে হলে যাচ্ছেন অনেকে। হলের অভ্যন্তরে ছাত্রদলের নেই কোনো ব্যানারও। ক্যাম্পাসে সুষ্ঠু পরিবেশ রেখে হলে এমন পরিবেশ চলতে থাকলে নির্বাচনকে প্রশ্নবিদ্ধ করবে বলে মনে করেন অনেকে। এদিকে গতকালও স্যার এএফ রহমান হলে স্বতন্ত্র প্রার্থী ফাহিম রেজা শোভনের ব্যানার নামিয়ে ফেলার অভিযোগ উঠেছে ছাত্রলীগের হয়ে হলটিতে ভিপি প্রার্থী আবদুল আলীম খানের বিরুদ্ধে। এ বিষয়ে ফাহিম রেজা শোভন ব্যবস্থা নিতে হল রিটার্নিং কর্মকর্তা বরাবর লিখিত অভিযোগ দিয়েছেন। প্রচারণার ক্ষেত্রে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের করা আচরণবিধির তোয়াক্কা করছে না ছাত্রলীগ। যদিও আচরণবিধিতে উল্লেখ আছে স্বপ্রণোদিতভাবেও আচরণবিধি লঙ্ঘনকারীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে পারবেন সংশ্লিষ্ট রিটার্নিং কর্মকর্তা। আচরণবিধি লঙ্ঘনের ব্যাপারে এখনো পর্যন্ত কোনো ধরনের শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করেনি প্রশাসন। যদিও অভিযোগ পড়েছে বেশ কয়েকটি। গতকালও নির্বাচনী প্রচারণায় আচরণবিধি লঙ্ঘন করেছে ছাত্রলীগ ও ছাত্র ইউনিয়ন।

আবারো আচরণবিধি লঙ্ঘন ছাত্রলীগের:
ক্লাসরুমে প্রচারণা চালানোর বিষয়ে নিষেধাজ্ঞা থাকলেও গতকাল ক্লাসরুমে প্রচারণা চালিয়েছে ছাত্রলীগের ভিপি প্রার্থী রেজওয়ানুল হক চৌধুরী শোভন। দেয়ালে পোস্টার টাঙানো নিষিদ্ধ হলেও শোভনসহ ছাত্রলীগের একাধিক প্রার্থী দেয়ালে পোস্টার ও স্টিকার লাগিয়েছেন। এর আগেও শোভন রঙিন পোস্টার টাঙিয়েছেন ক্যাম্পাসের বিভিন্ন দেয়ালে। লিফলেটে অন্যকারো ছবি ব্যবহার নিষিদ্ধ হলেও বঙ্গবন্ধু ও প্রধানমন্ত্রীর ছবি ব্যবহার করে লিফলেট ছাপিয়েছেন রোকেয়া হলে ছাত্রলীগের প্রার্থীরা।

অন্যদিকে আচরণবিধিতে নিষেধাজ্ঞা থাকলেও ড্রাম-বাঁশি বাজিয়ে শোভাযাত্রা করেছে ছাত্র ইউনিয়ন। আচরণবিধি লঙ্ঘনের বিষয়ে জানতে ছাত্রলীগ সভাপতি রেজওয়ানুল হক চৌধুরী শোভনকে একাধিকবার ফোন করা হলেও তিনি রিসিভ করেননি। রোকেয়া হলে ছাত্রলীগ থেকে ভিপি প্রার্থী ইসরাত জাহান তন্বী বলেন, তিনি লিফলেটে কারো ছবি ব্যবহার করা যাবে না এমন তথ্য জানতেন না। আগামীতে এ ধরনের কাজ থেকে বিরত থাকবেন। অন্যদিকে বামজোটের ভিপি প্রার্থী ছাত্র ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদক লিটন নন্দী বলেন, আচরণবিধিতে ব্যান্ড পার্টির ব্যবহার নিষিদ্ধ ছিল। কিন্তু ড্রাম বাজানোর বিষয়ে কোনো নিষেধাজ্ঞা ছিল না। আর আচরণবিধি লঙ্ঘন হলে আমরা এ বিষয়ে প্রশাসনের কাছে ব্যাখ্যা দেবো। আচরণবিধি লঙ্ঘনের বিষয়ে জানতে চাইলে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর একেএম গোলাম রব্বানী বলেন, কেউ অভিযোগ দিলে আমরা ব্যবস্থা গ্রহণ করবো। তবে আমাদের কাছে সুনির্দিষ্ট তথ্য আসতে হবে আচরণবিধি লঙ্ঘনের। তিনি বলেন, যারাই আচরণবিধি লঙ্ঘন করবে তাদের বিষয়ে ব্যবস্থা নেয়া হবে।

কোটা সংস্কার আন্দোলনকারীদের প্ল্যাটফর্ম থেকে এজিএস পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করা ফারুক হাসান বলেন, এখনো পর্যন্ত পরিবেশ ভালো রয়েছে। তবে ছাত্রলীগের আগের কর্মকাণ্ডে একটা শংকা থেকেই যায় যে নির্বাচন আদৌ সুষ্ঠু হবে কি না বা এখনকার পরিবেশ নির্বাচনের দিন পর্যন্ত বিরাজ করবে কি না। তবে আমরা আশাবাদী। জাতীয়তাবাদী ছাত্রদল থেকে জিএস পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করা খন্দকার আনিসুর রহমান অনিক বলেন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এখন মুক্তচর্চার জায়গায় নেই। এখানে ভিন্ন মতকে প্রতিনিয়তই দমন করা হচ্ছে। ডাকসু নির্বাচনকে সামনে রেখে আমরা আজই প্রথম মুক্তিযোদ্ধা জিয়াউর রহমান হলের মাধ্যমে প্রচারণা শুরু করেছি। আমাদের নেতাকর্মীরা অন্যান্য হলে প্রচারণা শুরু করতে পারেনি। আমাদের ভয়ের থেকেও এখানে সাধারণ শিক্ষর্থীদের ভয় বেশি কাজ করছে। তাদের ওপর কঠোর নজরধারী রাখছে ছাত্রলীগ। যার কারণে কেউই আমাদের সঙ্গে কথা বলতে সাহস পাচ্ছে না। সাধারণ শিক্ষার্থীদের চোখে মুখে আমরা ভয়ের ছাপ দেখতে পাচ্ছি। তিনি বলেন, মধুর ক্যান্টিনে আসার শুরু থেকে ছাত্রলীগ নানাভাবে আমাদের ক্রিটিসাইজ করেছে। এখন সেটি তারা সরাসরি করছে না, কিন্তু অন্যভাবে করছে। তবে নির্বাচনী পরিবেশ শেষ পর্যন্ত ঠিক থাকবে কি না একটা শঙ্কা থেকেই যায়।

আগামী ১১ই মার্চ প্রায় ২৮ বছর পর অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে ডাকসু নির্বাচন। এ নির্বাচনে কেন্দ্রীয় সংসদে ২৫টি পদের বিপরীতে ২২৯ জন প্রার্থী নির্বাচনের জন্য মাঠে রয়েছেন। এছাড়া ১৮টি হলে ৫০৯ জন প্রার্থী রয়েছেন।

কেন্দ্রীয় সংসদে ভিপি পদে ২১ জন এবং জিএস পদে ১৪ জন প্রার্থী প্রতিদ্বন্দ্বিতা করবেন। এছাড়া এজিএস পদে ১৩ জন, স্বাধীনতা সংগ্রাম ও মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক সম্পাদক পদে ১১ জন, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিষয়ক সম্পাদক পদে ৯ জন, কমনরুম ক্যাফেটেরিয়া সম্পাদক পদে ৯ জন, আন্তর্জাতিক বিষয়ক সম্পাদক পদে ১১ জন, সাহিত্য সম্পাদক পদে ৮ জন, সংস্কৃতি সম্পাদক পদে ১২ জন, ক্রীড়া সম্পাদক পদে ১১ জন, ছাত্র পরিবহন সম্পাদক পদে ১০ জন, সমাজসেবা সম্পাদক পদে ১৪ জন এবং ১৩টি সদস্য পদের বিপরীতে ৮৬ জন নির্বাচন করবেন। এছাড়া ১৮টি হলে ১৩টি করে পদের বিপরীতে প্রার্থী রয়েছেন মোট ৫০৯ জন। এর মধ্যে- সলিমুল্লাহ মুসলিম হলে ২৭ জন, জগন্নাথ হলে ২৮ জন, বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুন্নেসা মুজিব বলে ১৭ জন, মুক্তিযোদ্ধা জিয়াউর রহমান হলে ২৬ জন, অমর একুশে হলে ২৯ জন, জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান হলে ২৭ জন, বাংলাদেশ কুয়েত মৈত্রী হলে ৩৪ জন, হাজী মুহম্মদ মুহসীন হলে ৩৩ জন, রোকেয়া হরে ৩০ জন, কবি সুফিয়া কামাল হলে ৩০ জন, শামসুন্নাহার হলে ২৫ জন, কবি জসীমউদ্‌্‌দীন হলে ২৫ জন, ড. মুহাম্মদ শহীদুল্লাহ হলে ২২ জন, ফজলুল হক মুসলিম হলে ৩৬ জন, বিজয় একাত্তর হলে ৩০ জন, শহীদ সার্জেন্ট জহুরুল হক হলে ২৭ জন, স্যার এএফ রহমান হলে ৩৭ জন এবং সূর্যসেন হলে ২৬ জন প্রার্থী প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন।