আয়ারল্যান্ড সফরে একবারই সংবাদ সম্মেলনে এসেছেন। তাও শর্ত ছিল—বিশ্বকাপ নিয়ে কথা বলা যাবে না। তবে প্রথম আলোকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে বাংলাদেশ ওপেনার তামিম ইকবাল কথা বলেছেন তাঁর বিশ্বকাপ স্মৃতি, ইংল্যান্ড বিশ্বকাপে নিজের ও দলের লক্ষ্যের কথা।
প্রশ্ন: আপনার প্রথম দেখা বিশ্বকাপ নিশ্চয়ই ১৯৯৯। যেটা বাংলাদেশেরও প্রথম বিশ্বকাপ। ওই বিশ্বকাপ নিয়ে কী কী স্মৃতি মনে পড়ে?
তামিম: ওই বিশ্বকাপের দুটি স্মৃতি মনে পড়ে। বাংলাদেশের দুটি জয়—স্কটল্যান্ড ও পাকিস্তানের বিপক্ষে। স্কটল্যান্ডের বিপক্ষে ম্যাচটার স্মৃতি তো এখনো মনে আছে। স্কটল্যান্ড দলে হ্যামিল্টন নামে একজন ব্যাটসম্যান ছিলেন, ওই ম্যাচে খুবই ভালো খেলছিলেন। আব্বা বারবার বলছিলেন একে আউট করতেই হবে, না হলে বিপদ আছে। ম্যাচটা ওই দিকেই যাচ্ছিল, এমন সময় মঞ্জু ভাই (সাবেক পেসার মঞ্জুরুল ইসলাম) ফলোথ্রুতে বলে হাত লাগিয়ে নাটকীয়ভাবে ওকে রান আউট করেন। চাচা (আকরাম খান) ওই ম্যাচে কোনো রানই করেননি। তাতে আমাদের উদ্যাপনে কোনো কমতি ছিল না। বাসার সামনে অনেক লোকজন এসেছিল। ব্যান্ড পার্টি, ঢোল, বাজনা। আর পাকিস্তান ম্যাচ তো বাংলাদেশের ক্রিকেট ইতিহাসের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ জয়গুলোরই একটি।
প্রশ্ন: নিজের প্রথম বিশ্বকাপ ২০০৭ সালে। যে বিশ্বকাপের কথা উঠলেই ভেসে ওঠে ডাউন দ্য উইকেটে গিয়ে আপনার সেই ছক্কা মারার দৃশ্য…
তামিম: এরপর এত ছক্কা মেরেছি, তবু মানুষ ওটা নিয়েই বলে। তখন জাতীয় দলে এসেছি খুব বেশি দিন হয়নি। আর সেটা বিশ্বকাপে আমাদের প্রথম ম্যাচ ছিল। ওই ম্যাচে অনেকেই হয়তো প্রথমবার আমাকে টিভিতে খেলতে দেখেছেন। ওটা নিয়ে খুব বেশি বলতে চাই না। হ্যাঁ, ওই ম্যাচ নিয়ে যদি জিজ্ঞেস করেন, ওটা অবশ্যই আমার জীবনের বিশেষ ম্যাচগুলোর একটি।
প্রশ্ন: এখন ওই ইনিংস বা ছক্কাটা নিয়ে তেমন কিছু মনে না হলেও তখন নিশ্চয়ই অনেক উত্তেজনা কাজ করছিল। বিশ্বকাপে প্রথম ম্যাচ, সেই ম্যাচে ক্যারিয়ারের প্রথম ফিফটি, জয়—এত কিছু!
তামিম: ২০০৭ বিশ্বকাপের স্কোয়াডে সুযোগ পাওয়ার পর থেকেই অন্য রকম উত্তেজনা কাজ করছিল। এত বড় মঞ্চ, আমার বয়সই বা কত তখন। বিশ্বকাপে এত বড় খেলোয়াড়দের সঙ্গে খেলতে পারব, যাঁদের এত দিন টিভিতেই দেখেছি, তাঁদের সামনে থেকে দেখতে পারব। এগুলো নিয়ে উত্তেজনা ছিলই। ভারতের বিপক্ষে ম্যাচটার কথা যদি ভাবেন, কত তারকা তখন তাদের দলে, টেন্ডুলকার, দ্রাবিড়, শেবাগ, সৌরভ, যুবরাজ। ওই ম্যাচের পর আমাকে রাহুল দ্রাবিড় একটা ব্যাট দিয়েছিলেন।
প্রশ্ন: গত বিশ্বকাপের কোয়ার্টার ফাইনালে খেলেছেন। এবার লক্ষ্যটা এক ধাপ এগিয়ে সেমিফাইনালের কথা বলছে অনেকে। আপনি নিজে কী আশা করছেন?
তামিম: আমি কোনো লক্ষ্য স্থির করে দিতে চাই না। এবার যে ফরম্যাটে খেলা হবে, ৯ প্রতিপক্ষের সবার সঙ্গে ম্যাচ, পরের ধাপে যেতে হলে আমাদের খুবই ভালো ক্রিকেট খেলতে হবে। এমন নয় যে এক-দুই ম্যাচে কিছু ঘটিয়ে ফেললেই পরের রাউন্ড। সবগুলো দলের ঘুরে দাঁড়ানোর সুযোগ থাকবে। আমাদের জন্য সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিশ্বকাপটা ভালোভাবে শুরু করা। বাংলাদেশ দল কোনো টুর্নামেন্টে ভালো শুরু করলে সাধারণত ওই টুর্নামেন্টের শেষ পর্যন্ত ভালো খেলে। প্রথম দুটি ম্যাচ তাই খুব গুরুত্বপূর্ণ। এই দুই ম্যাচের (দক্ষিণ আফ্রিকা ও নিউজিল্যান্ড) একটা জিততে পারলেই আমাদের বড় সুবিধা হবে। তবে সেমিফাইনাল খেলব, ফাইনাল খেলব, চ্যাম্পিয়ন হব—এভাবে ভাবতে চাই না।
প্রশ্ন: দলের ভালো শুরু তো আপনার ওপরই অনেকটা নির্ভর করে। তা আপনার প্রস্তুতিটা কেমন থাকে?
তামিম: আমি আমার মতো করে প্রস্তুতি নিই। পেছনেরটা তো অনেকে দেখে না বা জানে না, তবে অনেক প্রস্তুতিই নিতে হয়। যে বোলারদের বিপক্ষে খেলছি, তাদের নিয়ে ভাবতে হয় অনেক। তারা কেমন বোলার, কী লেংথে বল করে, আমাকে কোন লেংথে বল করতে পারে। নিজেকে যতটুকু ভালোভাবে প্রস্তুত করা সম্ভব, তাতে ছাড় দিই না। কারণ যদি ম্যাচে নাও পারি, নিজেকে যেন বলতে পারি, না, আমি আমার সর্বোচ্চটা দিয়েই চেষ্টা করেছি। হয়তো ব্যর্থ হলাম, কিন্তু চেষ্টায় কোনো ঘাটতি ছিল না। ব্যর্থ হলেও তখন খারাপ লাগে না।
প্রশ্ন: আপনাদের অনেক প্রস্তুতি যেমন লোকে দেখে না, ক্রিকেটারদের কষ্টের জীবনটাও চোখে পড়ে না মানুষের। প্রায়ই সফরে থাকতে হয়, দেশে খেলা হলেও তো হোটেল জীবন…।
তামিম: এটা সহজ নয়। আমার তো খুবই ছোট একটা বাচ্চা, ওকেও খুব বেশি সময় দিতে পারি না। পরিবার থেকে দূরে দূরে থাকা অবশ্যই কষ্টের। তবে এটাও মনে রাখি সব সময়, আমি জাতীয় দলের হয়ে খেলছি। এখানে খেলা আমার জাতীয় দায়িত্ব। নিজেকে বোঝাই, আর তো পাঁচ-ছয় বছর খেলব। তখন সন্তান, পরিবারকে অনেক সময় দিতে পারব। এখন জাতীয় দলে খেলি, এটাই আমার পরিবার। আর এখন প্রযুক্তি এত উন্নত হয়েছে, ভিডিও কল করা যায়, এটাতে এক দিক দিয়ে সুবিধা হয়েছে। দূরত্বটা অন্তত কম মনে হয়।
প্রশ্ন: আপনার ব্যাটিংয়ের প্রসঙ্গে আসি। এখন অনেক পরিণত ব্যাট করেন। আগের মতো আর আক্রমণাত্মক খেলেন না…
তামিম: দলে কে কী করবে না করবে, সেটা ঠিক করে দেওয়া আছে। যখন নিজের ইচ্ছেমতো চলতে পারবেন, অনেক কিছু করার স্বাধীনতা থাকে। কিন্তু আপনাকে যখন দল একটা নির্দিষ্ট ভূমিকা দেবে, আপনি আপনার মতো করে সবকিছু করতে পারবেন না। আমি চেষ্টা করি আমাকে দল যে দায়িত্ব দিয়েছে, সেটা ঠিকমতো পালন করার। চেষ্টা করি ফিফটি পার করার পরও নিজেকে যতটা সম্ভব শান্ত রাখতে। অতীতে অনেকবারই এমন হয়েছে, ফিফটি করার পর বেশি উচ্ছ্বাসে ভেসে গিয়েছিলাম। ফিফটি করার পর হঠাৎ বাজে শট খেলে আউট হয়ে গেছি। কিন্তু এখন প্রতিটা মুহূর্তে ম্যাচের পরিস্থিতি বুঝে নিজেকে মানিয়ে নিয়ে খেলি। গত ম্যাচটাও যদি দেখেন, আমি যখন ফিফটি করি, কিছুক্ষণের মধ্যে সৌম্য আউট হলো। ওই সময়ে আমরা দুজনই মেরে খেললে দুজনই পরপর আউট হয়ে যেতাম হয়তো। সৌম্য আউট হওয়ার পর আমার মূল লক্ষ্যই ছিল আরও একটা জুটি গড়া। আপনি কী চাচ্ছেন, সেটা বেশি গুরুত্বপূর্ণ নয়। দল কী চাচ্ছে, সেটাই গুরুত্বপূর্ণ।
প্রশ্ন: যেকোনো একটি ফরম্যাটে অন্তত ১০ হাজার রান নিয়ে অবসরে যেতে চান। গত ইনিংসে তো ওয়ানডেতে সাড়ে ৬ হাজার রান পূর্ণ হলো…
তামিম: এই লক্ষ্যের কথা তো প্রায় সবাই জানেন। তবে এখন ওয়ানডে ম্যাচের সংখ্যা এত কমে আসছে, সত্যি বলতে এটা এখন অনেক কঠিন। আর টেস্ট আমরা এত কম খেলার সুযোগ পাই, সেখানে এটা (টেস্ট ১০ হাজার রান থেকে ৫৬৭৩ রান দূরে আছেন) আরও কঠিন। তবে শেষ পর্যন্ত চেষ্টা করে যাব। এখন আসলে ব্যক্তিগত চাওয়ার চেয়েও বেশি চেষ্টা করি বাংলাদেশকে যত বেশি সম্ভব ম্যাচ জেতাতে ভূমিকা রাখতে পারি। সত্যি কথা বলতে, এখন খুব বেশি ভবিষ্যৎ নিয়ে ভাবি না। বর্তমানে থাকতেই পছন্দ করি। আর দলগতভাবে আমার চাওয়া যদি জিজ্ঞেস করেন, যখন অবসর নেব, বাংলাদেশ বিশ্বের সেরা পাঁচ দলের একটা থাকলেই অনেক খুশি থাকব।