অপরাধ নিয়ন্ত্রণে ক্লোজ সার্কিট টেলিভিশন (সিসিটিভি) ক্যামেরার ব্যবহার বাড়ে হু-হু করে। গত কয়েক বছরে চট্টগ্রামের গুরুত্বপূর্ণ সড়কের বিভিন্ন মোড়, ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান, সরকারি অফিস আদালত, এমনকি কারাগারেও সিসিটিভি ক্যামেরার ব্যবহার হচ্ছে। কিন্তু তাতেও নিয়ন্ত্রণে নেই অপরাধ। নগরজুড়ে কমতি নেই ছিনতাই, চুরি, ডাকাতি, মাদক পাচারসহ নানা অপরাধের। খুনের মতো ঘটনাও ঘটছে অহরহ। তাও আবার প্রশাসনের নাকের ডগায়, কারাগারের মতো নিরাপদ জায়গায়। অথচ এসব ঘটনা প্রমাণের মোক্ষম চিত্রও পাওয়া যায় না এসব সিসিটিভি ক্যামেরায়। গত কয়েক বছরে চট্টগ্রামে ঘটে যাওয়া হত্যাকাণ্ডের সিসিটিভি ফুটেজ পর্যালোচনা করে দেখা যায়, অধিকাংশ হত্যাকাণ্ডের সময় খুনির বা খুনের ঘটনার চিত্র হয় অস্পষ্ট, না হয় ঘুনের ঘটনা প্রমাণের মোক্ষম চিত্র ধারণে ঝির ঝির শব্দ ও কালো স্ক্রিন ভেসে ওঠে। আর অপরাধ সংঘটিত হওয়ার সময় সিসিটিভি ক্যামেরার এমন মাথা বিগড়ে যাওয়ার ঘটনাকে কোনোমতেই ভালোভাবে নিতে পারছে না মামলার তদন্ত কর্মকর্তারা। তাদের এককথা-অপরাধ নিয়ন্ত্রণে ব্যবহারের জন্য যেখানে সিসিটিভি ক্যামেরার এই ডিভাইস, সেখানে তা কোনো কাজেই আসছে না। বরং এ বিষয়ে যান্ত্রিক ত্রুটি, বিদ্যুৎ না থাকাসহ নানা অজুহাত দাঁড় করায় ডিভাইস ব্যবহারকারীরা।
গত ২৯শে মে রাতে চট্টগ্রাম কেন্দ্রীয় কারাগারে অমিত মুহুরী হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় পাওয়া সিসিটিভি ফুটেজ নিয়েও এমন প্রশ্ন উঠেছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর মধ্যে। কারা কর্তৃপক্ষের সরবরাহকৃত ভিডিও ফুটেজের ধারাবাহিকতা না থাকায় মামলার তদন্ত কর্মকর্তা সিএমপি’র নগর গোয়েন্দা শাখার পরিদর্শক আজিজ আহমেদ চরম অসন্তোষ প্রকাশ করেছেন। তিনি বলেন, ঘটনার দিন বিকাল ৪টা ৫৭ মিনিট থেকে ৫টা ৭ মিনিট পর্যন্ত সিসিটিভি’র ফুটেজ নেই। আবার পরদিন অর্থাৎ ৩০শে মে সকাল ১১টা ৯ মিনিট থেকে সকাল ১১টা ২৩ মিনিট পর্যন্ত ১৪ মিনিটের ভিডিও ফুটেজও নেই। এ বিষয়ে চট্টগ্রাম কারাগারের জেলার নাছির আহমেদ বলছেন, ওই সময় বিদ্যুৎ ছিল না। তাই ভিডিও ফুটেজ নেই। কিন্তু এর ফলে নতুন রহস্য তৈরি হয়েছে। হত্যা মামলার আসামি রিপন নাথকে ৬ নং সেলে প্রবেশ করানো এবং খুনের আলামত হিসেবে রক্তমাখা ইট ও কম্বল সেল থেকে কখন উধাও হলো সেই প্রশ্নের উত্তর এখনো পাওয়া যায়নি। শুধু অমিত মুহুরী হত্যাকাণ্ডই নয়; সাবেক পুলিশ সুপার বাবুল আক্তারের স্ত্রী মাহমুদা খানম মিতু হত্যাকাণ্ড, স্বর্ণ ব্যবসায়ী মৃদুল চৌধুরী অপহরণ, কিশোরী তাসফিয়ার রহস্যজনক মৃত্যুসহ একাধিক ঘটনায় সঠিক সময়ের সিসিটিভি ফুটেজ না পাওয়ায় মামলার তদন্তে বিঘ্ন ঘটেছে। সূত্র জানায়, ২০১৬ সালের ৫ই জুন সাবেক পুলিশ সুপার বাবুল আক্তারের স্ত্রী মাহমুদা খানম মিতু হত্যা মামলা তদন্তেও দেখা যায়-ঘাতকরা যে পথ দিয়ে আসা-যাওয়া করেছে সে পথের একটি মন্দিরের দু’টি সিসিটিভি ঘটনার দিন ভোর ৪টা থেকে বন্ধ ছিল। এছাড়া হত্যাকাণ্ডের সময় পাওয়া ফুটেজগুলোয় খুনিদের চলাফেরা করতে দেখা গেলেও অস্পষ্ট ছিল তাদের চেহারা। সে সময় এ নিয়ে বেশ তদন্ত হয়েছিল বলে জানিয়েছেন মামলার তদন্ত কর্মকর্তা সিএমপি’র গোয়েন্দা শাখার অতিরিক্ত উপ-কমিশনার মো. কামরুজ্জামান। তিনি বলেন, মাহমুদা খানম মিতু হত্যাকাণ্ডের আগে ও পরে সিসিটিভি ফুটেজের সব তথ্য পাওয়া গেলেও ঘটনার সময়ের ফুটেজ ছিল ঝাপসা। সিসিটিভি’র যান্ত্রিক ত্রুটি এই সময়ে হলো কেন? নাকি এর নেপথ্যে কোনো উদ্দেশ্য ছিল। যার কোনো উত্তর এখনো মেলেনি।
২০১৪ সালে নগরীর কোতোয়ালি থানা এলাকা থেকে অপহরণের শিকার হয়েছিলেন স্বর্ণ ব্যবসায়ী মৃদুল চৌধুরী। ওই সময় অপহরণকারীরা তাকে কোনো সড়ক দিয়ে নিয়ে গিয়েছিল সেই তথ্যও পুলিশ বের করতে পারেনি সিসিটিভি ফুটেজের অভাবে। সড়কে থাকা সিএমপি’র সিসিটিভি ফুটেজও বন্ধ ছিল তখন। ২০১৮ সালের ১লা মে নগরীর গোলপাহাড় মোড় থেকে সিএনজি টেক্সিতে বাসায় যাওয়ার কথা থাকলেও পতেঙ্গা সমুদ্র সৈকতে চলে যায় নগরীর একটি ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলের নবম শ্রেণির শিক্ষার্থী তাসফিয়া আমিন। পরদিন সৈকতে তার মরদেহ পায় পুলিশ। তাসফিয়া কোন সিএনজি টেক্সিতে চড়ে পতেঙ্গায় পৌঁছেছিল সেই গাড়ির সন্ধান এখনো পায়নি পুলিশ। কারণ সিসিটিভি ফুটেজের অভাব! যে দুই-তিনটি ফুটেজ পুলিশ পেয়েছিল সেখানে গাড়ির নম্বর পরিষ্কারভাবে ধরা পড়েনি। ফলে তাসফিয়াকে বহনকারী টেক্সিটি রয়ে যায় অধরা।এ ব্যাপারে নিরাপত্তা বিশ্লেষক মেজর (অব.) এমদাদুল ইসলাম বলেন, আপনি যেসব ঘটনার কথা বলছেন সেসব আমারও জানা। হ্যাঁ, প্রতিটি ক্ষেত্রেই মাঝখানের ফুটেজ গায়েব হয়ে গিয়েছিল। আমার কথা হলো, যান্ত্রিক ত্রুটিই যদি হবে তবে শুধুমাত্র সেই নির্দিষ্ট সময়ের ফুটেজই শুধু গায়েব হবে কেন?
আর এ ধরনের পণ্য কেনার সময় ওয়ারেন্টি দেয়া থাকে। যান্ত্রিক ত্রুটি থাকলে সারিয়ে নিলেই তো হয়। কিংবা যারা সরবরাহ করেছে, তাদের কী সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ কোনো রকম কমপ্লেন করেছে? সেটা খতিয়ে দেখার প্রয়োজন আছে বলে মত প্রকাশ করেন তিনি।