দক্ষিণ আফ্রিকাকে হারিয়ে শুরুটা যেভাবে হয়েছিল তাতে আরো রঙিন হওয়ার কথা ছিল বাংলাদেশের বিশ্বকাপ। কিন্তু হয়নি। পাকিস্তানের বিপক্ষে ম্যাচ শেষে পয়েন্ট টেবিলে বাংলাদেশের অবস্থান সাতে। অস্ট্রেলিয়া-দক্ষিণ আফ্রিকা ম্যাচ শেষে আটে নামার শঙ্কাও আছে। তবে পয়েন্ট টেবিলে অবস্থান যা-ই হোক, বেশ কিছু ইতিবাচক দিকের পরও বাংলাদেশের বিশ্বকাপ অভিযানকে মোটা দাগে ব্যর্থ বলতে হবে।
বাংলাদেশ বিশ্বকাপে গিয়েছিল সেমিফাইনালে খেলার লক্ষ্য নিয়ে। ছোট ছোট বেশ কিছু ভুলের খেসারত দিয়ে সেই লক্ষ্য পূরণ হয়নি টাইগারদের। নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে মুশফিকুর রহীম কিউই অধিনায়ক উইলিয়ামসনের সেই রানআউট মিস না করলে, অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে সাব্বির রহমান ডেভিড ওয়ার্নারের সেই ক্যাচটি না ছাড়লে কিংবা ভারতের বিপক্ষে রোহিত শর্মার ক্যাচটি যদি তামিমের হাত ফসকে বের না হতো, ওপেনিংয়ে যদি দায়িত্ব নিতে পারতেন সৌম্য-তামিম, মোস্তাফিজের উইকেটগুলো যদি শুরুর দিকে হতো, তাহলে নিশ্চিত- বাংলাদেশ থাকতো সেরা চারে। তবে সেরা চারে দল না থাকলেও সাকিব আল হাসান কিন্তু আছেন বিশ্বকাপের শেষ অবদি।
এখন পর্যন্ত তার অর্জনই বিশ্বকাপে সেরা। মোস্তাফিজের অর্জনও খাটো করে দেখার সুযোগ নেই। প্রথম বাংলাদেশি খেলোয়াড় হিসেবে বিশ্বকাপের এক আসরে ২০ উইকেট শিকার মোস্তাফিজের।
গত চার বছরে বাংলাদেশের ক্রিকেটকে নতুন উচ্চতায় তুলেছে এই দল। ২০১৫ বিশ্বকাপের কোয়ার্টার ফাইনাল হয়ে ২০১৭ চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফির সেমিফাইনাল, ২০১৮ এশিয়া কাপের ফাইনাল খেলেছে দল। দেশের মাটিতে এসেছে একের পর এক সিরিজ জয়ের সাফল্য। দেশের বাইরেও এসেছে জয়, সিরিজ জয়। সাফল্যের পথ ধরেই এগিয়ে গেছে দল। সেই সাফল্যই স্বপ্ন দেখিয়েছে বিশ্বকাপ সেমিফাইনালের। ক্রিকেটারদের চোখেই স্বপ্ন দেখেছে সমর্থকরা। আস্থা রেখেছে টাইগারদের সামর্থ্যে। কিন্তু পূরণ হলো না সেই স্বপ্ন। দক্ষিণ আফ্রিকাকে হারিয়ে দারুণভাবে শুরু করা বিশ্বকাপে বাংলাদেশ এরপর হারাতে পেরেছে ওয়েস্ট ইন্ডিজ ও আফগানিস্তানকে। শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে জয়ের প্রত্যাশা ছিল, কিন্তু সেই ম্যাচ ভেসে গেছে বৃষ্টিতে। সেটি নিজেদের নিয়ন্ত্রণে ছিল না। কিন্তু পাকিস্তানকে হারানোর সুযোগ ছিল নিজেদের হাতেই। সেটি পারেনি দল। পাকিস্তানকে হারালে পয়েন্ট তালিকার পাঁচে থাকার সুযোগ থাকতো। ইংল্যান্ডের কন্ডিশনে লম্বা ফরম্যাটের বিশ্বকাপে পাঁচে থাকতে পারা র্যাঙ্কিংয়ের সাত নম্বর দলের জন্য যথেষ্ট ভালো ফলই হয়তো হতো। না হওয়ার পেছনে হয়তো অনেক কারণ আছে। সেসব কারণের মধ্যে অন্যতম- অধিনায়ক মাশরাফির ফর্মহীনতা। বিশেষ করে নতুন বলের বোলিং দলকে ভুগিয়েছে প্রবলভাবে। মাশরাফি নিজেকে হারিয়ে খুঁজেছেন টুর্নামেন্ট জুড়ে। বাংলাদেশের সফলতম ওয়ানডে বোলারের ক্যারিয়ারের সবচেয়ে দীর্ঘ উইকেট খরা এসেছে এই টুর্নামেন্টেই। দুই পায়ের হ্যামস্ট্রিংয়ের চোট নিয়ে চেষ্টা করে গেছেন ম্যাচের পর ম্যাচ, কিন্তু এবার আর চোট জয়ের গল্প রচনা করতে পারেননি। মোস্তাফিজুর রহমান টুর্নামেন্টে ২০ উইকেট নিলেও নতুন বলে উইকেট নেই একটিও। অপর পেসার সাইফুদ্দিন নিয়মিত উইকেট নিলেও রান দিয়েছেন প্রচুর। রুবেল হোসেন বাইরে বসে থাকায় আলোচনা হয়েছে প্রচুর। প্রথম সুযোগে অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে ম্যাচে ৯ ওভারে ৮৩ রান দেয়ার পর আর জোর দাবি জানাতে পারেননি। সাকিব ও মিরাজের স্পিন অবশ্য ছিল বেশ কার্যকর। কিন্তু পেসারদের ধারহীন বোলিংয়ে স্পিনাররাও খুব প্রভাব ফেলতে পারেননি।
এবারের আগে ২০০৭, ২০১১ ও ২০১৫ বিশ্বকাপেও তিনটি করে ম্যাচ জিতেছিল বাংলাদেশ। তবে ২০০৭ সালের সাফল্যে কাঁটা হয়ে আছে আয়ারল্যান্ডের কাছে হার, ২০১১ সালে আছে ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে ৫৮ ও দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে ৭৮ রানে অলআউট হওয়ার যন্ত্রণা। ২০১৫ বিশ্বকাপে তিন জয়ের দুটি স্কটল্যান্ড ও আফগানিস্তানের বিপক্ষে। এবার সেদিক থেকে পুরো টুর্নামেন্ট বিচার করলে হয়তো বাংলাদেশের সবচেয়ে ধারাবাহিক বিশ্বকাপ। কিন্তু শুধু এই আসরের বাস্তবতায় প্রাপ্তির চেয়ে অপ্রাপ্তিই বেশি।
প্রাপ্তির মধ্যে কেবল সাকিব আল হাসান। এ বিশ্বকাপে সাকিবের পারফরমেন্স অতিমানবীয়। গত ১০ বছর ধরে বেশির ভাগ সময় ছিলেন র্যাঙ্কিংয়ের শীর্ষ অলরাউন্ডার। কিন্তু বিশ্ব আসরে নিজের শ্রেষ্ঠত্বে ছাপ রাখার ব্যাপার হয়তো ছিল। সাকিব যেভাবে পারলেন, সেটি অনেকের কল্পনাকেও হয়তো ছাড়িয়ে গেছে। একজনের কাছ থেকে এমন অসাধারণ অলরাউন্ড পারফরম্যান্স বিশ্বকাপ আর দেখেনি। ৯ ম্যাচের একটি খেলতে পারেননি বৃষ্টির কারণে। খেলেছেন ৮ ম্যাচ। তাতেই ৭টি ইনিংস ফিফটি প্লাস। দুটি সেঞ্চুরি, ৫টি হাফ সেঞ্চুরি। সর্বনিম্ন ইনিংসটাও চলিশোর্ধ্ব (৪১ রানের)। বিশ্বকাপের ইতিহাসে এমন পারফরম্যান্স নেই আর কোনো ব্যাটসম্যানের। সাকিবের চেয়ে এগিয়ে থাকা শচীন টেন্ডুলকার ২০০৩ বিশ্বকাপে হয়তো ৬৭৩ রান করেছেন। কিন্তু তিনি সেঞ্চুরি করেছিলেন কেবল ১টি। হাফ সেঞ্চুরি ৬টি। তাও ৬৭৩ রান করেছেন ১১ ম্যাচের ১১ ইনিংসে ব্যাট করে। সাকিব যদি ১১ ইনিংস ব্যাট করার সুযোগ পেতেন, তাহলে তার রানটা কোথায় গিয়ে দাঁড়াতো? কিংবা অস্ট্রেলিয়ান ব্যাটসম্যান ম্যাথু হেইডেন। যিনি ২০০৭ বিশ্বকাপে করেছিলেন ৬৫৯ রান। তিনি সেঞ্চুরি করেছিলেন ৩টি। হাফ সেঞ্চুরি ১টি। ব্যাট করেছেন ১০ ইনিংসে। সাকিবের চেয়ে ২ ইনিংস বেশি। বিশ্বকাপের ইতিহাসে ৫০০ প্লাস রান এবং ১০টিরও বেশি উইকেট নেয়ার মতো পারফরম্যান্স এখনও পর্যন্ত কেউ দেখাতে পারেননি। বিশ্বকাপের ইতিহাসে এক ম্যাচে ৫০ প্লাস রান এবং ৫ উইকেট নেয়ার কৃতিত্ব ছিল কেবল একজনের। ভারতের যুবরাজ সিং। ২০১১ বিশ্বকাপে এই কৃতিত্ব দেখিয়েছিলেন তিনি। সেখানে ভাগ বসিয়ে দিলেন সাকিব। আবার একই টুর্নামেন্টে সেঞ্চুরি প্লাস ৫ উইকেট। এমন বিরল কৃতিত্বের জন্ম দিয়েছিলেন কেবল ভারতের দুই কিংবদন্তি। কপিল দেব আর যুবরাজ। সেমিতে খেলতে পারছেন না। ফাইনালে তো নয়’ই। তবুও, এখনই বিশ্বকাপের সেরা খেলোয়াড় হিসেবে ম্যান অব দ্য টুর্নামেন্টের পুরস্কারটা সাকিবকে দেয়ার জোর দাবি উঠে গেছে। ইএসপিএন ক্রিকইনফো তো অলরেডি তাকে ম্যান অব দ্য টুর্নামেন্ট ঘোষণা করেই দিয়েছে! সাকিবের ছবির পাশে এডিট করে বসিয়ে দিয়েছে টুর্নামেন্ট সেরার পুরস্কার। সাকিবের পারফরম্যান্স দেখে বিশ্বকাপের মাঝপথেই ইংল্যান্ডের বিখ্যাত দ্য টেলিগ্রাফ স্টোরি ছাপিয়েছে, ‘দ্য মোস্ট ভ্যালুয়েবল ক্রিকেটার সাকিব আল হাসান।’ কয়েকদিন আগে, ইএসপিএন ক্রিকইনফো আলাদাভাবে স্টোরি করেছে, ‘কেন সাকিবের মতো এমন একজন নিখুঁত অলরাউন্ডার আর উঠে আসছে না।’ ভারতের আনন্দবাজার সাকিবই সর্বকালের সেরা অলরাউন্ডার এই শিরোনামে প্রতিবেদন করেছে। বিশ্বকাপে অসাধারণ পারফরম্যান্স করেই তো এসব প্রশংসা অর্জন করেছেন সাকিব। এটা তার সঙ্গে পুরো দেশেরও কৃতিত্ব।